চাইলেই হাতের কাছে শীতের পিঠা

গ্রামে গ্রামে এখন নতুন ধান উঠছে। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের নতুন চালে নানা স্বাদের পিঠা-পুলিতে ম-ম করছে অগ্রাণের সকাল। শীতজুড়ে চলবে এই পিঠা-পুলির ধুম। দাদি, নানি, মায়ের হাতের যত্নে বানানো চিতই, দুধচিতই, ভাঁপা, পুলি, চাঁদপুলি, পাটিশাপটা, পাক্কনসহ তেলেভাজা, নারকেল, গুড়ের কিংবা খেজুরের রসের কত না বাহারি স্বাদের পিঠা।
কি গ্রাম, কি শহর- সবখানেই এখন শীতের আমেজ। ভোরে প্রকৃতিতে কুয়াশার চাদর, শিশিরে সিক্ত ঘাস-পত্রপল্লব। শীতলতা ছুঁয়ে যায় দেহখানি। এ সবই শীতের আগমনী বার্তা। তার সঙ্গে এসেছে শীতের পিঠার প্রস্তুতি। চোখে ভাসে হাতে হাতে ধোঁয়া ওঠা চিতই-ভাপা।
শীতের মৌসুমে শহুরে মানুষের গ্রামীণ পিঠাপুলি নিয়ে হাহাকার কমে এসেছে এখন। গ্রামের বাড়িতে শীতের সময় পিঠা খাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তগুলো তাদের স্মৃতিতাড়িত করলেও বেদনা জাগায় না তেমন। বাসার পাশেই, রাজধানীর পথে পথে, মোড়ে মোড়ে মৌসুমি পিঠার পসরা বসে শীতজুড়ে। নাগরিক পরিবারেও ঘরোয়াভাবে বানানো হচ্ছ নানান স্বাদের পিঠা। চাইলেই নেয়া যায় শীতের পিঠার আস্বাদ।
রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পিঠা খাওয়া এখন রাজধানীর অতি পরিচিত দৃশ্য। কর্মজীবী মানুষ চলতি পথে কিংবা সন্ধ্যার আড্ডায় নাশতাটা সেরে নিচ্ছেন শীতের পিঠা দিয়ে। শিক্ষার্থীরা বন্ধুসমেত চলে আসছে কাছে-দূরের পছন্দের পিঠা দোকানের সামনে।
রাজধানীর পিঠা-পসারীদের কাছে শুধু বিভিন্ন স্বাদের পিঠাই নয়, মেলে নানা বরন আর গন্ধের ভর্তাও। কী নেই তালিকায়- শুঁটকির ভর্তা, শুকনা মরিচ কিংবা কাঁচা মরিচ ভর্তা, সরষেবাটা, রসুন কিংবা ধনে পাতার ভর্তা, কালিজিরা আর তিলের ভর্তাসহ নানা পদের ভর্তার স্বাদ নিতে পারে শহরের ক্রেতারা।
রাজধানীর মানুষের শীতের পিঠার এই রসনাবিলাসের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু মৌসুমি পিঠা ব্যবসায়ী আর বাড়তি আয়ের আশায় কিছু নিম্নবিত্ত নারী। খেটে খাওয়া মানুষগুলো শীতের মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে সকালে ও সন্ধ্যায় বাহারি পিঠা আর ভর্তার পসরা সাজিয়ে বসেন। মাত্র ৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে পছন্দমতো পিঠা ও ভর্তার স্বাদ নিতে পারছে নাগরিক মানুষ।
ফার্মগেট এলাকার এক পিঠার দোকানে কথা হয় স্বপন হাওলাদার নামের একজন যুবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ব্যাচেলর মানুষ, চাকরির কারণে মায়ের থেকে দূরে থাকি। চাইলেই মায়ের হাতের সুস্বাদু পিঠা, ভর্তা খেতে পারি না। তাই শীতের মৌসুমি পিঠা খেতে ইচ্ছে হলে পিঠার দোকানে চলে আসি। মাঝে মাঝে লম্বা লাইন পড়ে গেলেও বিভিন্ন স্বাদের পিঠা আর ১০-১৫ পদের ভর্তার লোভ সামলাতে পারি না।’
ফার্মগেটে ভ্রাম্যমাণ এক পিঠার দোকানি রাহাত। কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় স্থায়ীভাবে বসতে পারেন না বলে তিন-চার পদের বেশি পিঠা বানানো সম্ভব হয় না তার। তবে ভর্তা করেন ১৫-২০ পদের। এর মধ্যে নোনা ইলিশ, চ্যাপা শুঁটকি, লইট্ট্যা শুঁটকি, পুঁটি মাছ, চিংড়িসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের ভর্তা আছে। শুকনা মরিচ-কাঁচা মরিচ ভর্তা, সরষেবাটা; রসুন, কালিজিরা, তিল, জলপাই, পুদিনাপাতা, ধনেপাতার ভর্তা দেন পিঠার সঙ্গে। রাহাত জানান, প্রায় সব শ্রেণির মানুষই তার দোকান থেকে পিঠা কেনেন।
মধুবাগ ডাক্তার গলির পিঠা বিক্রেতা শফিকুল জানান, শীতের পিঠা অনেক ভালো চলে। ভাঁপা ১০ টাকা, চিতই পাঁচ টাকা আর ডিমচিতই ২০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। সকালে কিছু মুরব্বি আসেন তার দোকানে পিঠা খেতে। অনেকে বাসায় নিয়ে যান। চাকরিজীবী, পোশাককর্মীরাও তার বড় ক্রেতা। আর সন্ধ্যায় তরুণ-যুবকরাই বেশি আসে তার দোকানে। প্রতিদিন ছয় থেকে সাত কেজি চালের পিঠা বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অনেকের ইচ্ছা থাকলেও ঘরে পিঠার আয়োজন করা সম্ভব হয় না। তারা পথের দোকান থেকে কিনে নেন শীতের পিঠা। আবার শত ব্যস্ততার মধ্যেও অনেক পরিবারেই এখন আয়োজন করা হয় শীতের পিঠা। রাজধানী রামপুরার এক গৃহিণী বলেন, ‘সময়স্বল্পতার কারণে শীতের সময় সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি না। তারা দেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠার সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নয়। মা হিসেবে সন্তানদের দেশীয় পিঠার সঙ্গে পরিচিত করতে আমি নিজেই তাদের বিভিন্ন পিঠা বানিয়ে খাওয়াই।’
গ্রামের মানুষ নবান্নের আনন্দে যেভাবে শীতকে বরণ করে নিচ্ছে, রাজধানীবাসীও- হোক তা ঘরে কিংবা বাইরে, বাহারি পিঠার স্বাদে শীতকে বরণ করে নিচ্ছে এখন। শীতের মৌসুমি পিঠার স্বাদ এখন চাইলেই পাওয়া যায় নাগরিক জীবনে।
(ঢাকাটাইমস/২৬নভেম্বর/মোআ)

মন্তব্য করুন