এ কোন ঢাকা!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩৫

বর্ণনা দুটো এই শহরের। যে শহরে সূর্য ওঠে কর্মব্যস্ত মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে। তারপর জীবিকার সন্ধানে ছুটে বেড়ানো। আবার দিন শেষে ঝাঁকের পাখির মতো বাড়ি ফেরায় যাদের নিত্য অভ্যাস। বর্ণনাস্থল ভিন্ন। মিরপুর ঘেঁষা কালশীর রাস্তাটা যেন একটা নদীর মতো। যে নদীর ঘুম ভাঙেনি। তার বুক বেয়ে চলছে চার চাকার যানগুলো। বেশ ব্যস্ত রাস্তা। তবে শান্ত। ক্যান্টনমেন্ট উড়াল সেতু থেকে নেমে যাওয়া রাস্তাটিতে যানজট চোখে পড়ে না। কী সকাল কী রাত। একই রকম। ওই পথে যারা নিয়মিত চলাফেরা করেন তাদের জন্য ভ্রমণ বেশ আরামের। কিন্তু কালশীর রাস্তা পার হয়ে যেই না আপনি ওঠে এলেন মিরপুরের রাস্তায় মেজাজ বিগড়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

সাই সাই করে টেনে আসা বাসটি, যার একটি আসনে আপনি বসা সেই বাসটি এখন চলছে ধিকিধিকি। একটু একটু করে এগুচ্ছে। চাকাগুলো একবার পুরোপুরি ঘোরার আগেই আটকে ধরছে হাইড্রোলিক ব্রেক। কারণ কী? এই পথে এত ভোগান্তি কেন? ওই যে রাস্তা খুঁড়ে কুয়ো করা হয়েছে। যে কুয়ো বেয়ে যাবে মেট্রোরেল। কাজ চলছে। এই ভোগান্তির কত দিন চলবে বলতে পারবে কেউ? পারবে না। শহরের বুকে বিশাল স্তম্ভের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা উড়াল সেতুর কাজ যখন চলছিল তখন ভোগান্তি কাকে বলে তা কি নগরবাসী কম জানে?

টানা দুই বছরের বেশি সময় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বনানী থেকে মহাখালী হয়ে ফার্মগেট কিংবা মগবাজার আসা মানুষকে। যাক, শেষে উড়াল সেতু হয়েছে। তবে উড়াল সেতুতে আবার সেতুর নিচে লম্বা যানজট দুর্ভোগের নতুন মাত্রা। মগবাজার-মৌচাক অঞ্চলের দুর্ভোগ কি আজও কমেছে? সেতুর একটি অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে বড় আরও একটি অংশ। কাজ এখনো কিছুটা বাকি। এই কাজ শেষ করে মৌচাকের সেতু কবে গিয়ে নামবে রামপুরার মুখে এখনো ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। সেতুর কাজ চলছে আর নিচের রাস্তার কী দশা তা বর্ণনা করে বিরক্তি বাড়ানোর মানে হয় না।

মূল বর্ণনায় ফেরা যাক। শুরুতে যেটা বলব বলে ঠিক করেছিলাম। মিরপুর সাড়ে এগার থেকে তেঁতুলিয়া পরিবহনের একটি বাস চলছে। গন্তব্য শিশুমেলা। তবে এর আগে বাসযাত্রীদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মেলা ভোগান্তির। একটু একটু করে এগিয়ে চলা বাসটি পঁয়ত্রিশ মিনিট আটকে থাকতে হয়েছে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে। চত্বরের দক্ষিণ পাশে বড় বড় গর্ত খোঁড়া হয়েছে। এই গর্তের মাটি তুলে রাখা বাকি সড়কের অর্ধেকটা জুড়ে। তৈরি হয়েছে সরু গলি পথ। এই গলি পথ দিয়ে প্রতি মিনিটে পেরিয়ে যাচ্ছে শত শত গাড়ি।

আর মানুষের অবস্থা কী তবে? গাড়িতে চড়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সড়কের বুকে। যেখানে একটু বেখেয়ালে থাকলে পিষিয়ে যাবে চার চাকার যানগুলো। দৌড়ঝাঁপ করে যদিও বা উঠতে পারেন তারপর যা ঘটে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাসটি যখন চত্বর পেরিয়ে গন্তব্যে ছুটছে ঘটনার শুরু তখন থেকেই। মুহূর্তের মধ্যেই দিনদুপুরে অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে। বাসের ভেতরে নিঃশ^াস নেওয়ার মতো অবস্থা নেই।

মনে হচ্ছে মরুভূমির কোনো পথে চলছে বাস। ধুলো ঝড়ে সব পয়মাল। জানালাগুলো সব আটকে দেওয়া হয়েছে চোখের পলকে। ‘তবু ধুলো কোত্থেকে আসছে?’ যাত্রীদের এমন চেঁচামেচিতে পরিবেশ উত্তপ্ত। কারো খেয়াল করার সুযোগ নেই যে, বাসটির পেছনের দিকটার গ্লাস অর্ধেকটা নেই। ফাঁকা অংশ দিয়ে বাতাসের সঙ্গে ধেয়ে আসছে ধুলো। এবার যাত্রীদের সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টর, হেল্পার আর ড্রাইভারের হাতাহাতির বর্ণনা দিয়ে ঘটনা দীর্ঘ করার মানে হয় না।

মিরপুর ১০ নম্বর চত্বর থেকে কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও হয়ে শিশুমেলার রাস্তায় ওঠার আগে ধুলোর হাত থেকে রেহাই মিলবে না। এ চিত্র একদিনের নয়। প্রতিদিন ওই পথে যারা আসা-যাওয়া করেন তাদের কাছে এই শহরে পথচলা কতটা দুর্বিষহ তা জানতে না চাওয়াই ভালো। কারণ প্রতিক্রিয়া আপনার জন্য কতটা সুখকর হবে বোঝাই যাচ্ছে। ওই রাস্তার আশপাশের দোকানপাটগুলোর অবস্থা করুণ। ধুলোর রাজ্যে মানুষের বসবাস, নিত্যদিন এক অসহনীয় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

দীর্ঘদিন ধরে বেশ চওড়া করে মাটি খুঁড়ে গর্ত করা হচ্ছে মেট্রোরেলের জন্য। এ তো কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মূল কাজ যখন শুরু হবে তখন অবস্থা কী হবে? উন্নয়নের বিপরীতে দুর্ভোগ শব্দটা নগরবাসীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ভালোভাবেই। কেউ নিরুপায় হয়ে বলবেন, ‘সয়ে গেছে।’ আসলেই কি সয়ে গেছে?

দ্বিতীয় ঘটনার বর্ণনা শহরের অভিজাত এলাকার। যাদের যাপিত জীবনে আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে সেই সব মানুষের বাস ওই অঞ্চলে। গুলশান। ১২ জানুয়ারির ঘটনা। মোখলেসুর রহমান। ব্যবসায়ী। বাসা গুলশান-২ নম্বর এলাকায়। সকালের নাস্তা সেরে বাসা থেকে বেরোতে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৯টায় ঝুলেছে। আর তিনি এসে ঝুলেছেন জটে। গুলশান-২ নম্বর মোড়ের যানজটে তার কেটেছে পাক্কা দেড় ঘণ্টা। সব ঝক্কি পেরিয়ে হাতিরঝিলের পথ ধরে কারওয়ান বাজারে তাঁর অফিসে পৌঁছে দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন পৌনে বারোটা। দিনের অর্ধেকটা পথ পার করে এসে তাঁর কপালে যে ভাঁজ পড়েছে দিন শেষে সেই ভাঁজ আরও প্রগাঢ় হয়েছে। ফেরার পথের দুর্ভোগটাও যে এর চেয়ে কম ছিল না।

গুলশানে যানজটের এই সমস্যা খুব যে আগের তা নয়। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর পর শুরু হয়েছে। পুরো পাল্টে গেছে ওই অঞ্চলের ট্রাফিকিং সিস্টেম। একটি একটি করে গাড়ি তল্লাশি করে তারপর ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়। গুলশানে ঢোকার একাধিক রাস্তাও বন্ধ। এখন চেকপোস্টে না দাঁড়িয়ে হরহরিয়ে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ। ওই অঞ্চলের মানুষের প্রশ্ন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে কি নাগরিক ভোগান্তির জন্ম দেওয়া?

শুধু গুলশান নয়, এর আশপাশে যেসব এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বসবাস করে। বারিধারা, বাড্ডা, নদ্দা, কালাচাঁদপুর এলাকার মানুষের চলাফেরার পথ ছিল গুলশানের ভেতর দিয়ে। এখন এই পথ সীমিত হয়ে গেছে। চাইলেই কোনো রিকশা বা বিকল্প যান পাওয়া যায় না। চলতে হলে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। দিনের পর দিন এই ভোগান্তি মাথায় নিয়েই ঘর থেকে বের হচ্ছে শহরের মানুষ।

এই কি সেই তিলোত্তমা ঢাকা? আমাদের প্রাণের শহর? যানজট, গণপরিবহন নৈরাজ্য, ধুলোর রাজ্য, রাস্তা খুঁড়ে কুয়ো, আবর্জনার স্তূপ পথের পাশে, ফুটপাত বেদখল, শব্দ দূষণ, নদী দূষণÑএত সব সমস্যায় জর্জরিত এ কোন শহর? এ কোন ঢাকা?

নগরবিদরা মনে করেন, ঢাকার এত সব সমস্যা একদিনে হয়নি। একটির পর একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এসব সমস্যা সমাধানে কোনো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে এসব এখন নগরীর ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এক কথায় ঢাকা একটি অপরিকল্পিত শহর। এই শহরে মানুষ বাস করে বাধ্য হয়ে। জীবিকার জন্য। প্রয়োজনের তাগিদে। তা না হলে এই শহর ছেড়ে মানুষ চলে যেত অনেক আগেই।’ এই নগরবিদ মনে করেন, বাসযোগ্য ঢাকার সঙ্গে বর্তমান ঢাকার অনেক তফাত। তিনি বলেন, ‘যারা এখানে বসবাস করবে তাদের চাহিদা শুধু বাসস্থান আর খাদ্য নয়। তাদের চিত্তবিনোদনও একটা বড় চাহিদা। কিন্তু কটা খেলার মাঠ আছে শহরের ছেলেমেয়েদের জন্য? নির্মল বায়ু বলতে যা বোঝায় তা কি আর এখন আছে? বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সিসা। দূষিত রাসায়নিক পদার্থ যা দিন দিন মানুষের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে।’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অপরিকল্পিত এই শহরকে এখনো সময় আছে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার। শহরের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা দূর করা দরকার। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঢাকা হয়ে উঠবে চূড়ান্ত দুর্ভোগের এক নগরী।’

নৈরাজ্যের শেষ নেই গণপরিবহনে

কোথায় যাবেন? গাড়িতে উঠতে গেলে ঠেলাধাক্কা। গণপরিবহনগুলোর নৈরাজ্য। ভাড়া নিয়ে আবার যাত্রীসেবা নিয়ে। কোনোভাবে বাসের নামের পাশে সিটিং শব্দটা লাগাতে পারলেই হলো, ব্যস। রাতারাতি ভাড়া গিয়ে ঠেকবে দুই থেকে তিনগুণে। এ নিয়ে প্রথম কয়েক দিন যাত্রীদের সঙ্গে তক্কাতক্কি। তারপর আর কজনের ধাতে কুলোয় বলুন? মেনে নিতে হয় নিয়মবহির্ভূত সিদ্ধান্ত। সাধারণ যাত্রীদের যে বিকল্প কিছু নেই। গন্তব্যে যে তাদের যেতেই হবে। গণপরিবহনই তাদের শেষ ভরসা।

ব্যক্তিগত যানের সাধ্য এই শহরে কজনের আছে। অথচ একটা বিশাল অংশ যারা সাধারণ যাত্রীদের দিনের পর দিন শোষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। পরিবহন খাতের এই নৈরাজ্য তো নতুন কিছু নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজিরও নেই। কারণ, যারা ব্যবস্থা নেবেন তারা কিংবা তাদের রাজনৈতিক সহকর্মীরাই কোনো না কোনোভাবে এসব ব্যবসায় জড়িয়ে আছে। তাদের ছত্রছায়াতেই চলছে সাধারণের পকেট কাটা।

নীরব ঘাতক শব্দ দূষণ

অতিরিক্ত শব্দের কারণে নগরবাসীর শ্রবণশক্তি দিন দিন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। আমরা বধির হয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। চিকিৎসা বিজ্ঞান তাই বলছে। শব্দ দূষণের একটা বড় কারণ যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ন। দেখা যাবে, লম্বা যানজটে বসে চালক হর্ন দিয়েই যাচ্ছেন। তার ধারণা হর্ন দিলে সামনের গাড়িটি সরে যাবে। তিনি চলে যেতে পারবেন সহজে। অথচ তিনি একটিবার চিন্তা করে দেখেন না তার মতো সামনের গাড়িটিও যানজটে পড়ে আছে। আবার অনেক সময় অনৈতিকভাবে ওভার টেকিং করতে গিয়েও হরদম হর্ন দিচ্ছেন চালক। অনেক সময় এসব হুড়োহুড়ির কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

আবার হর্ন দেওয়া নিষিদ্ধ এমন জায়গা, যেমন- হাসাপাতাল, স্কুল কিংবা ধর্মীয় উপাসনালয় কিংবা আবাসিক এলাকাতেও গাড়িগুলোকে হর্ন বাজাতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে নিয়মনীতির কোনো বালাই থাকে না। চালকদের অনেকে মনে করেন, গাড়ি চালানো মানেই হচ্ছে হর্ন দেওয়া। এদের বিরুদ্ধে যদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো তবে এর প্রবণতা কমে আসত বলে মনে করেন নগরবাসী। নিত্যদিন এসব অসচেতন চালকের ভুলের মাশুল দিচ্ছেন নগরবাসী কোনো না কোনোভাবে।

২০০৭ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর রোড, গুলশান, ধানমন্ডি এলাকাসহ বেশ কিছু সড়কে হর্ন বাজানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছিল। এই আদেশ হওয়ার পর কয়েকদিন অভিযানে জরিমানা করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও দিত বাহিনীটি। কিন্তু এখন বন্ধ হয়ে গেছে সব অভিযান। আসলে এখনকার পুলিশ কর্মকর্তারা সেই আদেশের কথা মনেই করতে পারছেন না।

ফুটপাতে উৎপাত...

ঢাকার রাস্তায় ফুটপাত দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কবে হেঁটেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর চট করে কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ, ফুটপাতের কথা মাথায় এলেই চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে তা অস্বস্তির। পায়ে পথ চলতে গেলে সেই অবস্থাও নেই। ফুটপাত আছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে। যেখানে তারা পসরা সাজিয়ে বসে আছে ক্রেতার অপেক্ষায়। ওভারপাসগুলোও কি বাকি থাকে? ঢাকার একেকটি ওভারপাস যেন একেকটি উড়াল মার্কেট। হকারদের আনাগোনা হররোজ। তাদের যুক্তিÑ কী করে খাবে তারা? আবার নগর কর্তৃপক্ষ বলছে, হকার্স মার্কেট আছে। তারা সেখানে যায় না। কেন যায় না? এই উত্তরও আছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। হকার্স মার্কেটে যারা ব্যবসা করেন তারা আদপে কেউ হকার নয়, সবাই মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী। এই স্বল্পপুঁজিতে সেখানে দোকান করা তাদের জন্য সম্ভব নয়।

পথের মাঝে ময়লার স্তূপ

পথের মাঝখানে কিভাবে ময়লা-আবর্জনা স্তূপ করে রাখতে হয় মেরুল বাড্ডা গেলে তাও দেখা যায়। যানজট তো আছেই। বাসে বসে আছেন। বাস গিয়ে ঠিক দাঁড়াল ভাগাড়ের সামনে। জানালা দিয়ে ভগভগিয়ে ঢোকা দুর্গন্ধটা গা গুলিয়ে দেবে মুহূর্তেই। অনেকে সহ্য না করতে পেরে ভেতর থেকে কিছু বের করে দিলে...। অপেক্ষা করুন। সহ্যশক্তির চরম পরীক্ষা দিতে হবে আপনাকে। যানজট ঠেলে টুকটুক করে উত্তর বাড্ডায় এলে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। কারণ মেরুলের ভাগাড় উত্তর বাড্ডার আবর্জনার স্তূপের তুলনায় কিছুই নয়। দিন দিন এ ভোগান্তি বাড়ছে। নগরীর ব্যস্ততম সড়কের বেহাল দশা আর কতকাল?

নতুনবাজার থেকে সোজা পথ চলে গেছে কুড়িল বিশ্বরোডের দিকে। বলা সহজ। তবে সোজা পার হয়ে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। বাড্ডার পর শাহজাদপুর পর্যন্ত এক টানে কোনো গাড়ি পার হবে, এটা ভাবার অবস্থা নেই। রাস্তার ওপর বাঁশের স্তূপ। কোথাও নির্মাণসামগ্রীর দোকানের সামনে সরঞ্জাম রাখা। আবার একটু পথ এগোলে পার্ক করা বাসের লম্বা সারি। রামপুরা থেকে মিরপুরের পথে চলাচলকারী পরিবহনগুলো দিন শেষে এখানে এসেই ক্ষ্যান্ত হয়। পথের অর্ধেকটা থাকে তাদের দখলে। বাকি সরু পথে যান চলে ঢিমিয়ে ঢিমিয়ে।

বিপরীত পাশে পুরনো আসবাবে দোকান ঘেঁষে রাস্তা কেটে কাজ চলছে। পথটা কম নয়। গুলশান-২ হয়ে আমেরিকান দূতাবাসের পাশ দিয়ে মাদানী সড়ক হয়ে প্রগতি সরণিতে ওঠার মুখ নতুনবাজার। ঢোকার পথও একটাই। যে কারণে ওই পথে যানজট বেশ পুরনো। এই জট ঠেলে নদ্দার পথ পার হতে পারলেও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঢোকার পথে থামতে হবেই। বাকিটা পথ হয়ত ভালোয় ভালোয় পার হতে পারবেন। তবে দ্বিতীয়বার এ পথে ফেরার ইচ্ছে জাগবে না−বলা যায় জোর দিয়েই। অসুবিধা নেই কুড়িল উড়াল সড়ক খোলা আছে। সোজা ওঠে গেলেই বেঁচে গেলেন। আর যারা নিত্যদিন এ পথে চলেন? তারা? তাদের কথা কেউ কি ভাবেন? নন্দিত নরকপথে যাত্রা আর কতকাল?

প্রধান সড়কে বাজার

রামপুরা থেকে বাজার করতে বাজারে যেতে হয় না। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কীভাবে? রামপুরা বাজারের কাছাকাছি রাস্তার ওপরেই মিলবে মাছ, মুরগি, শাক-সবজির দোকান। অবস্থা দেখে মনে হবে, চলাচলের জন্য নয় জিনিসপত্রের পসরার জন্য তৈরি হয়েছে পথ। ঠিক রাস্তার মাঝখানে এসে সবজির ডালা নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতা। তার পাশে মাছের হাঁড়ি। আর মুরগি কাটাকুটির কাজ চলছে রাস্তার ওপর। কোনো পথচারী যদি ধাক্কা খান দোকানিদের, সঙ্গে উল্টো কথা শুনতে হবে। হয়ত দেখা যাবে কোনো দোকানি খেঁকিয়ে উঠে বলছেন, ‘দেখে চলতে পারেন না? এইখান দিয়া হাঁটেন কেন?’ তখন চোখ কপালে না তুলে আস্তে সরে আসাই শ্রেয়। নয়ত অপমানিত হতে হবে। বড় বড় গর্ত, জলাবদ্ধতা কিংবা ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার জন্যই যে এ পথে যানজট তৈরি হয়, ভুল কথা। রাস্তা দখল করে দেদার বাণিজ্যও এজন্য দায়ী। প্রমাণ পেতে ওই পথে ঘুরে এলেই হয়।

রাজধানীর অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের প্রধান সড়কেও দেখা যাবে এই চিত্র। ফুটপাত ছাড়িয়ে হকাররা এখন দখল করে নিয়েছেন মূলক সড়কের একটি করে লেন। যেন কোনো আইন নেই। পুলিশ কিছুই দেখছে না, বলছে না। আবার সড়কের অপ্রতুল শহরে সড়ক ইজারা দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে সিটি করপোরেশন এই মতিঝিলেই। কেবল মতিঝিল নয়, নিউ মার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকাতে এই ব্যবস্থা রেখেছে তারা।

মগবাজার-মৌচাকে ঘুরেফিরে খোঁড়াখুঁড়ি

মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য তিন বছর ধরে ভোগান্তির শেষ ছিল না মগবাজার মোড় সন্নিহিত রাস্তাগুলোর। ফ্লাইওভারের হলি ফ্যামিলি-সাতরাস্তা অংশ চালু হওয়ার বেশ অনেক দিন পর এর নিচের রাস্তা মেরামত করা হয়। সেটাও বেশি দিন হয়নি, মাসখানেক হবে। এরই মধ্যে খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে মগবাজার থেকে কাকরাইল দিকের রাস্তাটি। ওদিকে আগে থেকে ভাঙাচুরা মগবাজার-মালিবাগ রাস্তায় পড়েছে খোঁড়াখুঁড়ির কোপ। ফলে আবার ভোগান্তি, আবার যানজট। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে যানবাহন।

মৌচাক থেকে মগবাজারমুখী পথে গাড়ি চলাচল তো প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ করে রাখা হয়। ফলে বাধ্য হয়ে ঘুরপথ ধরে অন্য রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে হয় বলে জানান কয়েকজন চালক। এখন গাড়ি চলাচলে রাস্তাটি খুলে দেওয়া হলেও খোঁড়াখুঁড়ির কারণে যানজট বেড়েছে আরো। মৌচাক মোড়ে এখনো চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ওই রাস্তায় যান চলাচল তো দূরের কথা পায়ে হেঁটে মানুষের চলাফেরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই চালাতে হচ্ছে গাড়ি। আর ভোগান্তি চরমে গিয়ে ঠেকেছে যাত্রীদের।

খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) পথ খুঁড়ছে। কারণ কী? জবাবে কাজের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি জানান, ১৩২ কেভি লাইনের জন্য মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের তার টানা হচ্ছে। এ জন্য চার ফুট চওড়া করে সাত ফুট গভীর গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। তবে কাজ শেষ হতে কত দিন লাগতে পারে এ ব্যাপারে তিনি জানেন না। মগবাজারের বাসিন্দা শামসুজ্জামান লিয়ন বলেন, ‘ওই পথে নিয়মিত আসা-যাওয়া করি। মাটি ফেলার কারণে ফুটপাতের সামান্য জায়গায় চলাচলে কষ্ট হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘বোঝাই যায় এখানে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে, কাকে কী বলব! এক মাসের মাথায় হঠাৎ মূল সড়ক খুঁড়ে এভাবে পথচারীদের ভোগান্তির মুখে ফেলার কোনো মানে হয় না।’

যাত্রাবাড়ী মোড়ে সমস্যা কাটেনি

যাত্রাবাড়ী উড়াল সেতুর কাজ শুরুর আগে থেকেই ওই রাস্তার দুর্দশা ছিল। উড়াল সেতুর কাজ চলেছে কয়েক বছর। তখন সেখানে চলাচল ছিল রীতিমতো দুর্বিষহ। উড়াল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ঠিক কিন্তু ভোগান্তি কমেনি। সেতুর নিচের রাস্তার দুরবস্থা এখনো কাটেনি। খান্দাখন্দে এখনো বর্ষা এলে পানি জমে থাকে। তার ওপর খোঁড়াখুঁড়িও চলছে। ধুলোর কারণে ধূসর থাকে ওই এলাকার পরিবেশ। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। কবে শেষ হবে তার কোনো ঠিক নেই। তার ওপর সেতুর নিচের রাস্তা পথচারীর জন্য নিরাপদ নয়। রাস্তা পারাপারে নেই কোনো জেব্রা ক্রসিং কিংবা ওভারপাস। প্রতিনিয়ত মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হচ্ছে।

প্রাণহীন নদীর কথা

নদীর পানি দেখতে কেমন? এই প্রজন্মের ছোট ছেলেমেয়ে যারা এই শহরে বেড়ে উঠছে, তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা একবাক্যে বলবে, ‘কালো। মিশমিশে কালো।’ শুনতে অবাক করা হলেও এটাই বাস্তবতা। কারণ বুড়িগঙ্গার তীরবাসীর কারণে এর চেয়ে ভালো উত্তর আর কী আপনি আশা করতে পারেন, বলুন? দূষণে কালো হয়ে গেছে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার অন্তর।

নদী দূষণ ঠেকাতে, পানি পরিশোধন করতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেসব প্রকল্পের অর্থ জলেই গেছে বটে। কালো জলের পেছনে টাকার পাহাড় ঢেলে দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। নদী দূষণ কি আদৌ কমেছে? নাকি তুরাগ, বুড়িগঙ্গা কিংবা শীতলক্ষ্যার রং এতটুকু পাল্টেছে?

ঢাকার আশপাশের এই নদীতে ভ্রমণে বের হলে নাক চেপে রাখতে হয় রুমাল দিয়ে। দুর্গন্ধের মাত্রা এতটাই তীব্র যে, স্বাভাবিক নিঃশ^াস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য দায়ী এই শহরের মানুষ। যাদের মধ্যে নেই নদীর জন্য এতটুকু মায়া। প্রকৃতির অকৃত্রিম এই দান আমরা রক্ষা করে পারছি না। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তাও আমরা দেখছি। হারিয়ে গেছে মৎস্য ভান্ডার। নদীর শোভা জলপ্রাণীর অস্বস্তি আজ মুখে মুখে।

শহরের মানুষ সৃষ্ট যত বর্জ্য, কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য, রাসায়নিক দ্রব্য সব চলে যাচ্ছে নদীতে। এ সবের দেখভালের দায়িত্ব যাদের তারা প্রায় নিশ্চুপ। এসব দেখার আছে অনেকে। বলার কেউ নেই। এখন নদী আছে নামে। যার প্রাণ নেই।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :