প্রশ্নের মতো দেখতে এগুলো কী, মন্ত্রীবাহাদুর?

তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের অমনযোগী ছাত্র আমি। ইউএনবিতে লেটনাইট করে হলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ‘শয্যামিত্রের’ পাশে সোজা হয়ে শুয়েছি কেবল। ঘুম একটু একটু করে গভীর হচ্ছে। কিন্তু কিছু শব্দ আমায় ঘুমোতে দিল না। ফিসফিস, খসখস- বারান্দায় হাঁটার শব্দ। চোখ মেলে দেখলাম রুমের এক বড় ভাই (বাংলা বিভাগের ছাত্র) সাবধানে দরজা খোলে বাইরে যাচ্ছেন। আমি উঠে বসলাম। বললাম, ‘ভাই, কই যান?’ ভাই আমার বাইরে গেলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। বারান্দায় গিয়ে দেখি, বড় ভাইয়েরা প্রায় সবাই সজাগ। সবার ভেতরে একটা উত্তেজনা। ‘জাহাঙ্গীর’ নামের এক ভাইকে ঘিরে আছে সবাই। উনি সবার মনোযোগের কেন্দ্র। রাত পোহালেই বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা। বিশেষ মানে বিশেষ। প্রিলি, রিটেনের ঝামেলা কম। একটা পরীক্ষা দাও। পাস করলে সোজা ভাইভা। এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?
বিসিএস পরীক্ষার্থীরা দিন-রাত এক করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। বিসিএস কোনো সহজ বিষয় না। অনেক সাধনার পরে বিসিএস হয়। এমনও আছে চার-পাঁচবার ভাইভা দিয়েও কাজের কাজ হয় না। অভিজ্ঞতা বাড়ে, টাকের পরিধি বাড়ে, কিন্তু চাকরি হয় না। কারো কারো অবশ্য প্রিলি, রিটেন আর ভাইভা একবার একবার করে দিলেই হয়ে যায়। তবে এই মহাসৌভাগ্যবানরা সংখ্যায় বেশি না।
যাই হোক, ভোরের আগের আবছা আলোয় দেখি জাহাঙ্গীর ভাই ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। হাতে কাগজের কী যেন একটা! আমার রুমের ভাইকে দেখলাম কয়েকজনকে নিয়ে একটা কাগজ হাতে নিয়ে আরেকটা রুমে চলে গেলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভাই থেকে টান মেরে একটা কপি নিলাম। হলে আমাকে নিয়ে অনেক বড় ভাই অস্বস্তি বোধ করতেন। সম্ভবত রাজনৈতিক আদর্শিক কারণে। আবার কিছু বলতেও পারতেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আমি। আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে ‘খবর’ হওয়ার মতো ঝুঁকি নেবে কে?
দেখলাম, হাতে লেখা কোনো চিঠি নয়; একেবারে কাগজে ছাপানো একটা প্রশ্নপত্র। আমি অবাক হলাম। যদিও এই মহাসুযোগ নেয়ার মতো বয়স আমার তখনো হয়নি। আমি সকালের অপেক্ষা করলাম। আকাশ একটু ফরসা হতেই আমি পার্শ্ববর্তী নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে গেলাম। ডিবির মাহবুব ভাইকে খুঁজলাম। তিনি নাই। নোকিয়া সেট থেকে ফোন করলাম মাহবুব ভাইকে। উনি বললেন ধানমণ্ডি থানায় গিয়ে জিডি করতে। আমি দেরি না করে থানায় জিডি করে এর কপি নিয়ে গেলাম টিএসএসির সাংবাদিক সমিতি অফিসে। ফ্যাক্স করলাম অফিসে। আরও কয়েকটি দৈনিকেও ফ্যাক্স করলাম। চেষ্টা করলাম পিএসসিতে যোগাযোগ করতে। ততক্ষণে নয়টা বেজে গেছে। কাজের কাজ কিছুই হলো না। বিসিএস বিশেষ পরীক্ষা হয়ে গেল। দুপুরে পিএসসির নারী চেয়ারম্যানকে ফোনে ধরলাম। উনি অস্বীকার করলেন। কদিন পর রেজাল্ট বের হলো। আমার রুমমেট এবং আরও অনেকের বিসিএস হলো। আজ তারা অনেক বড় মানুষ। হল-জীবনে খুবই ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত সেই ভাইদের কথা আজও মনে পড়ে।
সে সময় পিএসসির একজন মেম্বার ছিলেন উত্তরবঙ্গের। উনি আমাদের ক্যাম্পাসে কিছু রিপ্রেজেন্টেটিভ রেখেছিলেন। ‘মুরগি’ ধরার জন্য। পরে ১/১১ এলে তিনি পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। সম্ভবত ধরাও পড়েছিলেন। তবে বেশিদিন কারাগারে কষ্ট করতে হয়নি তাকে। টাকার জোরে বের হয়ে এসেছিলেন। আমার ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এই পিএসসি মেম্বারের কড়া বিচার হবে। হয়নি। উনি এখন কোথায় আছেন? আপনারা কেউ জানেন?
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এল আওয়ামী লীগ। অনেক আশা নিয়ে পথচলা শুরু করল আওয়ামী লীগ সরকার। শুরুতেই বিশাল হোঁচট। বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত হলো। সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কষ্ট করে সামাল দিলেন পরিস্থিতি। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলো। নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুযায়ী শুরু হলো যুদ্ধাপরাধের বিচার। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে ছেলেমেয়েরা পাঠ্যপুস্তক পেতে শুরু করল। বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেয়া এখনো অব্যাহত আছে। বড় একটা অর্জন নিঃসন্দেহে। ওদিকে বিসিএস পরীক্ষা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতে শুরু করল। আগে যেমন অনেক গ্যাপ দিয়ে হতো, ইদানীং তেমনটা হয় না। একটার প্রক্রিয়া শেষ না হতেই আরেকটা শুরু হচ্ছে। এখন তো লাইব্রেরিগুলোতে গল্প-উপন্যাস কিংবা বিষয়সংশ্লিষ্ট বইয়ের পাঠকের তুলনায় বিসিএস পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। ভালো, মাঝারি, মন্দ- সব ক্যাটাগরির ছাত্র-ছাত্রীই এখন বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। যাক, এটা অন্য প্রসঙ্গ। আরেক বলা যাবে।
আওয়ামী লীগের আমলে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস আমার জানামতে না ঘটলেও প্রশ্নপত্রে ভুলের ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। কিন্তু স্কুল-কলেজের অবস্থা কী? এসএসসি-এইচএসসির কী খবর? এই তো সেদিন এসএসসির ইংরেজি পরীক্ষার আগের রাতে ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁসসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক ঝড় বইয়ে দিল। কয়েকজন ইনবক্স করল। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে পরদিন সকালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম। মিল না পেয়ে বললাম- ‘আলহামদুলিল্লাহ’। মিল পেলে শুরু হতো মানসিক যন্ত্রণা। নিউজ করতে হতো। নিউজ করা যেত কি না, তাও একটা প্রশ্ন। দায়িত্বশীলরা তো মানতেই চান না। উল্টো ভয় দেখান। এ বিষয়ে সমাজের বেশির ভাগ মানুষই ভয় পেয়ে আছে। চোখের সামনে অনেক কিছু হয়। কিন্তু কিছু বলে না। অনেকে তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যারা অস্বস্তি নিয়ে আছেন, তারাও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে করে সৎ লোকজন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন। সক্রিয়তা কমে যাচ্ছে। সৎ লোকের সক্রিয়তা কমে গেলে সমাজের জন্য খারাপ। আমাদের মন্ত্রীবাহাদুর যদি একটু ঘোষণা দিতেন যে তিনি সৎ সাধারণ বাবা-মায়ের সঙ্গে, সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করবেন, সবার বক্তব্য শুনবেন, তাহলে বোধহয় ভালো হতো।
সরকার বলে সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। সাইবার ক্রিমিনালরা কিন্তু চুপ থাকছে না। কাজ করে যাচ্ছে। বলা যায়, মোটামুটি আরামসে। বদন কিতাবে খোলাখুলি পোস্ট দিচ্ছে। মোবাইল ফোনের নম্বর দিয়ে বলছে, প্রশ্ন পেতে হলে জলদি যোগাযোগ করতে। টাকার পরিমাণও বলে দিচ্ছে। প্রশ্নের মতো দেখতে কিছু জিনিসও মিলছে বদন কিতাবের অনিয়ন্ত্রিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য দুনিয়ায়। তাহলে এরা কারা? সরকার এদের ধরে না কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় একদিন দেখলাম ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ শীর্ষক পেজেই সোহাগ নামের এক ছেলে পোস্ট দিল- ‘যারা জাহাঙ্গীরনগর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েটিং লিস্টে আছো, তারা কন্টাক করো। চাঞ্চ ১০০%। টাকা চান্সের পর। এডভান্সড লাগবে। Sohag 01762998923 # মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ শুধুমাত্র ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটে চান্স করে দিতে পারব। টাকা চান্সের পর। # হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ সকল ইউনিটেই # ডিরেক্ট চান্স করে দিতে পারব। # পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এ সকল ইউনিটেই # চান্স করে দিতে পারব। যাদের # হেল্প লাগবে তারা #Add দিয়ে #Early ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে কনফার্ম কর।’
আমি ওই নম্বরে ফোন দিলাম। সোহাগ নামের সেই ছেলে ফোন ধরল এবং বলল, প্রথমেই ১০,০০০ টাকা দিতে হবে এবং সকাল ১০টার মধ্যে। তিনটা সিট ফাঁকা আছে! দেরি করলে অন্যরা নিয়ে নেবে সুযোগ। মজা লাগল বিষয়টা। আমার আরেক সহকর্মীকে দিয়ে ফোন করালাম ১১টার দিকে। তাকেও সে একই কথা বলল। টাকা তাড়াতাড়ি পাঠাতে বলল। আমি অবশ্য এর আগেই সকালে ঢাবির অভিভাবকদের বিষয়টা জানিয়ে বললাম, এই ছেলেকে ধরে আইনের হাতে তুলে দেয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। ওর ফোন খোলা আছে। ট্র্যাক করে সহজে ধরা যাবে। কিন্তু যাদের বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের কোনো গরজ দেখলাম না, আমিও চুপ মেরে গেলাম।
এ রকম সাইবার অপরাধীরাই কিন্তু প্রায় বিনা বাধায় অপকর্ম করে যাচ্ছে। অনেক মানুষ আছেন, যারা বিশ্বাস করেন টাকা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়! আমরা জানি যায় না। কিন্তু মানুষের মগজে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, টাকা ছাড়া কিছু হবে না। এমনও আছে, চাকরি হয়ে গেছে, কিন্তু টাকা নিয়ে ঘুরছে দেয়ার জন্য। মনে শান্তি পাচ্ছেন না বলে। এমন একটি দুর্নীতিপ্রিয় সমাজে আমাদের মনে আশার সঞ্চার করতে পারত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। কিন্তু তারাও তো দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। আর্থিক দুর্নীতি, কৌশলের দুর্নীতি, আচরণের দুর্নীতি। শিক্ষক ধান্দাবাজ, ছাত্র ধান্দাবাজ। সব মিলে কী ভয়ংকর অবস্থা!
আগে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ থেকে ভালো রেজাল্টের খবর নিয়ে ঘরে আসত। বাবা-মায়েরা ছুটতেন মিষ্টি কিনতে। আর এখন বাবা-মায়েরা প্রশ্ন খোঁজেন বাইরে। ছেলেমেয়েরা ঘরে নির্ঘুম রাত কাটায় প্রশ্নের আশায়। এ কোন বাংলাদেশ! বাবা প্রশ্ন না আনতে পারলে বা আনতে না চাইলে মায়েরা বলে, ‘সারাটা জীবন তুমি কাটিয়ে দিলে। কাজের কাজ কিছুই করতে পারলে না। তোমার মতো নিষ্কর্মা আর একটাও নেই।’ এ কেমন জীবনসংসার আমাদের?
মন্ত্রী মহোদয়ের মতো আমিও বলি, প্রশ্ন ফাঁস হয় না। কিন্তু প্রশ্নের মতো দেখতে যে জিনিস বদন কিতাবে, হোয়াটসঅ্যাপে দেখা যায়, সেগুলো কী? সবাই দেখে উনি দেখেন না কেন? এভাবে একটা সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। যে চান্স পেল না, সে ভাবে সবাই নকল করে পাস করেছে। যে চাকরি পেল না, সে ভাবে টাকা নাই বলে তার চাকরি হলো না। টাকা-পয়সাওয়ালা কেউ সৎ হতে পারে- এমন ধারণা সাধারণের সমাজ থেকে প্রায় উঠেই গেছে। কিন্তু আসলে তো সবটাই নষ্টদের অধিকারে যায়নি। কিন্তু যাওয়ার প্রক্রিয়াও তো কম বেগবান নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন