মিডিয়া কি ক্ষমা চাইবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে?

সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। তার উপর আমার রাগ, অনুরাগ, প্রেম, ভালোবাসা কিছুই নেই। তারপরও আমি আজকে এই মানুষটির পক্ষ নিয়ে একটা কথা বলছি।
আমি বলছি না আবুল হোসেন ধোয়া তুলসী পাতা। আবার এটাও বলছি না আবুল হোসেন একজন চোর, দুর্নীতিবাজ মানুষ। কেননা দুটোই প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু তার সাথে যা হয়েছিলো সেটা অন্যায় হয়েছিলো। তাকে যে স্রেফ মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়ে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে সেটা তার প্রতি আমাদের অবিচার।

শুধুমাত্র বিশ্বাস নির্ভর সাংবাদিকতা যে এজন ব্যাক্তিরই না একটা দেশের জন্যও প্রচণ্ড রকম ক্ষতিকারক, আবুল হোসেনের সাথে ঘটে যাওয়া মিডিয়া ট্রায়ালকে যুগ যুগ ধরে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের ব্যাপারে একটা প্রচলিত অতি সাধারণ ধ্যান ধারণা হলো এই লোকটা ‘ধান্দাবাজি’ করে টাকা কামিয়েছে। এখন রাজনীতিতে এসছে আরো ক্ষমতা পকেটে পুরে আরো কাড়ি কাড়ি টাকা বানাতে।
সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস আছে আমাদের দেশে রাজনীনিবিদরা দুর্নীতির সঙ্গে নানান ভাবে জড়িয়ে থাকেন। কেউ প্রত্যক্ষ, কেউ পরোক্ষভাবে। আর সাধারণ ধারণাটার উৎপত্তি কিন্তু সেখান থেকেই।
তাই বলে ব্যতিক্রম কি নেই? একজন রাজনীতিবিদও নেই যিনি এখনো সৎভাবে রাজনীতি করেন, পয়সার দিকে না চেয়ে, নিজের স্বার্থের দিকে না চেয়ে, শুধুমাত্র দেশের জন্য রাজনীতি করেন? এমন একজনও কি নেই?
এ প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় না বলে দেয়াটা অন্যায় হবে। তার কারণ আমরা নিশ্চিত ভাবে জানি না। সৎ লোকেদের একটা বড় গুণ হলো তারা কখনো মুখ ফুটে বলতে আসেন না তারা সৎ। আর সেজন্যই তারা বেশির ভাগ সময় সংখ্যা কম, এবং আওয়াজেও ছোটো হন। তাই ঢালাও ভাবে কখনো যদি বলা হয় বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদ অসৎ তাহলে অনেক বড় একটা অন্যায় করা হবে সেই সৎ মানুষগুলোর প্রতি, যাদের কথা আমরা হয়তো জানিই না।
তবে বাংলাদেশের মিডিয়া তার সাথে যে কাজটি করেছে সেটা ঘোর অন্যায় হয়েছে। স্রেফ সাধারণভাবে প্রচলিত একটা বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে একজন মানুষকে এরকমভাবে অপদস্থ করা উচিৎ হয়নি।
সেসময় বাংলাদেশের প্রধান প্রধান মিডিয়া হাউজগুলো যে অপরিপক্বতা দেখিয়েছে এবং আবুল হোসেনকে যেভাবে একতরফা ভাবে ‘বিচার’ করে সাথে সাথেই ‘দণ্ড’ দিয়েছে সেটা অন্যায় হয়েছে। তাকে দিনের পর দিন একটা অপ্রমাণজনক অভিযোগের দায় ঘাড়ে নিয়ে মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। তার সচিবকে জেলে যেতে হয়েছে। এটা অন্যায়।প্রমাণ ছাড়া কাউকে চোর বলা অন্যায়। কেন না সে যদি আসলেই চুরি না করে থাকে তাহলে আপনি একজন নির্দোষ মানুষকে বিনা অপরাধে শাস্তি দিলেন। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
মজার ব্যাপার হলো, কেউ অন্যায়টুকু কেউ স্বীকার করার সৎ সাহসও দেখালেন না। অথচ পদ্মাসেতু দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতের কাছে রীতিমত অপদস্থ হয়েছে। অভিযোগের কোন ভিত্তি না পেয়ে কানাডার পুলিশকে আদালত ভর্ৎসনা করেছে এই বলে যে, কেবল গুজবে বিশ্বাস করে এরকম একটা মামলা হাতে নিয়ে তারা আদালতের সময় নষ্ট করেছে। কোনো প্রমাণ কিংবা সত্যতা না পেয়ে এ অভিযোগকে স্রেফ গালগপ্প বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিচারক।

আচ্ছা, করলাম না হয় অন্যায়, করলাম না হয় ভুল। কিন্তু এখন তো প্রমাণ হলো আমাদের ধারণাটা অন্তত এক্ষেত্রে ভুল ছিল। এখনও কি এ মিডিয়া তাদের ভুল শুধরাবে না। যে অন্যায় তারা আবুল হোসেনের সঙ্গে করেছেন তার মাশুল চোকাবেন না?
দৃশ্যমান দুর্নীতির অনেক প্রমাণ আমাদের চোখের সামনে আছে। সরকারের নানান স্তরে দুর্নীতি হয় এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। খোলা চোখেই অনেক কিছু দেখা যায়। কিন্তু মিডিয়া এই সাধারণ দেখার উপর ভর করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে না। বিশেষ করে যখন এমন একটা ঘটনা, যেখানে কয়েকটি দেশ এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা জড়িত, তখন মিডিয়াকে সাবধান হতে হয়। না হলে ক্ষতিটা দেশের হয়। যেমনটা এক্ষেত্রে হয়েছে।বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের একজন সাবেক প্রতিনিধি হিসেবে আমি দুঃখিত। আমাদের উচিৎ হবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে তার প্রতি এই অবিচারের জন্য অন্তত ভুলটুকু স্বীকার করা। এতে আর কিছু না হোক মিডিয়ার পেশাদারিত্ব আর পরিপক্বতার প্রমাণ মিলবে।
লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ

মন্তব্য করুন