ভ্যালেন্টাইন ভুলিয়ে দিচ্ছে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস?

শেখ আদনান ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:৪৩| আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:৫৬
অ- অ+

সময়ের স্রোতে মানুষ অনেক কিছু বিস্মৃত হয়। তাই বলে নিকট অতীতের এত বড় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গেল কীভাবে? ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন এরশাদ সরকারের মজিদ খান শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন ১১ জন আন্দোলনকারী। গ্রেপ্তার হন ১৩৩১ জন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ।

ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যপক সংস্কারে মনযোগী হন এরশাদ। শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনা।

শিক্ষানীতিতে মজিদ খান শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করেন। সুপারিশে বলা হয়, শিক্ষার বেতনের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হবে। রেজাল্ট খারাপ হলেও ৫০ শতাংশ বেতন দিলে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয় শিক্ষানীতিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে বিলোপ করার প্রয়াসে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় প্রণীত স্বায়ত্তশাসনের অধ্যাদেশ বাতিলের সুপারিশ করা হয়। বলা হয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের মতই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে। ফলে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত ভূমিকা থেকে সরে গেছে।’

১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ, এরশাদ সরকার গঠনের দুদিন পরই ছাত্ররা সাভারে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে গিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী স্লোগান দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেনানিবাস থেকে সৈন্যবাহিনী ছুটে এসে ছাত্রদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়। ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার লাঠিচার্জ করে। এর প্রতিবাদে ১৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আন্দোলনের দৃঢ় শপথ নেয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারেই ১৪ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে কলাভবনে বিশাল ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি কার্জন হল ও শিক্ষাভবনের সামনে পৌঁছানো মাত্রই পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জাফর-জয়নাল-দিপালী সাহা। সর্বমোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। যদিও সরকারি হিসাবে বলা হয় মৃতের সংখ্যা মাত্র একজন। গ্রেপ্তার-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যায়। সরকারি হিসাবেই গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ১৩৩১ জন। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ।

১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ ছাত্রদের মরদেহ জানাজার জন্য অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হলে সেখানেও হামলা চালায় পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটে যায় ছাত্ররা। প্রাণহীন শহীদদের লাশ সূর্যসেন হল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেলে হলের গেট ভেঙ্গে যৌথবাহিনী ছিনিয়ে নেয় লাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কর্মচারীদের রুমে ঢুকে তাদের ওপর নিপীড়ন চালায় যৌথবাহিনী। এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে পরদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দেয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সামরিক সরকার।

ইতিহাসের এই কালো দিবসকে জাতি কি মনে রেখেছে? ১৪ ফেব্রুয়ারিকে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম জানে শুধু 'ভালোবাসা দিবস' হিসেবেই। নতুন প্রজন্ম কি জানে ১৪ ফেব্রুয়ারির ভালোবাসা দিবসকে জনপ্রিয় করা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ভালোবাসা দিবসে বিশ্বের সব দেশের মানুষ একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে, দিবসটি উদযাপন করে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে নিজের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি যে বড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সবাইকে জানতে হবে। ইতিহাসকে জেনে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ভালোবাসা দিবসের গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষকে অবশ্যই ইতিহাসমুখী হতে হবে। ইতিহাস সচেতন না হলে জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথচলা কখনোই মসৃণ হবে না।’ তিনি বলেন, ‘ইতিহাস শুধুমাত্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করে না, অতীতের অনেক ভুল ত্রুটি থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির বেদনাময় ইতিহাস জাতিকে ভুলে গেলে চলবে না।’

বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম আর রাজনীতিতে পুঁজিপতি আর মুনাফালোভীদের আধিপত্য বাড়ার সাথে সাথে সময়ের আবর্তনে দেশের মানুষ ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির ইতিহাসকে ভুলে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি এদেশের ছাত্র-জনতার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। ১৯৮৩ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণের সংগ্রামকে। কিন্তু মধ্য ফেব্রুয়ারির সেই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে আমদানি করা হয়েছে ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের মতো আয়োজন।’

এদিকে দিনটিকে 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে পালন করে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো। সকাল ৮টায় শিক্ষাভবনের সামনে 'শিক্ষা অধিকার চত্বরে' পুষ্পস্তবক অর্পণ করার মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের কর্মসূচি। বেলা ১১টায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল বের করবে ছাত্র সংগঠনগুলো। বিকাল ৩টায় ডাকসুর দ্বিতীয় তলায় একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।

(ঢাকাটাইমস/১৩ফেব্রুয়ারি/এসএএফ/জেবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শ্রীপুরে পিস্তল ঠেকিয়ে স্কুলছাত্র অপহরণে অভিযুক্ত কাউসার গ্রেপ্তার
ভালুকায় ইকোপার্কের গাছে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
দেশে আসছে নতুন সুপারম্যান, সঙ্গে জ্যাকি চ্যানের সিনেমা
ঢাকায় বেলারুশ দূতাবাস খোলার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা