৭১ এর কণ্ঠযোদ্ধা গোপাল সরকারের খোঁজ নেয়ার কেউ নেই

গোপাল সরকার। ছিলেন উত্তরাঞ্চলের মুক্তি সংগ্রামের একজন বড় সংগঠক। একাত্তরের উত্তাল দিন গুলোতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে না গেলেও তিনি দরাজ গলায় শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। উজ্জীবিত করেছিলেন মুক্তিকামী মানুষকে। রক্তে আগুন ধরা তার গাওয়া গণসঙ্গীতে সমবেত হতো জনতা, আর এ সমাবেশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন নেতারা। সময়ের পরিক্রমায় গোপাল সরকার এখন অবহেলিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা যখন বেড়ে গেলো তখন হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতের শরণার্থী শিবিরে। সেখানে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়ে গোপাল সরকার উজ্জীবিত করেছেন দেশ ত্যাগের বেদনায় কাতর ও হতবিহ্বল মানুষকে।
তহশীলদার পদে চাকরি করেও স্খলন গোপাল সরকারকে ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। তাই তার সংসারে এখন বাসা বেঁধেছে অভাব। এ মানুষটির কোনো অনুযোগ নেই কারো প্রতি। কাউকে বলেন না যাপিত জীবনের কষ্টের কথা।
বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও জীবন ঘষে এখনো আগুন জ্বালান, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন আর অবিচারের বিরুদ্ধে নিঃশঙ্ক চিত্তে আবারো কাঁপিয়ে দিতে চান দেশটাকে।
গোপাল সরকারের নিজের কোনো জায়গা জমি নেই। থাকতেন কুড়িগ্রামের উলিপুর সদরে কাশিম বাজার এস্টেটের মহারাজার পরিত্যাক্ত একটি পোড়ো বাড়িতে।
যখন তহশীলদার ছিলেন তখন ইচ্ছে করলে অনেকের মতো নিজ নামে লিজ নিতে পারতেন সরকারি জমি। কামাতে পারতেন অজস্র টাকা। কিন্তু তা তিনি করেননি। যখন চাকরি থেকে অবসর নিলেন, তখন উচ্ছেদ হতে হলো এই বাড়ি থেকে।
তারপর গোপাল ডেরা বাঁধলেন খাস জমিতে। বার বার নোটিশ আসে উঠে যাওয়ার। বাধ্য হয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানালেন এক চিলতি জায়গা লিজের জন্য। কিন্তু দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় পার হয়নি ওই ফাইল।
সরজমিন গিয়ে দেখা গেলো, এখন যেখানে বাস করেন সেটি ভূমি অফিসের পিছনে ভূমি অফিসের জায়গায়। আট হাত লম্বা আর চার হাত চওড়া একটি ঘরে রান্না থেকে শুরু করে থাকা খাওয়া। জানান, বর্ষা এলে ঘরে পানি ঢোকে। সাপ খোপের ভয়ে ঘুম আসে না তাদের। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পরদিন আবার জীবন সংগ্রামে নেমে পড়েন গোপাল বাবু।
গোপাল বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা যেমন করে তার স্টেনগানকে ভালোবাসে, তেমন করে এ দেশটাকে ভালোবাসেন তিনি। বয়সের ভারে ও অভাবে নাকাল হলেও থেমে নেই এ মানুষটি। মানুষের কষ্ট তাকে প্রবল যন্ত্রনা দেয়। সামান্য আয়ের কিঞ্চিত বাঁচিয়ে সেই টাকায় ওষুধ কেনেন।
অভাবের সংসারেও পরোপকার ভুলেননি গোপাল সরকার। মাত্র দুই টাকায় ওষুধসহ হোমিও চিকিৎসা দেন তিনি গরিবদের। বেশিভাগ সময়ই তা আবার বিনে পয়সায়।
সুকান্তের সেই কবিতার মতো, ‘আমি যেনো সেই বাতিওয়ালা। যে রাজপথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার ....।’
গোপাল এখনো শোনাতে চান ঘুম ভাঙ্গানিয়া গান, কিন্তু অসুস্থতা তাকে প্রায় শয্যাশায়ী করে ফেলেছে। শুধু গান নয়, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখেছেন নাটক, মঞ্চস্থ করেছেন তিনি। এখন লিখে যাচ্ছেন সংগ্রামী মানুষের কবিতা। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় কাজেও তার যথেষ্ট অবদান আছে এ এলাকায়। বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়েছেন ফলজ ও বনজ গাছ। সুযোগ পেলেই তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন সমাজ পরিবর্তনে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসেমব্লি হলে সেখানে দাড়িয়ে কচিকাঁচাদের দেশ প্রেমের গল্প শোনান।
এলাকায় বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতা কিংবা বিজয় দিবসে অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ডাকা হয় না গোপাল সরকারকে। এ জন্য তার কোনো অনুযোগ নেই। তিনি বললেন, এমন একদিন আসবে যেদিন এ সমাজ মূল্যায়ন করবে যার যা পাওনা তা বুঝে দিতে। সংগ্রামী এ মানুষটি আরো বলেন, সেদিন হয়তো তিনি থাকবেন না। তবে তার আগে দেখে যেতে যান দুর্নীতিমুক্ত শোষনহীন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
লেখক: সাংবাদিক, কুড়িগ্রাম

মন্তব্য করুন