সেদিনের স্মৃতি

মো. রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ
 | প্রকাশিত : ১৫ জুলাই ২০১৭, ১৪:২৮

১৫ জুলাই, ২০০৭। কোপা আমেরিকার ফুটবল ফাইনাল খেলা। লড়বে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দুই দলের সমর্থকদের পতাকা ছেয়ে গেছে। সবাই অধীর আগ্রহে ফাইনালে কে জিতবে দেখার অপেক্ষায়। মধ্যরাতে খেলা। এর মধ্যে চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। টান টান উত্তেজনায় রাত সাড়ে তিনটায় তিন গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কাপ জেতে ব্রাজিল। দুই দলের সমর্থকরা কেউ উল্লাস করে আর কেউ মন খারাপ করে ঘুমাতে যায়। কিন্তু আমার মনে কোনো উল্লাস নেই, বরং একটা আতঙ্ক কাজ করছে। বিভিন্ন মাধ্যমে শুনছি, নেত্রী গ্রেপ্তার হতে পারেন। ঘুম আসছে না।

বিছানায় এপিঠ ওপিঠ করছি। ফজরের আজান দেবে দেবে এই মুহুর্তে মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো, গোলাম সারোয়ার কবির ভাইয়ের ফোন। রিসিভ করতেই বললেন, শেখর ভাইয়ের (সাইফুজ্জামান শেখর) নির্দেশ তোমাকে সকালে জজ কোর্টে থাকতে হবে। নেত্রী গ্রেপ্তার হতে পারেন। আমি ভাইকে তোমার কথা বলেছি যে, ওই যথেষ্ট। ততক্ষণেও চলছে অঝোর বৃষ্টি। এরইমধ্যে শেখর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো একাধিকবার। প্রয়োজনীয় সব নির্দেশনাও দিলেন তিনি। নেতাকর্মীদের ফোন দিয়ে ম্যাসেজ জানালাম। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বললাম। সব প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। একের পর এক ফোন করে খোঁজ নিচ্ছি সুধাসদনের। ততক্ষণে মসজিদের শহর ঢাকায় চারদিকে আজান পড়ে গেছে। শুনেছি, নেত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। আমি তখন ঢাকা মহানগর (দঃ) ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য।

সকাল সোয়া সাতটার দিকে নেত্রীকে তার সুধাসদনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিচে নামানো হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জজকোর্টের উদ্দেশ্যে। ৭টা ৩৫ মিনিটে কালো নিশান গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-গ ১৪-৭৬৮) করে তিন নম্বর সড়ক দিয়ে এলিফ্যান্ট রোড, মৎসভবন হয়ে নেত্রীকে আদালত প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি অবস্থার কারণে রাস্তা ছিল ফাঁকা। ছিলো না, তেমন কোনো নেতাকর্মী। তবে আদালত প্রাঙ্গণে এরই মধ্যে এসে পৌঁছেছেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ডা. দীপু মনি, নগর আওয়ামী লীগের আইজনীবী কামরুল ইসলাম, শাহে আলম মুরাদ, ছাত্রলীগের মারুফা আক্তার পপি, গোলাম সারোয়ার কবির, ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পিসহ আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রিজন ভ্যান, অ্যাম্বুলেন্সসহ বহরে প্রায় ১৪-১৫টি গাড়ি ছিল। নেতাকর্মীরা জরুরি অবস্থা ভেঙে গাড়িগুলো ঘিরে ফেলেছে। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে রায় সাহেব বাজার পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চাপ ছিল চোখে পড়ার মত।

ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়ে নেত্রীকে আদালতে উঠানো হবে। এমন সময় আমরা ক’জন পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ঢুকে পড়ি। পুলিশ ক্ষুব্ধ হয়ে লাঠিপেটা করে। লাঠির আঘাত খেয়ে দুজন সরে গেছে। আমিও একটু পেছনে সরে যাই। সুযোগ বুঝে আবারও বেষ্টনির ভেতর ঢুকে পড়ে ঠিক নেত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। এভাবে আদালতের ভেতরে নেত্রীর সঙ্গে ঢুকে যাই। এদিকে বাইরে পুলিশ নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করছে। আমরা তখন আদালতের ভেতর, নেত্রীকে সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন্নাহারের আদালতে তোলা হয়েছে।

৮.৩৫ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি এবং শুনেছি। নেত্রী সেসময় আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে বলেন- ‘আমার আরগুমেন্ট এবং আমার আইনজীবীদের আবেদনের ভিত্তিতে আপনি কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। আপনার ইচ্ছা থাকলেও বিচারিক মাইন্ড এপ্লাই করে ন্যায়বিচারের স্বার্থে স্বাধীনভাবে আদেশ দিতে পারবেন না। আপনাকে সরকার যেভাবে আদেশ লিখে দিয়েছে, আপনি সেভাবেই করবেন। আপনার হাত পা বাঁধা। তারপরও আমার এ আবেদন মামলার মূল নথিতে অন্তর্ভূক্ত হওয়া দরকার। দয়া করে আমার এ কথাগুলো মামলার মূল নথিতে লিখে দেবেন। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে-সরকার আমার বিরুদ্ধে এ মামলার রায়ও লিখে রেখেছে। আমার বিরুদ্ধে করা এই মামলার বাদীকে আমি জীবনেও দেখিনি। তার নামও শুনিনি। আমাকে হয়রানির উদ্দেশে দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমাকে বাদ দিয়ে যেনতেন নীল নকশার নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য এটা করা হয়েছে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা আমাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে ওয়ারেন্ট আছে কি না, জানতে চাইলে তারা ওয়ারেন্ট দেখাতে পারেনি। আমি বিচারের মুখোমুখি হতে ভয় পাই না। জেল-জুলুম নির্যাতন এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। এ কারণেই আমি বিচারের মুখোমুখি হয়েছি। আমি মহান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। জনগণ আমার সঙ্গে আছে। আল্লাহ তা’য়ালা সহায় হলে কোনো চক্রান্ত সফল হবে না। আগেও আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলাম। এটাই ছিলো দেশের স্বর্ণযুগ। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে কখনও নিজে নীতি ও আদর্শচ্যুত হওয়ার ব্যাপারে কল্পনাও করতে পারিনি। চাঁদাবাজি তো দূরে কথা আমার শাসনামলে ১ শাতাংশ দুর্নীতিও হয়নি। বিদেশের মাটিতে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছি। যদি চাঁদাবাজ বা অর্থলোভী হতাম, তাহলে বিশ্বের সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করত না। এই ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়াও বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, যা দেশের মর্যাদাকে অনেক উঁচুতে উঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুই মেয়ে আমরা, রাষ্ট্র থেকে কিছুই নেইনি। বরং ত্যাগের ব্যাপারে উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। ফারাক্কা চুক্তি-শান্তি চুক্তির মাধ্যমে দেশের অনেক দিনের সমস্যা আমিই সমাধান করেছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভিন্ন ধরনের ইমেজ রয়েছে। চাঁদাবাজি করলে এগুলো অর্জন করতে পারতাম না। ৬২ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে অভ্যস্থ। মৃত্যু ভয়ও আমাকে সংগ্রাম থেকে পিছু হটাতে পারবে না। এই সরকার দেশটাকে ধ্বংসের কাছে নিয়ে এসেছে। দেশ ও জনগণের প্রতি দরদ ও দায়বোধ নেই। বিদ্যুৎ সমস্যা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ আজ দিশেহারা। আমি এ ব্যাপারে কথা বলাতে আমাকে হেনস্থা করতে এ মামলা দেয়া হয়েছে। আমি দুর্নীতি বা চাঁদাবজি করেছি, এ কথা দেশের একজন অন্ধ মানুষও বিশ্বাস করবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ নিয়ে এরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। ৬ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত ভোটার তালিকা তৈরির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। নির্বাচনের জন্য একটি তামাশার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। সরকার এখন মানুষের ভোটাধিকার লংঘন করে বন্দুকের নল দিয়ে মানুষের অধিকার হরণ করতে চায়।’

জবানবন্দীর শেষ পর্যায়ে নেত্রী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি জানি আপনি আমাকে ইচ্ছা থাকলেও জামিন দিতে পারবেন না। তবে, দয়া করে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাবেন না। সেখানে ৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি রয়েছে। এটাকে আমি নিজের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করি।’

আদালত সেদিন নেত্রীর জামিন নামঞ্জুর করেন। আমরা কর্মীরা আবেগে কেঁদে ফেলি। আবেগাপ্লুত নেতাকর্মীরা পুলিশ-র‌্যাবের ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনির মাঝেও স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে। ‘শেখ হাসিনার কিছু হলে-জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, নেত্রীবিহীন নির্বাচন-মানি না মানবো না, জেল-জুলুম হুলিয়া-নিতে হবে তুলিয়া, অবৈধ সরকার-মানি না মানবো না, ক্ষমতা না জনতা-জনতা জনতা’ এসব স্লোগানে প্রকম্পিত হয় আদালত প্রাঙ্গণ।

নেত্রীকে সেদিন আদালত থেকে বের করার সময় আমি তার গাড়িতে ঢুকে পড়ি। পুলিশ আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছে। সে সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি পুলিশের ভ্যানে। খণ্ড খণ্ড মিছিল হচ্ছে। মিছিল দেখে পুলিশ সদস্যরা বুঝে উঠার আগেই দৌড়ে পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে পড়লাম। পরে মিছিলের লোকজন আমাকে সুমনা ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে ডা. দীপু মনি, ফরিদুন্নাহার লাইলী, শাহিদা তারেক দীপ্তি, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, গোলাম সরওয়ার কবির ও মাহবুবুর রহমান পলাশরা আমাকে দেখতে যান। খোঁজখবর নেয়ার পর ডাক্তাররা তাদের বললো, তাকে এখানে রাখতে পারবেন না। পুলিশ ডিস্টার্ব করবে। আর উনারও এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পরে আমাকে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাসায় নেয়া হয়। সেখানে ডাক্তার আসত, চিকিৎসা দিত। ডাক্তার বলেছে, আঘাতজনিত কারণে বুকে চাপ বেশি ছিল। দীর্ঘদিন বুকে ব্যাথা থাকবে।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যারা জরুরি অবস্থার মধ্যেও সেখানে ছিল, তাদের ভিডিও ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হবে। তাছাড়া বিভিন্ন জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলাও হয়ে গেছে। অনেকে পলাতক। সবার মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কী হচ্ছে, কী হবে এই ভেবে অনেকে দিশেহারা। নেতাকর্মীরা ফোন দেয়, করণীয় জানতে চায়। অসুস্থ হয়েও বেডে থাকার জো নেই।

নেত্রীর গ্রেপ্তারের পর প্রথম মিছিল বের করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। শেখ সোহেল রানা টিপু ও সাজ্জাদ সাকিব বাদশার নেতৃত্বে এ মিছিল হয়। সেখানেই সাহসী স্লোগান ধরেন ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম।

আমরা সেদিন হাসপাতালের বেড ছেড়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন, মিছিল করেছি, করিয়েছি। সেদিন সাবজেলের সামনে ক্ষমতাসীনদের রক্ষচক্ষুর ভয় উপেক্ষা করে সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা অবিরাম অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। আন্দোলনের মাধ্যমে নেত্রীকে মুক্ত করে এনেছি আমরা। রূদ্ধ গণতন্ত্র মুক্ত হয়েছে।

সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ উপলক্ষে অনেক নেতাই মনোনয়নের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। নিজেদের সাচ্চা আওয়ামী লীগার ও তৃণমূলের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে জাহির করতে নানান কিছু করছেন। কিন্তু ক’জন দু:সময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীর খোঁজ নিচ্ছেন? নেত্রী তৃণমূল আর ত্যাগী নেতা-কর্মীদের ঠিকই মনে রাখেন, মূল্যায়ন করেন। আল্লাহ নেত্রীকে দীর্ঘজীবী করুন, আমীন।

মো. রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ

সাবেক সহ সভাপতি

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :