‘আমাদের রুচি দিনে দিনে নিচে নেমে যাচ্ছে’

এন এইচ সাজ্জাদ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৬ মে ২০১৭, ১০:০৪| আপডেট : ১৬ মে ২০১৭, ১০:০৮
অ- অ+
ছবিতে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ

বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণীর গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এটি খুবই অনৈতিক হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদ। তিনি বলেন, মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এখন আর ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীদের নাম বা ছবি ছাপে না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সংবেদনশীলতা এখনও তৈরি হয়নি। এ বিষয়েও একটি নীতিমালা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এই গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।

ঢাকাটাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হল।

ভিকটিমদের ছবি এইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন আপনি?

কোনভাবে কোন ক্ষতিগ্রস্ত, যৌন নিপীড়িত ব্যক্তির (রেপ ভিকটিম) ছবি কোন সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না। তবে হ্যাঁ, অপরাধীর ছবি সংবাদপত্রে ছাপানো যাবে, তবে সেটা অবশ্যই পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ হতে হবে। যদি কোন সংবাদপত্র, অনলাইন মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানুষকে আকৃষ্ট করে অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্য এসব কাজ করে থাকে তাহলে সেটি হবে অত্যন্ত গর্হিত, অসামাজিক ও অন্যায় কাজ। এইরকম কাজ সাংবাদিকতার নীতির সাথে কোনভাবে যায় না,তাছাড়া সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি গর্হিত কাজ। এইসব কাজ যদি কোন সাংবাদিক করে থাকে তাহলে সে সাংবাদিক নয় সে ব্যবসায়ী।

সম্প্রতি ভুক্তভোগির বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশের বিষয়টিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

ভিডিওর মাধ্যমে এই ঘটনার ব্যাখ্যা বা রগরগে বর্ণনা কোনোভাবেই কখনোই কাম্য নয়। যার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে আমাদের রুচি দিনে দিনে কত নিচে নেমে যাচ্ছে। আজকাল দেখছি কিছু কিছু সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজপোর্টাল এইসব গর্হিত কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অসামাজিক কাজ। সম্প্রতি শুনেছি, তাদের যখন থানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন তাদের কাছে খুব বাজেভাবে কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠেছে, তবে এইসব অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের রুচিবোধ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে।

এইসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সাংবাদিক, শিক্ষক, নাগরিক সমাজ কী ভূমিকা রাখতে পারে?

যারা প্রতিথযশা সাংবাদিক আছেন, তাদের এই ব্যাপারে শক্ত অবন্থান নিতে হবে, প্রচুর লেখালেখির মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, পাশাপাশি শিক্ষক ও সুশীল সমাজ ও সর্বোপরি সামাজিকভাবে তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে এইসব কাজকে বন্ধ করতে হবে। কোনো সংবাদপত্র বা মিডিয়া যদি এইসব কাজ করে থাকে তাহলে তাদের তীব্রভাবে সমালোচনা করতে হবে, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলার লক্ষ্যে সভা, সেমিনার করে জনগণকে এইসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে এবং সর্বোপরি একতাবদ্ধ হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এই আন্দোলনে দুই একজন সাংবাদিককে এগিয়ে আসলে হবে না, সকল সাংবাদিককে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু সাংবাদিক নয়, শিক্ষক, ছাত্র, রাজনীতিবিদ, কর্মচারী সবাইকে একসাথে সম্মিলিতভাবে এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবে এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভূমিকায় মুখ্য।

সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কিছু লিখলে,সেটা তাড়াতাড়ি মুছে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে হল না কেন?

তার কারণ এরা দুর্বল, এদের কাছে ক্ষমতা নেই। তাই তারা বার বার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রথমত, তারা ওইসব অপরাধীর দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, অন্যদিকে আবার তাদের এই অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে কেউ কেউ ব্যবসা করছে, হাসাহাসি করছে। যাও যৌন নিপীড়নের শামিল। ওই মেয়েগুলো দুর্বল হওয়াতে বার বার শোষণের শিকার হয়েছে। যা নিতান্তই বেদনাদায়ক ও মর্মস্পর্শী।

আসলে কী তারা প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবে?

আইনের চোখ বাধা, আইন তার চোখে কে রাজা কে প্রজা সেটা দেখে না। সবাই তার চোখে সমান। কিন্তু হ্যাঁ, সে মাঝে মাঝে নির্যাতিত নারীর কান্না শুনতে পায়। অনেকই আশঙ্কা করছেন,আদৌ তাদের বিচার হবে কিনা, কারণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে তারা খুব প্রভাবশালী।

মানু্ষ আশঙ্কা করে কেন?

তার কারণ এর আগে মানুষ বিচারহীনতার সমাজ দেখেছে, যা তাদের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে আদৌ কি ক্ষমতাবানদের কিছু হয়? তারা তো প্রভাব প্রতিপত্তি কাটিয়ে জেল হতে বের হয়ে আসবে। এইরকম আশঙ্কা কোন সুষ্ঠু সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তাই আইন সবার জন্য সমান এটা শুধু মুখে বললে হবে না। এটা কাজে প্রমাণ করে দেখাতে হবে।

ছেলেমেয়েরা কেন এইরকম অমানবিক কাজে দিন দিন নিজেদেরকে জড়াচ্ছে?

এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হওয়ার প্রধান কারণ যথোপযুক্ত সামাজিকীকরণের অভাব। কারণ, যেসব ছেলেমেয়েকে পিতা মাতা ছোট বেলা থেকে নৈতিক শিক্ষা দেয়, ন্যায় -অন্যায়ের মাঝে পার্থক্যটা কী সেটা শেখায়, সেসব ছেলেমেয়ে বড় হয়ে কোনদিন এইসব অসামাজিক কার্যকলাপ করতে পারে না। তারাই এইসব গর্হিত কাজের সাথে লিপ্ত থাকে যারা ছোটবেলা থেকে পিতামাতার কাছ থেকে ও স্কুলের শিক্ষক থেকে নৈতিক শিক্ষা পায় না।

এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি?

এইসব অসামাজিক ও গর্হিত কাজ থেকে সমাজকে বের করে নিয়ে আসতে হলে, সবার আগে প্রয়োজন পরিবারের যথোপযুক্ত সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের সাথে এইসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তাদের এইসব বিষয় সম্পর্কে বুঝানো, যাতে সে ওই পথে পা না বাড়ায়। এইসব সমস্যা সমাজে বৃদ্ধির জন্য অন্যতম প্রধান কারণ হল আজকের টিভি চ্যানেল ও নাটক, সিনেমা নির্মাতারা । তারা এমন কিছু নাটক, সিনেমা টিভি চ্যানেলে দেখায় যা থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখছে কিভাবে পরকীয়া করতে হয়, কীভাবে একটা মেয়েকে টিজ করতে হয়, নাটক, ছবিতে, যৌনতাকে উপজীব্য করে যে সব রগেরগে মুভি তৈরি করে, তা থেকে ছেলেমেয়েরা শিখছে এই বিষয়গুলো খুব মজার, তারা জানছে জগতে ভোগই সব। ফলে এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদের দেখতে হচ্ছে। তাই চলচ্চিত্র নিমার্তা ও টিভিচ্যানেল মালিকদের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা উচিত, আসলে তারা তাদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তরুণ তরুণীদের কী শেখাচ্ছেন।

সর্বোপরি এইবারের মামলায় পুলিশের ওপর কতটুকু আস্থা রাখছেন?

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এই কেইসটিকে (মামলা) একটি মডেল কেইস হিসেবে দেখছে। কারণ পুলিশের কার্যক্রম সম্পর্কে গণমানুষের মনে একধরনের অনাস্থা বা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে কেন পুলিশ দেরি করে কেইস নিল, তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পুলিশের গা ছাড়া ভাব জনমানুষেরর মনে অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে, আশা রাখি আমাদের পুলিশ বাহিনী এই মামলাটি আন্তরিকতার সাথে সমাধানে করে দোষীদের যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করার মাধ্যমে আবারও জনমানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবেন।

ঢাকাটাইমস/১৬মে/এনএস/ডব্লিউবি

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জাহাঙ্গীর টাওয়ারে আগুন: ভবনে ও রেস্টুরেন্টে অগ্নিনিরাপত্তা ছিল কিনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ ডিএনসিসি প্রশাসকের  
তিতুমীর কলেজের দুই হলে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক: আলী রীয়াজ
স্থানীয় নির্বাচন আগে দেওয়া মানে রাজনীতিবিদদের অবিশ্বাস করা: রিজভী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা