আনিসুলের সেই পরিবহন উদ্যোগে মন নেই কারও

আউয়াল খাঁন, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৮ আগস্ট ২০১৮, ০৮:১৬| আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০১৮, ১৭:০৬
অ- অ+
ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকার বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় এনে জনবান্ধব করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র আনিসুল হক, তার মৃত্যুর পর সেদিকে আর মন নেই কারও। না সরকার, না ডিএসসিসি কিংবা পরিবহন মালিক।

অথচ ‘বাস রুটস পুনর্বিন্যাস’ নামে আনিসুলের এই উদ্যোগে সম্মতি ছিল সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের। সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা।

রাজধানীবাসীও স্বপ্ন দেখছিল সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ নাগরিক পরিবহনের। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আনিসুল হক প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে কয়টি সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা হোক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বেদখল জায়গা উদ্ধার, সড়ক সম্প্রসারণ, দীর্ঘদিনের অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড অপসারণ- সব ক্ষেত্রেই তিনি তা করে দেখিয়েছেন। তাতে তার প্রতি মানুষের আস্থা জন্মেছিল- সড়কে পরিবহন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায়ও সফল হবেন তিনি।

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান কারণ যাত্রীর জন্য গণপরিবহনের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, বিদ্যমান ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা ও যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রীয় ওঠানো, সড়কে অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি (স্টিয়ারিং) ও চলাচলে অযোগ্য (ফিটনেস বিহীন) লক্কড়ঝক্কড় গণপরিবহনের রাজত্ব।

এই অস্বস্তিকর গণপরিবহন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি মেয়র আনিসুল ডাক দিয়েছিলেন আমূল পরিবর্তনের। ঢাকার সড়ককে নিরাপদ করতে ও যাত্রী ভোগান্তি কমাতে বিশেষ ব্যবস্থায় চার হাজার নতুন বাস নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি।

গত বছরের ১৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় মেয়র আনিসুলের প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়।

ওই সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, ঢাকায় রুটের সংখ্যা কমিয়ে ২২ করা হবে এবং ২৪৬টি কোম্পানিকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানি গঠন হবে। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রঙ হবে ভিন্ন। পুরনো বাসের বদলে ঢাকায় নামানো হবে চার হাজার নতুন বাস। এ পদ্ধতিতে একটি রুটে চলবে একটি কোম্পানির বাস। কোম্পানির অধীনে চলা সব বাস সমানভাবে মুনাফা পাবে। নির্ধারিত সময় অন্তর বাস আসবে। তাই যাত্রী পেতে রেষারেষি থাকবে না, সড়কে প্রতিযোগিতাও থাকবে না। মোড় 'দখল' করে যাত্রী তোলা কিংবা ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রণবতা দূর হলে যানজটও কমবে।

এ ছাড়া নাতুন বাস নামাতে মালিকপক্ষের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়ার দাবির সুরাহা করা, বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া নিশ্চিত করা, দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেয়া পরিকল্পনা ছিল মেয়রের।

এ লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও বাস মালিক পক্ষের সঙ্গে একাধিক দফায় আলোচানার আয়োজন করে কাজ এগিয়ে নিয়েছিলেন ডিএনসিসির এই প্রয়াত মেয়র।

কিন্তু রাজধানীবাসীর স্বপ্নের ফানুস উড়ার আগেই গত বছরের ৩০ নভেম্বরে প্রয়াত হন মেয়র আনিসুল হক। তার মৃত্যুতে থমকে যায় 'বাস রুট পুনর্বিন্যাস' নামের এ উদ্যোগ।

এরপর থেকে ঢাকার রাস্তা চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগের বিষয়ে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে চলছেন ডিএনসিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে ডিএনসিসি সূত্র জানায়- মেয়র আনিসুলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ডিএনসিসি নয়, বরং এখানে সরকারের উদ্যোগ এবং বাস মালিক সংগঠনের নেতাদের সদিচ্ছা প্রয়োজন।

মেয়র আনিসুল হকও তার দায়িত্বকালীন বরাবর বলেছেন, ‘ঢাকার সড়কে চার হাজার বাস নামানোর দায়িত্ব আমার (ডিএনসিসি) না। আমাদের এখতিয়ারে এটা নেই। কিন্তু যেহেতু নিরাপদ ঢাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সে জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার একটা চেষ্টা করছি। আমার পরিকল্পণা বাস্তবায়ন হলে সংশ্লিষ্টজনকে এই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিব।’

মেয়র আনিসুল বলেছিলেন, ‘পুরো ঢাকার বাসব্যবস্থা ছয়টি কোম্পানির অধীনে এনে প্রত্যেক মালিককে তার বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ দেয়া হবে। বেপরোয়া প্রতিযোগিতা এড়াতে কার গাড়িতে কতজন যাত্রী উঠল সেটা কোনো বিষয় নয় এখানে। একটার পর একটা বাস সময় মেনে চলবে। এতে সড়কে কেউ কারও আগে যাওয়ার চেষ্টা করবে না।’

মেয়র আনিসুল হকের এই গোছানো উদ্যোগে সে সময় সম্মতি জানিয়েও এখন তা বাস্তবায়নে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর। রাজধানীর পরিবহন নৈরাজ্য কিংবা বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে দিন দিন।

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা নতুন কোনো বিষয়, তা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া যানবাহনের চাপায় প্রাণহানি, অঙ্গহানি কিংবা পঙ্গুত্ববরণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই।

অতি সম্প্রতি (২৯ জুলাই) ঢাকার বিমানবন্দর সড়কের এমইএসে বেপরোয়া বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর নিহত হওয়ার ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ও শহরে স্কুল-কলেছের শিক্ষার্থীরা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ ব্যানারে রাস্তায় নেমে আসে। তারা নয় দফা দাবি নিয়ে টানা ছয় দিন অবস্থান করে সড়কে। এ সময় বিভিন্ন গাড়ি ও চালকের লাইসেন্সসহ কাগজপত্র পরীক্ষা করে তারা। এতে বেরিয়ে আসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই বেশির ভাগ গাড়ি চলাচল করছে রাজধানীর সড়কে। শিক্ষার্থীরা এসব গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করায় ট্রাফিক সার্জেন্টদের দিয়ে।

সরকার তাদের দাবি মেনে নিলে অবরোধ প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগ থমকে যাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, মেয়র আনিসুল হক বেঁচে থাকলে হয়তো এত দিনে জনগণ এই উদ্যোগের সুফল ভোগ করতে পারত।

এনায়েতউল্লাহ বলেন, ঢাকার রাস্তায় চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগের প্রতি বাস মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সমর্থন রয়েছে।

তবে মেয়র আনিসুল উদ্যোগ গ্রহণের এক বছর পেরিয়ে গেলেও রাজধানীবাসীর যাতায়াতে সুখবর নেই। যাত্রী ও পথচারীদের সঙ্গে আলাপকালে তাদের মধ্যে দেখা গেছে হতাশার দীর্ঘশ্বাস- মেয়র আনিসুলই নেই, আর করবে কে! তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো হয়তো।

এ বিষয়ে পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আসলে মেয়র সাহেব মারা যাওয়ার পরপরই এর অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তিনিই মুলত এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেবের সাথে সিটি করপোরেশন ও আমাদের এক বৈঠকে তিনি ডিটিসিএকে (বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি) যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব দেন।’

ডিটিসিএকে দায়িত্ব দেয়ার পরও কোনো অগ্রগতি না হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে বাস মালিক সমিতির এই নেতা জানান, এ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই।

তবে প্রয়াত মেয়র আনিসুলের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা শুনেছেন বলে জানান এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু শুনতে পেরেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাকি পুনরায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বলেছেন। যদি তা-ই হয় তাহলে আমরা বাস মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একে সাধুবাদ জানাই।’

(ঢাকাটাইমস/৮আগস্ট/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
৪৩ হাজার পৃষ্ঠার নথিতেও এনসিপি টেকেনি ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে
চট্রগ্রামে কোস্ট গার্ড ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে ট্র্যাফিক প্রশিক্ষণ কর্মশালা
নারীর শরীরে লুকানো ছিল ৩৭ হাজার ইয়াবা!
এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল বিকাশ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা