গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স

মুক্তিযোদ্ধাদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট!

এম গোলাম মোস্তফা, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:২৮

রাজধানীর গুলিস্তানে এক কাঠা জমির দাম কোটি টাকার ওপরে। তারই কেন্দ্রবিন্দুতে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স। ভবন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমপ্লেক্সটির পজেশনের দাম অন্তত হাজার কোটি টাকা। অথচ অসম চুক্তির ফাঁদে পড়ে দোকান বিক্রির টাকা থেকে কানাকড়িও পায়নি জমির মালিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। সব হাতিয়ে নিয়েছে ভবননির্মাতা প্রতিষ্ঠান। নামমাত্র জমিদারি ভাড়া পাচ্ছে ট্রাস্ট।

নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গুলিস্তানের মতো এলাকায় প্রতি ফ্লোরের প্রতি বর্গফুটের দাম কম করে হলেও ২০ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী তো হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হয়েছেন।’

এদিকে কমপ্লেক্সের নবম তলার সব পজেশন জবরদখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এখন আবার দশম তলায় নতুন করে অবৈধ দখলের পালা শুরু হয়েছে। তবে প্রশাসন দাবি করছে, এখানকার পজেশন কাউকে দখল করতে দেওয়া হবে না। অবৈধ দখলদারদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সে অবৈধ দখলের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে কল্যাণ ট্রাস্টের চুক্তি হয়। যার মাধ্যমে গুলিস্তান সিনেমা হল ভেঙে শপিং কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। হলে মোট জমি ছিল শূন্য দশমিক ছয় হাজার ১৪০ একর। এই হিসেবে ভবনের প্রতিটি তলায় ১৯ হাজার বর্গফুট জায়গা থাকার কথা। চুক্তির দিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে তা কল্যাণ ট্রাস্টকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।

পরে দুই ধাপে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী ২০০৬ সালের পরিবর্তে ২০০৭ সালের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক এ এস এম আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। তিনি পালিয়ে যান। এর আগেই নির্মিত ৮৮৩টি দোকানের মধ্যে ৫৪০টির পজেশন বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এরপর আর ভবন নির্মাণের কাজ এগোয়নি।

অথচ চুক্তি অনুযায়ী, এখানে বিশ তলা ভবন হবে। যেখানে অফিস ও বাণিজ্যিক স্পেস থাকবে। বসবে কেন্দ্রীয় শীততাপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। হবে শপিং কমপ্লেক্স। আরও থাকবে দুটি সিনেপ্লেক্স। কিন্তু এমন উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি এক যুগেও। বরং গত এক দশকে বিক্রির বাইরে থাকা কমপ্লেক্সের আট তলা পর্যন্ত ৩৪৩টি দোকানও জবরদখল হয়ে গেছে। এর সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত বলে জানা গেছে। তারা ‘কায়দা’ করে ট্রাস্টের কাছ থেকে এগুলোর বৈধতাও নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অসম চুক্তির কারণে মুক্তিযোদ্ধারা ঠকেছেন, মন্তব্য করে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সরকারের একটি অসম চুক্তির কারণে তারা এর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নিয়ম হলো, কোনো চুক্তি করার আগে তার ফিন্যান্সিয়াল সমীক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু এই চুক্তি করার আগে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি, করলেই কোনটা করণীয় কোনটা করণীয় নয় সেটা বের হয়ে আসত। আর তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের এত বড় ক্ষতি হতো না।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের নবম তলা পর্যন্ত পুরো প্রস্তুত। এসব ফ্লোরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমও চলছে। এখানে রয়েছে দোকান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় গড়ে উঠেছে। আট তলা পর্যন্ত পজেশন বিক্রেতা সেই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক পালিয়ে গেলেও ক্রেতাদের বৈধতা দিয়েছে কল্যাণ ট্রাস্ট। আর নবম তলার বরাদ্দ না থাকলেও প্রভাবশালীরা পজেশন দখল করে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে। এখন দশম তলায়ও দখলদারদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। তারা ইট-বালু-সিমেন্ট দিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এই কাজ দিনে নয়, হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। আবার এমন কৌশলে ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে, যাতে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে এখানে কাজ চলছে। কমপ্লেক্স প্রহরায় রয়েছে আনসার। দশম তলার এই দখলদারদের সহযোগিতা করার অভিযোগে আনসার কমান্ডার দেলোয়ার হোসেনকে সদর দপ্তরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

তিনি অবশ্য ঢাকা টাইমসের কাছে দাবি করেছেন, ‘আমি কাউকে কোনো সহযোগিতা করিনি। প্রভাবশালীদের ঠেকিয়ে রাখার মতো শক্তি আমার ছিল না। তাই ইট-বালু তুলতে দিয়েছি। আমার আসলে কিছু করার ছিল না।’

দশম তলার অবৈধ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের উপব্যবস্থাপক (গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠান প্রধান) জামাল হোসেন লস্কর ঢাকা টাইমসের কাছে দাবি করেন, ‘বহিরাগতদের দখলদারি বন্ধ করে দিয়েছি। যারা ইট-বালু উঠাইছিল, তারা আমার কাছেও এসেছিল। আগে বৈধ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ নেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি বরাদ্দ পান, তখন কাজ করবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে যা-ই হয়ে থাকুক, এখন বৈধ বরাদ্দ ছাড়া কেউ আর এখানে কিছু করতে পারবে না। কেউ দখল করতে চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে পড়ে থাকা ফ্লোর দখলের জন্য কেউ কেউ ভবননির্মাতা আলাউদ্দিনের কাছ থেকে বরাদ্দ নেওয়ার নকল কাগজ দেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি মান্নান মিয়া নামের এক দোকানমালিকের বিরুদ্ধে। নবম ও দশম তলায় ১২টি দোকান বরাদ্দ নেওয়ার দাবি করছেন তিনি। অথচ এ দুই ফ্লোরে কোনো দোকানই বরাদ্দ হয়নি। এ বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘দোকানগুলো আমি আইনগতভাবেই ডেভেলপার কোম্পানি থেকে বরাদ্দ নিয়েছি। কল্যাণ ট্রাস্টও আমাকে বৈধতা দিয়েছে। দশম তলার অন্যরা অবৈধ। আমি একমাত্র বৈধ মালিক।’

তবে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন, মান্নান মিয়ার কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য হেড অফিসে পাঠানো হবে। যদি এগুলো ঠিক থাকে, তবে তিনি বরাদ্দ পাবেন। মান্নানের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে। এ বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান জামাল হোসেন লস্কর।

অবৈধ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি দিল মোহাম্মদ খোকা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডেভেলপার যাদের কাছে পজেশন বিক্রি করেছিল, তার মধ্যে আসলে নবম তলা ও দশম তলার কিছু বরাদ্দও বৈধ। তবে ট্রাস্ট যেটা ভালো মনে করবে, সেটাই এখন গ্রহণযোগ্য হবে। কারণ এই সম্পত্তির আসল মালিক কল্যাণ ট্রাস্ট।’

ঢাকা টাইমস/৩০জানুয়ারি/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :