আবারও বিশ্বের এক নম্বর এনজিও ব্র্যাক

টানা চতুর্থবারের মতো বিশ্বের এক নম্বর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছে ব্র্যাক। আমি জানি না বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো খাতে বিশ্বসেরা হয়েছে কি না! তাই ব্র্যাকের এই অর্জনকে আমার মনে হয় বাংলাদেশের অর্জন।
দেশের সবচেয়ে সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এক যুগ কাজ করেছি দৈনিক প্রথম আলোয়। এরপর যোগ দিলাম ব্র্যাকে, যেটি শুধু বাংলাদেশ নয়- পৃথিবীর সেরা। বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠান নিজ দেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ভাবতেই ভালো লাগে।
ব্র্যাকে আমার দেড় বছর হলো। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন সংস্থা কেন পৃথিবী সেরা? আমি বলব- প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। সাংবাদিক হিসেবে এ দেশের বহু মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে আমার।
অনেক প্রতিষ্ঠানও দেখেছি। আমার বেশির ভাগ সময় মনে হয়েছে, কী সরকারে কী সরকারের বাইরে- এ দেশে অনেক বড় বড় মানুষ হয়তো আছেন। তারা অনেকেই অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিপরিচয় ছাড়িয়ে তারা প্রতিষ্ঠানকে গড়েননি।
কিন্তু স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাককে ব্যক্তিগত নয়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্ত বলেই নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ব্র্যাক আজ পৃথিবীর মানচিত্রে। কিন্তু ব্র্যাকের শুরুটা হলো কীভাবে?
আমাকে যেটি মুগ্ধ করেছে, সেটি হলো- মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্র্যাকের জন্ম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ তখন শেল কোম্পানির বড় কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে চলাফেরার জন্য তাকে বাঘের ছাপওয়ালা পরিচয়পত্র দেয়া হলো।
তিনি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী লোকজন তখন লড়াইয়ে। দরকার অস্ত্র। তহবিল। সারা দুনিয়ার সমর্থন। ফজলে হাসান আবেদ ঠিক করলেন তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে সারা দুনিয়াকে জানাবেন গণহত্যার কথা। তহবিল গড়বেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তার কাছে তখন ব্রিটিশ পাসেপোর্ট ছিল। আর ব্রিটেনে লেখাপড়ার কারণে সেখানে তার অনেক বন্ধু রয়েছে।
ব্রিটিশ পাসপোর্টে তিনি পাকিস্তানের শেল অফিসে গেলেন। উদ্দেশ্য সেখান থেকে লন্ডনের ফ্লাইট ধরবেন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকজন তাকে বাঙালি সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে নিয়ে যায়।
এর পর? তাকে কী হত্যা করা হবে? পরিস্থিতি ভয়ানক বুঝে আবেদ ভাইয়ের এক বন্ধু বিষয়টি জানালেন ব্রিটিশ হাইকমিশনে। তাদের বললেন, তোমাদের একজন নাগরিককে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটকে রেখেছে।
এর পর ব্রিটিশ হাইকমিশন তখন তৎপর হলো। এর দুদিন পর আবেদ ভাইকে ছাড়া হলো। পাকিস্তান থেকে তখন কাউকে ব্রিটেনে যেতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হতো।
আবেদ ভাই সেই অনুমতির অপেক্ষা না করে আফগাানিস্তান চলে গেলেন। সেখান থেকে টেলিগ্রাম করে লন্ডনে থেকে টিকিট আনালেন। এর পর ইস্তানবুল হয়ে গেলেন লন্ডনে।
সেখানে বিদেশি ও বাংলাদেশি বন্ধুদের মিলে শুরু করলেন অ্যাকশন বাংলাদেশ। শুরু হলো বাংলাদেশের জন্য প্রচার ও তহবিল সংগ্রহ। আর বিদেশি সব গণমাধ্যমে জানালেন বাংলাদেশের গণহত্যার কথা।
এই যে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই তা আর কখনও থামাননি আবেদ ভাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিরতরে চলে এলেন বাংলাদেশে।
সিলেটের শাল্লার গ্রামে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করবেন বলে গড়ে তুললেন বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি। সংক্ষেপে ব্র্যাক।
কবি সুফিয়া কামাল ব্র্যাকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হলেন। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকেই যুক্ত হলেন তাতে।
প্রতিষ্ঠান তো হলো; কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? লন্ডনে নিজের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিলেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে শুরু হলো ব্র্যাকের কাজ। সেই যে শুরু হলো, আজ সেই প্রতিষ্ঠানের বয়স ৪৭ বছর। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা আজ ব্র্যাক।
লোকজন কমবেশি ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণের কথা জানে, অনেকে সমালোচনাও করেন। শহরের লোকজন শুধু জানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ব্র্যাক ব্যাংকের কথা।
কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্র্যাকের নানা কর্মসূচির কথা অনেকেই জানেন না। বিশেষ করে আজকের তরুণ প্রজন্ম।
আপনারা কী জানেন বাংলাদেশের শিশুদের আশির দশকে টীকা দেয়ার কাজটি শুরু করেছিল ব্র্যাক? জানেন কীভাবে ডায়রিয়ায় মৃত্যু বন্ধ হয়েছিল?
আমি ব্র্যাকের অতীত ইতিহাস পড়ি আর মুগ্ধ হয়ে ভাবী- একটা প্রতিষ্ঠান কী করে এত কাজ শুরুর সাহস করল। ১৯৬৮ সালে খাবার স্যালাইন তৈরি হলেও দেশের মানুষ জানত না।
ফলে ডায়রিয়ায় প্রচুর লোক মারা যেত। বাড়ি বাড়ি খাবার স্যালাইন নিয়ে গেল ব্র্যাক। সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে একজন নারীকে লবণ-গুড়ের স্যালাইন বানানো শেখাতে ব্র্যাকের সময় লেগেছিল ১০ বছর। ফল ডায়রিয়ায় মানুষের মৃত্যু কমে এলো।
বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু কমাতে এবং শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য টীকা প্রদানের যে কর্মসূচি তাতে ব্র্যাকের ভূমিকা বিশাল।
১৯৮০ সালে ব্র্যাক সরকারকে টীকা শুরুর প্রস্তাব দিলেও সরকার ১৯৮৬ সালে পুরোদমে কাজটি শুরু করতে রাজি হলো। ভাবতে ভালো লাগে একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকার কতটা আস্থায় নিলে বলতে পারে বাংলাদেশের চার বিভাগের মধ্যে দুটিতে কাজ করবে ব্র্যাক। বাকি দুটিতে সরকার।
অবাক করা বিষয় হলো- যে দুই বিভাগে ব্র্যাক কাজ করেছিল, সেখানে ৮০ শতাংশ শিশুর টিকাদান সম্পন্ন হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃতি দিল ব্র্যাককে। দেশজুড়ে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে এই টীকা কার্যক্রমের ভূমিকা বিশাল।
ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর কাজটিও মুগ্ধকর।
আড়ং থেকে শুরু করে ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মসূচিই সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে ব্র্যাকের নেতৃত্বদান সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত। বর্তমানে ব্র্যাকের ১৭টি কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে অভিবাসীদের সব রকম সেবা দেয়ার কাজটি করি আমরা।
বাংলাদেশ ছাড়াও আরও ১১ দেশে কাজ করছে ব্র্যাক। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে কার্যালয় আছে ব্র্যাকের।
আফ্রিকার দেশগুলোতে যদি আপনি বাংলাদেশ বলেন তা হলে তারা বলবে শান্তি মিশন নাকি ব্র্যাক? ভাবতে দারুণ লাগে আফ্রিকার কোনো এক দেশে সড়কের নাম ব্র্যাক।
চারটা মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করে ব্র্যাক। সততা ও নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব, সর্বজনীনতা এবং কার্যকারিতা।
আমি মনে করি এসব কারণেই ১৯৭২ সালের ব্র্যাক আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি লোককে ব্র্যাক তার উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে এসেছে।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বর্তমানে ব্র্যাকের এক লাখ কর্মী ১১ দেশসহ আরও ১৪ কোটি মানুষের জীবন-সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
আর যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম বাংলাদেশে বড় মানুষ অনেক আছে, কিন্তু সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান খুব কম আছে। ব্র্যাককে আমার মনে হয়েছে সত্যিকারের একটি প্রতিষ্ঠান। আর আবেদ ভাইকে আমার মনে হয়েছে, সত্যিকারের বড় মানুষ যিনি প্রচণ্ড বিনয়ী।
ব্র্যাক একটা বৈষম্যমুক্ত মানবিক পৃথিবী চায়, যেখানে প্রতিটা মানুষ তার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবেন। জানি প্রকৃতির নিয়মে আমরা হয়তো একদিন থাকব না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি ব্র্যাক বেঁচে থাকবে শতবছর। আর এভাবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এভাবেই আসবে রোদ ঝলমলে সকাল।
(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

মন্তব্য করুন