তুবার কান্না আমাকে শরাহত করে!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
  প্রকাশিত : ২৩ জুলাই ২০১৯, ২১:৩৫
অ- অ+

তুবা এখনো ঠিক জানে না, তার মা তাকে রেখে কোথায় গেছেন! সে শুধু জানে যে তার মা নিচে গেছেন তার জন্য নতুন ড্রেস আনবেন বলে। তুবার অপাপবিদ্ধ মুখ, মায়াবি চোখ, আর সেই চোখে অবিরল কান্না আমাকে ব্যথিত করে, আমি শরাহত হই। মানুষ হিসেবে নিজেকে বড্ড খাটো মনে হয়! ভেবে পাই না, কী করে মানুষের মতোন দেখতে কিছু পশু তুবার মাকে কোনো রকম উস্কানি ছাড়াই দিনেদুপুরে এভাবে মেরে ফেলল!

দেশে এখন এত এত টিভি-মিডিয়া, প্রচুর সংবাদকর্মী রয়েছেন, ফলে কোনো খবরই এখন আর চাপা থাকে না। নিমিষে চাউর হয়ে যায় দেশে এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বো। তাই না চাইলেও বারবার তুবার ব্যথাতুর মুখটা আমাকে দেখতে হয়। আমি নিশ্চিত জানি, মিডিয়াকর্মীদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেচারা তুবা এখন ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু সে কি জানে, তার মায়ের হন্তারক আমাদের মতোই দেখতে একজন ছিল। তাকেও লোকে ‘মানুষ’ বলে, বা বলতো।

আহা, অমন একটি মেয়ে তো আমারও থাকতে পারতো! বড্ড সংকীর্ণ চিন্তা, স্বার্থপরতা বলবেন কেউ কেউ। এর নাম ‘এমপ্যাথি’। অন্যের কষ্টকে নিজের করে ভাববার মতোন সরল অন্তঃকরণ এখন কি আর আমাদের আছে! কী বলে সান্ত্বনা দেবো আমরা ছোট্ট তুবাকে! আছে কি ওর শিশুমনকে প্রবোধ দেবার মতোন কোনো ভাষা! না, নেই। তুবা কাঁদছে। ওর মায়ের কবরের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর হয়তো অভিশাপ দিচ্ছে এই মানুষ নামের পশ্বধম প্রাণীগুলোকে।

শুরু থেকেই ভাগ্যবিড়ম্বিত ছিলেন তুবার মা রেনু বেগম। অথচ এমনটি হবার কোনো কথা ছিল না। তিনি উচ্চশিক্ষিত একজন নারী। বিশ^বিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙানোর পরে তার বিয়ে হয়। শুরুতে সব ঠিকঠাকই চলছিল। প্রথম সন্তান জন্মাবার পরে তার স্বামীর মতিভ্রম হয়। সে আটকে যায় বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জালে। শুরু হয় রেনুর প্রতি তার স্বামীর অকারণ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অকথ্য দুর্ব্যবহার। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর রেনু আর সেখানে টিকতে পারেননি। কারণ তার আত্মসম্মানবোধ থাকে সেখানে থাকতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি ফিরে আসেন মা ও ভাইয়ের সংসারে। সেখানেও যে নিকটাত্মীয়রা তাকে খুব সুখে রেখেছিল, এমনও নয়। তাও মানিয়ে নিয়েছিলেন রেনু বেগম। জীবনের জন্যে, সময়ের প্রয়োজনে।

দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি জীবন সংগ্রামে শামিল হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই দুর্বৃত্ত নিষ্ঠুর সমাজ তাকে টিকতে দেয়নি। তিনি কিছু মানুষের নির্মমতায় অকালে হারিয়ে গেলেন। কিন্তু কেন! এর পেছনে কারণ বা মনস্তত্ব কী! উত্তর বাড্ডার হৃদয় নামের সেই হৃদয়হীন যুবক ও তার নিষ্ঠুর সাঙ্গপাঙ্গরা কেন এমনটি করলো! তুবার মাকে দেখেই অমনি তাকে ‘ছেলেধরা’ বলে ভাববার স্বাধীনতা তাদের কে দিয়েছিল! এটা কি স্রেফ ভুল ধারণা, নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো অশুভ চক্রান্ত!

কেউ কেউ বলবেন, দেশে এখন আর আইনের শাসন নেই, বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা উঠে গেছে। কিন্তু তাই বলে আইন নিজের হাতে তুলে নেবে! কাউকে যদি মন্দ লোক বলে সন্দেহ হয়েও থাকে, তার জন্য আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। টোল ফ্রি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করা যায়। হৃদয় বা তার সহযোগীরা কেনই বা সেখানে আগে থেকে মজুদ ছিল! তুবার মা রেনু বেগম কী এমন সন্দেহজনক আচরণ করেছিলেন যে তাকে এভাবে পিটিয়ে মারতে হবে!

একজন লেখক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে ঘটনাটাকে আমি কিন্তু অত সহজভাবে নিচ্ছি না। এই ঘটনার পেছনে নিশ্চিত কিছু দুরভিসন্ধি ছিল। নইলে একজন নেতিয়েপড়া ভদ্রমহিলাকে ওরা উপর্যুপরি পেটাতে পারলো কী করে! কেবল লাঠি নয়, নির্যাতনের কাজে লোহার রড ব্যবহৃত হয়েছিল। ওরা তার বুকের উপর উঠে লাফিয়েছিল পর্যন্ত। গলায় পা দিয়ে জোরসে ঠুসেছিল। অর্থাৎ তার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া অব্দি তারা থামবে না বলেই পণ করেছিল।

এ-কথা সত্যি যে, কিছু কিছু অতি স্পর্শকাতর মোকদ্দমার ক্ষেত্রে আমরা অপরাধীর যাচিত শাস্তি পাই না বা যতটা দ্রুত সময়ে বিচার প্রত্যাশা করি, বাস্তবে তা হয় না। বলা হয়ে থাকে, জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইড। গ্রহণযোগ্য সময়ে বিচারকার্য সমাধা না হলে তাকে বিচার না-পাবার শামিল বলে মনে করা হয়। সেটি একটি সিস্টেমের ঘাটতি হতে পারে, কিন্তু সেই রোষে তো সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নেবার অধিকার কারো জন্মায় না।

আগুন সন্ত্রাসের মতোন এবার নতুন এক সন্ত্রাস চেপে বসেছে সমাজের বুকে। তা হলো আবেগ-সন্ত্রাস। যে আবেগ মানুষ ও সমাজের জন্যে হানিকর, কোনোভাবেই তাকে প্রশ্রয় দেয়া চলে না। স্রেফ সন্দেহ বা অনুমানের বশে কারো গায়ে হাত তোলা যায় না। নিতান্ত অসভ্য যারা তারাও এতোটা নিচে নামবে বলে মনে হয় না। উন্নত দেশে ‘ভারবাল অ্যাবিউজ’ বা গালিগালাজ করলেও তাতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। আর আমরা উন্নয়নের জলোচ্ছ্বাসে ভাসলেও এইটুকু বোধশক্তি এখনো অর্জন করতে পারিনি যে, যাকে তাকে সন্দেহ হলেই অমনি তাকে প্রাণে মেরে ফেলা যায় না। এটা ঘোরতর অন্যায়। এটা অপরাধ। এজন্য তাকে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট ভোগ করতে হয়।

হৃদয় ও তার সঙ্গীরা হয় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, মাদকাসক্ত নয়তো চরম মানসিক রোগে আচ্ছন্ন। অস্ট্রিয়ান ডক্টর সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সূত্র অনুসারে একে বলা যায় স্যাডিজম। মানুষ মেরে ওরা একরকম বিকৃত আনন্দ লাভ করে। বিকৃত সুখ। কিন্তু এর দায় কার! কে নেবে তুবার মায়ের মৃত্যুর দায়! সমাজ, নাকি রাষ্ট্র! যে দেশে দিনেদুপুরে কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ মেরে ফেলা হয়, তাকে আর যাই হোক আমি উন্নত বা সভ্য রাষ্ট্র বলতে রাজি নই। বরং আমি আতঙ্কিত, খুব শিগগিরই হয়তো আমাদের এমন দিন দেখতে হবে যেদিন আমরা ঘরের বাইরে যেতেও ভয় পাবো। মা বা নানিও তার নাবালক শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরোবে না।

ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ কতটা নিষ্ঠুর, অমানবিক আর উন্মত্ত হলে ধারালো রামদা দিয়ে কুপিয়ে একটা ছেলেকে মেরে ফেলতে পারে! ভেবে শিউরে উঠি, মানুষ হিসেবে আমরা কতটা জান্তব হলে মাত্র দুই বছরের শিশু বা নিরানব্বই বছরের বৃদ্ধার উপরেও অজাচার চরিতার্থ করতে তৎপর হই। এই পরিস্থিতি থেকে কি তাহলে আর কোনো পরিত্রাণ নেই। আছে। থাকতেই হবে। সবার আগে আমাদের মানুষ হতে হবে। অপরাধের শাস্তি হতে হবে। অপরাধীকে পলিটিক্যাল শেল্টার দেয়া যাবে না। আমরা জানি, অপরাধের বিচার তখনই থিতিয়ে যায়, যখন তার পেছনে একটি অদৃশ্য হাতের ইশারা কাজ করে। অথচ বিশেষ বিবেচনায় আজ যাকে রেহাই দিচ্ছেন বা ধরছেন না, কালই সে হয়তো আপনার ঘাড়েই তরবারি ধরবে। তাই জনসচেতনতার পাশাপাশি আইন-আদালত এদের প্রতি কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এই প্রত্যাশা করি। আমরা আর কোনো নিটোল নিষ্পাপ তুবার কান্না শুনতে চাই না। আমরা নিরুদ্বেগ বাঁচতে চাই।

লেখক: কলামিস্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নির্বাচনকে ব্যাহত করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি পরিকল্পিত: বিএনপি
কক্সবাজারের যৌথ অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১ জন আটক
গোপালগঞ্জে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকারের তদন্ত কমিটি গঠন
অর্ধশত মোবাইল ফোন উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দিল মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা