পাহাড়-ঝরনা আর সবুজ প্রকৃতির মেলবন্ধন

মো. ইউনুছ আলী আলাল
  প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৫০
অ- অ+

শিলং-চেরাপুঞ্জি সেজেছে উঁচু পাহাড়, ঝরনা আর সবুজ প্রকৃতির অপরূপ মেলবন্ধনে। এটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি রাজ্য। সেখানে রোদ, বৃষ্টি ও মেঘের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন অনায়াসে। আকাশের ঘন নীলের ফাঁকে উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পেরোলেই মেঘালয় রাজ্য। আপনার যদি সিলেট ভ্রমণ শেষ হয়ে থাকে, তাহলে প্রস্তুতি নিয়ে চলে যেতে পারেন সেখানে। সবচেয়ে ভালো হয় চারজন সঙ্গী হলে। শিলং-চেরাপুঞ্জি মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। বাংলাদেশের তামাবিল সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত শিলংয়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার ফুট। পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, আর পাহাড়ি লেক মিলে শিলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এছাড়া খাসিয়া ও স্থানীয়দের জীবনযাপন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শিলংকে দিয়েছে বাড়তি রূপ। শিলংকে একসময় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলা হতো। সে কারণে একসময় বিলেত থেকে প্রচুর পর্যটক শিলংয়ে অবকাশ যাপন করতে আসতেন।

শিলং-চেরাপুঞ্জিতে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। প্রথমেই আসতে পারেন ওয়ার্ড লেক। এই লেকের চারপাশে আছে নানা প্রজাতির ফুলসহ গাছগাছালি। চাইলে লেকে নৌকায় বেড়ানো যাবে। পা-চালিত নৌকা ভাড়া নেয়া যাবে ঘণ্টা হিসেবে। লেডি হায়দারি নামে শহরের মাঝখানে আরও একটি পার্ক আছে। নানা প্রজাতির উদ্ভিদ দিয়ে সাজানো এই পার্কটিও সুন্দর। হেরিটেজ, উইলিয়ামসন, ডনভসকো নামে জাদুঘর আছে। এছাড়া বিমানবাহিনীরও জাদুঘর আছে। সময় থাকলে জাদুঘরগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। শিলং শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দুটি বাড়ি এখনও আছে। এছাড়া শিলং শহরের মধ্যেই আছে মদিনা মসজিদ। নান্দনিক নির্মাণশৈলীর এই মসজিদ ঘুরে দেখতে পারেন। এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মসজিদ।

শিলং শহর থেকে একটু বের হলেই আছে বিশপ অ্যান্ড ব্যাডন ঝরনার ভিউ পয়েন্টে। এই পয়েন্ট থেকে দূরে পাহাড় দেখা যায়, আর সেই পাহাড়ের মাঝ দিয়েই ঝরনার পানি পড়ছে। আর ওই পাহাড়ের চূড়াতেই গড়ে উঠেছে শহর। দূর থেকে অপরূপ দেখতে! শিলং শহর থেকে কিছুটা দূরেই আছে উমিয়ামবরা পানিলেক। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এই লেক ওপর থেকে দেখতে দারুণ। এই লেক ঘিরে মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেড গড়ে তুলেছে ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স। নানা প্রজাতির ফুলগাছ দিয়ে সাজানো এটি। শিশুদের জন্য আছে খেলাধুলার ব্যবস্থা। অর্চিড নামে রিসোর্টও আছে। সব মিলিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য এ কমপ্লেক্স নানাভাবে সাজানো।

শিলং পিকটি শিলং শহরের কাছেই। এই পিক থেকে পাখির চোখে দেখা যায় শিলং শহর। এখান থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে এলিফ্যান্ট ফলস বা হাতি ঝরনা। এই ঝরনার পানি প্রবাহিত হয় তিনটি স্তরে। দূর থেকে দেখতে অনেকটা হাতির শুঁড়ের মতো বাঁকানো মনে হয়। সে জন্যই হয়তো এর নাম হাতি ঝরনা। এসব ছাড়াও শিলং শহর ও এর আশপাশে বেড়াতে পারেন। এখানকার সবকিছুই ভালোলাগার মতো।

শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে রওনা হলে প্রথমেই পড়বে মকডক সেতু। দুই পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত এ সেতু। আর চারপাশে উঁচু-উঁচু সবুজ পাহাড়। সে পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ উড়ছে। যেন ইচ্ছে হলেই সে মেঘ ধরা যায়। দৃশ্যগুলো সত্যিই চোখ জুড়ানোর মতো! তারপর আসতে পারেন মজমাইনং থাইমা ইকো-পার্কে। ২০০৪ সালে উদ্বোধন হয় পার্কটি। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এ পার্কটি মূলত সেভেন সিস্টার ঝরনারই পাহাড়। পাহাড়ের মাঝ দিয়েই সেভেন সিস্টার ঝরনার পানি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। সেজন্য এ ঝরনা দেখতে হয় অন্য পাহাড় থেকে। তবে পার্কের কোনায় দাঁড়িয়ে আশপাশের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা তুলোর মতো সাদা মেঘ, আর নিচে দুই পাহাড়ের মাঝের ভাঁজ দেখতে অন্য রকম।

সবচেয়ে ভয়ংকর মজমাই গুহা। প্রায় গোলাকার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এ গুহাটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। গুহাটির কোথাও চিকন, কোথাও মোটা। অ্যাডভেঞ্চারময় এই গুহার এক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে বের হতে হয় অন্য মুখ দিয়ে। গুহার পরেই আছে সেভেন সিস্টার ঝরনার ভিউ পয়েন্ট। এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সাত ঝরনা। এক পাহাড়ে পাশাপাশি সাত ঝরনা সত্যিই দারুণ! এর চারপাশের সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘের মেলবন্ধন যেন মায়াময় দ্বীপেরই হাতছানি দেয়।

সেভেন সিস্টারের পর দেখতে পারেন টপভিউ। ভিউতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। এখানে একটি খাঁড়া পাহাড় আছে, যা অন্য পাহাড়গুলো থেকে আলাদা। এরপর থ্যাংখ্যারং পার্কেও বেড়িয়ে আসতে পারেন। বন বিভাগের এই পার্কে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এখান থেকেও বাংলাদেশ দেখার সুযোগ রয়েছে। এ পার্ক থেকেও দূরে একটি ঝরনা দেখা যায়।

শিলং-চেরাপুঞ্জির অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো নোহকালিকাই ঝরনা। ১১৭০ ফুট উচ্চতার এ ঝরনা ভারতের বৃহত্তম ঝরনাগুলোর অন্যতম। খাঁড়া পাহাড় থেকে সোজাসুজি পড়ছে এ ঝরনার পানি। তাই পানি পড়ার স্থানটি দেখতে নীল রঙের পুকুরের মতো।

তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি। ডাউকির আশপাশটায় আছে চমৎকার সব দর্শনীয় স্থান। এর অন্যতম ডাউকি ব্রিজ। এটি দেখার পাশাপাশি ডাউকি নদীতে নৌকায় ভ্রমণও করা যাবে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা এ নদীর পানি স্বচ্ছ কাচের মতো। বোরহিল ঝরনা এ অঞ্চলের আরেকটি দর্শনীয় স্থান।

শিলং-চেরাপুঞ্জির দর্শনীয় স্থানের মধ্যে মাওলিং গ্রাম। এটি এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম বলে পরিচিত। আর এজন্য এ গ্রাম দেখতেই প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভিড় করেন এখানে। গাছগাছালিতে ঠাসা এ গ্রামের প্রতিটি কোনা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গ্রামের প্রতিটি বাড়িঘর ও পথ। প্রতিটি বাড়ির সামনেই আছে ফুলের বাগান। বাড়িঘরগুলোও পরিপাটি। একটা গ্রাম কতটা সুন্দর হতে পারে, সে ধারণাই পাল্টে যাবে সেখানে গেলে। মাওলিং গ্রাম দেখে আসতে পারেন এই এলাকার আরেক আকর্ষণ ক্রাং ঝরনা। সবুজ দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদীর মতো বয়ে চলা পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। যেখানে পড়ছে সে স্থানটি পুকুরের মতো হয়ে গেছে। আর এ দৃশ্য দেখবেন আরও উঁচু আরেক পাহাড় থেকে। ক্রাং ঝরনা দেখা হলে আসবেন সোনাংপেডাং গ্রামে। এ গ্রামের আকর্ষণ উমংগট নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু। এছাড়া এ গ্রামের বাড়িঘরও সুন্দর লাগবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য : শিলং-চেরাপুঞ্জির যেসব দর্শনীয় স্থান আছে, তার প্রায় সবই মেঘালয়ের সরকারি ট্যুরিজম সংস্থার আওতায়। সেজন্য সব স্থানেই প্রবেশমূল্য দিতে হবে ১০ থেকে ২০ রুপি। এছাড়া স্টিল ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করলে তার জন্যও দিতে হবে ২০ থেকে ৫০ রুপি।

শিলং-চেরাপুঞ্জি যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ মাধ্যম। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায় শিলং বা চেরাপুঞ্জির। ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ রুপিতে এ ট্যাক্সিতে ৪ জন শিলং বা চেরাপুঞ্জি যেতে পারবেন বা বেড়াতে পারবেন। অথবা মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের বাসে ও ঘুরতে পারবেন চেরাপুঞ্জি বা শিলংয়ের দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন সকালে শিলংয়ের পুলিশ বাজার থেকে মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন লিমিটেডের প্যাকেজ বাস ছাড়ে চেরাপুঞ্জির উদ্দেশে। খরচ প্রতি জন ৩৫০ রুপি। এ বাস আপনাকে পুরো চেরাপুঞ্জি ঘুরিয়ে আনবে। চাইলে মেঘালয় ট্যুরিজমের প্যাকেজ বাসে করে শিলং ও এর আশপাশটাও দেখতে পারবেন। এছাড়া ট্যাক্সিতেও ঘুরতে পারেন শিলং, চেরাপুঞ্জি বা ডাউকির আশপাশ, সোনাংপেডাং, ক্রাং ঝরনা, মাওলিং গ্রাম ও লিভিংরুট ব্রিজ এলাকা। সারা দিনের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া এক হাজার ৫০০ রুপি থেকে ২ হাজার ৫০০ রুপি পড়বে। ট্যাক্সিতে চারজন আরাম করে ঘুরতে পারবেন।

থাকার জন্য শিলং পুলিশ বাজার ও লাইতুম খারা অনেক হোটেল আছে। ভাড়া ডবল রুম ১০০০ রুপি থেকে ৭০০০ রুপি পর্যন্ত। এছাড়া ও কমবেশি মানের হোটেল আছে। সিঙ্গেল বা ডবল রুমে চাইলে আলাদা ম্যাট নিয়ে বাড়তি লোকও থাকতে পারবেন। ম্যাটের জন্য বাড়তি কিছু রুপি দিতে হবে। অবশ্য ম্যাট নিয়ে একরুমে একজনই অতিরিক্ত থাকতে পারবেন। এছাড়া সোনাং পেডাং, ক্রাং ঝরনা, মাওলিং গ্রাম ও লিভিংরুট ব্রিজের গ্রামগুলোতে চমৎকার সব গেস্ট হাউস বা কটেজ আছে।

শিলং যেতে চাইলে ভিসার আবেদনে ডাউকি বর্ডার উল্লেখ করুন। যাওয়ার আগে সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকা ভ্রমণ কর দিয়ে নিন। পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র, এনওসি লেটারসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একাধিক ফটোকপি সঙ্গে রাখুন। কারণ তামাবিল বর্ডারে কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র দেখতে চাইবে। এছাড়া হোটেল ভাড়াসহ নানা কাজেও লাগতে পারে। দেশ থেকে যাওয়ার সময় টাকা বা ভারতীয় রুপি না নিয়ে ডলার নিন।

(ঢাকাটাইমস/১৪সেপ্টেম্বর/জেবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
৫ অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ১৬ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি
ফরিদা পারভীনের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা মির্জা ফখরুলের 
ফুটবলার ঋতুপর্ণার ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের পাশে তারেক রহমান
ত্রিপুরায় রেড অ্যালার্ট, কুমিল্লায় আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ছে গোমতীপারের মানুষ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা