নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই

মুনাফালোভীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না কেউ

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:১৫ | প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১৭
ফাইল ছবি

নিত্যপণ্যবাজারে চাল, সবজি, মাছ, মাংস, পেঁয়াজ ও মসলার দাম বছরজুড়ে বেড়েছে দফায় দফায়। পেঁয়াজের ঝাঁজ কয়েক মাস ধরে থাকলেও গত কয়েক দিন মসলা, ভোজ্যতেল ও চালের বাজার অস্থিতিশীল। বিগত বছরগুলোতে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তেমনটি নজরে পড়েনি। পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার পেছনে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব ও সরকারের দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দেওয়াকে দুষছে সাধারণ মানুষ।

বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো কোনো সংস্থা নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া অন্য সময় কোনো অভিযান চালায় না। আবার পণ্যমূল্যের সুনির্দিষ্ট আই নেই বলে অভিযান চালিয়েও লাভ নেই। বিশেষ করে যারা মূল্য কারসাজি করে, সেই রাঘব বোয়ালদের ধরতে না পারলে শুধু খুচরা ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা করে কোনো কাজ হবে না।

বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকা সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দাবি- তারা প্রতিনিয়ত মাঠে থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিগত বছরগুলোর চেয়ে বাজার তদারকি অভিযান প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর সঙ্গে তারা পেরে উঠছেন না।

বাজার ব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু দেশীয়ভাবে কেনাকাটা নয়, আমদানির ক্ষেত্রেও নজর দেয়া প্রয়োজন। তারা বলছেন, শুধু অভিযান চালিয়ে সমাধান হচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধিতে কারা সম্পৃক্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু এমন কিছু নজরে পড়ছে না।

রাজধানীর বাজার নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের একটা বড় দায়িত্ব থাকলেও তাদের মাঠে খুব একটা দেখা যায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা রমজান ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকি না। মাঝে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির সময় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তবে সেটা জোরালো ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা খুচরা বিক্রেতা তাদের জেল-জরিমানা করে তো বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। বিশেষ করে যারা বড় বড় ব্যবসায়ী তাদের আমরা ধরে জেল-জরিমানা দিতে পারছি না। তাহলে বাজার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে?’

তার বক্তব্যের চিত্রই যেন দেখা যাচ্ছে বাজারে। মূল্যবৃদ্ধির দৃশ্যমান কোনো কারণ না থাকলেও গত দুই সপ্তাহ ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি চলছে। ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখাতে পারছেন না।

পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই অন্য নিত্যপণ্যের গায়েও তার আঁচ লেগেছে। এক মাসের মধ্যে দুই দফা দাম বেড়েছে চালের বাজারে। চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবার দাম বাড়ার তালিকায় যোগ হয়েছে মসলা। গত দেড় মাস ধরে দফায় দফায় দাম বেড়েছে রান্নায় অতিপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের। খুচরায় কোনো কোনো মসলার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ।

এ ছাড়া আরও অন্তত ১০ রকম নিত্যপণ্যের মূল্য অব্যাহতভাবে বেড়েছে। এগুলো হলো- চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন, দারুচিনি, এলাচ, শুকনো মরিচ ও আদা।

গত এক মাসে চালের মূল্য বেড়েছে কেজিতে সাত টাকার বেশি। জানুয়ারির শুরুর দিকে সরু চালের দাম ছিল ৪৫ টাকা কেজি। এখন সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়। মাস খানেক আগে সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের মূল্য ছিল ৪৫ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৫ টাকায়।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সাধারণ মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইলের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর সরু চালের মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ৭ শতাংশ।

কারওয়ানবাজার চাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কুষ্টিয়া, রংপুরসহ বেশ কয়েকটি মোকামে চালের দাম বেড়েছে। এরই প্রভাব পড়েছে রাজধানীতে। এ ছাড়া মিনিকেট চালের মৌসুম শেষ পর্যায়। আগামী এপ্রিলে নতুন ধান উঠবে। এর আগ পর্যন্ত এই মূল্য আর কমবে না।’

এদিকে ব্যবসায়ীদের কথার সঙ্গে একমত নন ক্রেতারা। তারা বলছেন, দেশের বাজারে মসলার কোনো ঘাটতি না থাকলেও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন মসলার। সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং না করলে লাগামহীন হয়ে যাবে মসলার বাজার।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার, কৃষিবাজারে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা দরে। মাস খানেক আগে এলাচ বিক্রি হয়েছিল ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি জয়ত্রী এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ থেকে ৩৬০০ টাকা।

জায়ফল গত দেড় মাসে দ্বিগুণ বেড়ে এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা কেজি দরে, এর আগে তা বিক্রি হয়েছিল ৪০০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজি দরে।

মসলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ জানান, বিশ্ববাজারে অনেক দাম বেড়েছে মসলার, এ কারণে দেশের বাজারে প্রভাব পড়েছে। মসলার রপ্তানিকারক দেশ ভারতে বৃষ্টি বা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তারা নিজেরাই মসলা এখন আমদানি করছে। রমজানের আগে ভারত মসলা উৎপন্ন করবে। বাজারে ভালো মতো এলে তবেই মসলার দাম কমে আসবে।’

এদিকে খোলা গুঁড়া মরিচের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১৫০ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা কেজি দরে। একইভাবে শুকনো মরিচ কেজিতে ১৩০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা। কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে ধনিয়া গুঁড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি।

কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে কালো এলাচ বিক্রি হচ্ছে ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকা।

সয়াবিন তেলের মূল্য বেড়েছে ৩০ টাকার বেশি। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য লিটারে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বোতলের তেলও লিটারে ৩০ টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এক মাস আগে ৫ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। এখন সেই বোতল বিক্রি হচ্ছে ৫৩০ টাকা। এ ছাড়া, এক মাস আগে যে পাম তেলের মূল্য ছিল ৭৯ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাজ কমেনি বরং বেড়েছে। প্রতিদিন চারটি থেকে পাঁচটি টিম মাঠে থাকে। গত বছরের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৯০০টি অভিযান চালানো হয়েছে।’

যখন বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে তখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে দাম বাড়ানোর তৎপরতা দেখা যায় উল্লেখ করে মঞ্জুর মোহাম্মদ বলেন, ‘অনৈতিক মুনাফার জন্য কিছু ব্যবসায়ী চেষ্টা করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি।’ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত বসা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দাবি তারা মাঠে থেকে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে কাজ করছে; তারপরও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না- জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণ বলতে তারা তো শুধু প্রত্যক্ষ করছেন। প্রত্যক্ষের ওপর তো আর বাজার নির্ভর করে না। বাজারে কেউ যদি অসৎ উপায় অবলম্বন করে থাকে, আর এটা যদি ওনারা চিহ্নিত করে থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া কিংবা কেউ চিহ্নিত হয়েছে বলে আমরা দেখছি না।’

বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকা দরকার বলে মনে করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রডাক্টের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) লেখা না থাকলে তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রডাক্টের মূল্য তালিকা করে না দেয়, তাহলে সেই প্রডাক্টটের মূল্য নির্ধারণ করার আইন আমাদের নেই। ফলে বাজারের বেশ কিছু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করতে পারছি না। আর এটায় এখন বড় অসুবিধা। যে যেভাবে খুশি দামে পণ্য বিক্রি করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি আইন থাকত আমদানি করে আনা পণ্যে ২৫ শতাংশের বেশি লাভ করতে পারবে না, তাহলে আমরা ধরতে পারতাম। কিন্তু এমন আইন তো নেই।’

ঢাকাটাইমস/৮ফেব্রুয়ারি/এসএস/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :