সেই ভাইরাল ছবি, বিচার এবং করোনা ভাইরাস!

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২০, ১৭:৪৯ | প্রকাশিত : ২৮ মার্চ ২০২০, ১৬:৩৮

আইনে আছে সহস্র অপরাধী ছাড়া পায় পাক কিন্তু একজন নিরপরাধ লোক যেন অন্যায়ভাবে শাস্তি না পায়। বিচার করতে হলে এই জুরিসপ্রুডেন্স মাথায় রাখতে হয়। বিচার করলে শুধু হবে না এটাও দেখাতে হবে যে সেখানে ন্যায়বিচার হয়েছে। মোবাইল কোর্টের বিচার অতঃপর দুজন বৃদ্ধের কান ধরিয়ে ছবি তোলার দৃশ্য উপরের ওসব ফৌজদারি বিচারের নীতির সাথে ঠিক যাচ্ছে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সবসময় বলতেন কাউকে যেন মিথ্যাভাবে হয়রানি করা না হয়। সবাই যেন ন্যায়বিচার পায় সেটিও তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

মাস্ক না পরার দায়ে কি না তিন বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুধু তাই নয়, সেই ছবি আবার আপলোড করা হয়েছে সরকারি ওয়েবসাইটে! শুক্রবার বিকালে যশোরের মনিরামপুরে ম্যাজিস্ট্রেট সাইয়েমা হাসানের ভ্রাম্যমাণ আদালত তিনজন বৃদ্ধ নাগরিককে এ সাজা দেয়। শুধু তাই নয়, কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজে ওই চিত্র তার মোবাইলে ধারণ করেন। রাতে এ ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সামলোচনার ঝড় ওঠে।

এটা ঠিক যে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় লোকসমাগম না করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে শুক্রবার বিকাল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালিত হয়। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে মনিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ। এর মধ্যে, একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। কিন্তু তাদের মুখে মাস্ক ছিল না।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাস্তি হিসেবে তাদেরকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনি নিজে আবার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এরপর, একজন বৃদ্ধ ভ্যান চালককেও অনুরূপভাবে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার সাজা দেন। এ ছবি দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বয়স্ক নাগরিকদের এভাবে সাজা দেয়াটাকে মেনে নিতে পারেননি। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এমন দণ্ড প্রদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি, এই ছবি সরকারি ওয়েবসাইটে আপলোডের পর সংশ্লিষ্টদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট আইনের ক্ষমতা প্রয়োগে আরও প্রশিক্ষণ দরকার আছে কি না তা কর্তা ব্যক্তিরা ভেবে দেখতে পারেন।

বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এমন কাজ সকলেই ধিক্কার জানাবে এবং জানাচ্ছে। মুরব্বিদের কান ধরিয়ে ছবি তুলে সেইটা আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে পাবলিশ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মোবাইল কোর্ট আইন মেনে ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতা প্রয়োগ হলো নাকি করোনা ভাইরাস ছড়ানো রোধে সচেতনতা সৃষ্টি হলো তা সুস্পষ্ট নয়। আগে ক্ষুধার্তদের খাবারের দায়িত্ব নিবে রাষ্ট্র তাহলে দেখবেন কেউ রাস্তায় আসবে না। এবং ছবিতে দেখা যায় যে নিচে বাজারের ব্যাগ, তারা নিশ্চয় কেনাকাটার উদ্যেশ্যে বাজারে এসেছিল। করোনা ভাইরাস ছড়াতে নয়।

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কান ধরিয়ে বিচার এর কথা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকার করেছেন। তবে, সরকারি ওয়েবসাইটে এই ছবি কেন দিলেন তা কিন্তু বোধগম্য হয়নি । তবে বয়স্ক নাগরিকদের এভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করার বিষয়টি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান উল্লাহ শরিফী। তার উচিত পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ছবিটি দেখে কেউ নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে এই শাস্তি সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দাঁড়প্রান্তে এমন অরাজকতা ও বিচারের নামে কাউকে অসম্মান মেনে নেওয়া যায় না। মহিলা যেই হোক তার বেআইনি কাজের শাস্তি দাবি করা যেতে পারে।

বিচারে কখনও কাউকে কান ধরে উঠবস করাইতে নেই। আইনের মধ্যে যতটুকু ক্ষমতা (দায়িত্ব) দেয়া আছে, তার মধ্যেই বিচার কার্যক্রম সীমিত রাখা উচিত। একটা সার্ভিসের যদি কেউ আইনের বাইরে কোন কাজ করে তার দায় সে নিজেই বহন করবে। যারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের শাস্তি দেবে সার্ভিস এবং রাস্ট্র। তবে এটা ঠিক আইনের বাইরে কোন কাজ যে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের অফিসাররাই করে ব্যাপারটা এমন নয়। এর থেকে আইনের বাইরে গিয়ে অনেক সার্ভিসের ব্যক্তিরা তাদের কাজ করে থাকে। এ ব্যাপারটা এমন যে, পরিবারের অবাধ্য ছেলেটা অন্যের বাসার ফল চুরি করে, মারপিট করে এবং সে অপরাধ করলে সবাই বলে এটা স্বাভাবিক কিন্তু সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটি যদি সামান্য অপরাধ করে তবেই হয়েছে। সব দোষ তার উপরে তাতো হয় না। প্রত্যেক সার্ভিসেই এরকম কিছু ব্যক্তি আছে। তারাই সমস্যা তৈরি করে। এর দায় পুরো সার্ভিস নেবে না।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে মোবাইলে ছবি ওঠানো আদৌ ঠিক হয়নি। আমার মনে হয়েছে উনি করোনা ভাইরাসের তীব্রতা অনুধাবন করে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখাকে সামান্য কোনো শাস্তি মনে করেছেন। কাউকে এভাবে শাস্তি দিলে যে সংবিধান বা বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট আইন ও দেশের ফৌজদারি আইন সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয তা হয়তো তিনি বুঝতে পারেন নাই। যে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক এই ধরনের কান ধরার বিচার করলেন তিনি তো তার নিজের ক্ষমতা দেয়া মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ ভালো করে পাঠ করে আসতে পারতেন। সেটি তিনি না পড়েই বিচার কাজে নেমে গেছেন। যা ঠিক হয়নি। আইন জানা থাকলে মানতে ও প্রয়োগ করতে সুবিধা হয় । করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যাক কারো মাধ্যমে সেটিও কিন্তু এই সময়ে একেবারেই কাম্য নয়।

লেখক: কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :