এতসব প্রতারণা শিখল কোথায় দিপু?

আল-আমিন রাজু, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৯:৫২ | প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৯:৩৫

প্রতারণার এক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর একের পর চমকে ওঠার মতো অজস্র প্রতারণার কথা বেরিয়ে আসছে আশরাফুল আলম দিপুর। কখনো প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তা, এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক, দুদকের পরিচালক, পুলিশের ডিআইজিসহ মানুষের কাছে একেকসময় একেক পরিচয়ে নিজেকে তুলে ধরতো মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পার করতে না পারা ২০ বছর বয়সী এই যুবক।

নিজ জেলা ভোলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় এসব পরিচয় ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতো দিপু। শুধু কি তাই, বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে ভুয়া জিও লেটারে নিত পুলিশ প্রটোকল। এমনকি ডায়াসে দাঁড়িয়ে স্যালুট নেয়া থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে বিচার প্রশাসনে প্রভাব খাটাতো। এনএসআই কর্মকর্তা পরিচয়ে পরিদর্শন করেছে একটি জেলা কারাগার।

ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর দিপু এখন দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে আছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে একের পর চাঞ্চল্যকর প্রতারণার ঘটনা বেরিয়ে আসছে। দিপুর প্রতারাণার এমন সব অজস্র ঘটনায় চমকে উঠছেন খোদ গোয়েন্দা কর্মকতারা। পেশাগত জীবনে নানা রকম অপরাধ ও অপরাধীর চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দিপুর প্রতারণা অনেকটা স্টাডি করার মতো বলেও মন্তব্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার।

দিপুর প্রতারণার বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম ঢাকা টাইমকে বলেন, ‘দিপু আসলে বড় মাপের প্রতারক। তার প্রতারণার কৌশল জেনে আমারাও হতবাক। এত বড় মাপের প্রতারক আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। বিশেষ করে তার যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, সেখান থেকে কীভাবে এত অল্প বয়সে এতসব বড় বড় প্রতারণা শিখলো ও প্রতারক হয়ে উঠলো সেটি আমরা স্টাডি করছি।’

ফেসবুক দিয়ে শুরু

গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, দিপুর প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ফেসবুক। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিপুর চারটি আইডির সন্ধান মিলেছে। একটি তার নিজের পরিচয়ে বাকিগুলো ভিন্ন পরিচয় ও নাম ব্যবহার করে খোলা। আশরুফুল আলম দিপু, আকবর আহমেদ শিমুল, মারিয়া ইসলাম এনডিসি ও এসএম জাকির নামে আইডিগুলো চালাতো দিপু।

দিপু প্রথমে ফেইক আইডি দিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতো। এরপর আলাপের এক পর্যায়ে বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখাতো। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার লোভ দেখাতো সে। এরপর তার মূল আইডি দিয়ে নিজেকে এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক পরিচয় দিয়ে চাকরি দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতো।

দিপুর ফেইক আইডি ঘুরে দেখা গেছে, আইডিতে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ছবি ব্যবহার করেছে। এসকল আইডিতে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জাতীয় গোয়েন্দা নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা, জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রশিক্ষকের পরিচয় ব্যবহার করেছে দিপু।

অজস্র প্রতারণার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি

আকবর আহমেদ শিমুল নামের আইডি দিয়ে গাজীপুরের বাসিন্দা মো. মমিনুর রহমান নামের একজনের সঙ্গে এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক পদে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রতারণা করে প্রায় ৩২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক দিপু। এসময় বিশ্বাস অর্জন করার জন্য মোমিনকে ২৫ লাখ টাকার একটি ব্যাংক চেকও প্রদান করে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, দিপুর সেই ব্যাংকে তিনশ টাকা জমা আছে। এরপর মোমিমেন সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কিছু দিন পরে প্রথম পরিচয়ের সময়ে যে আইডি ব্যবহার করে সেই আইডি দিয়ে বেশ কিছু ছবি পাঠায় দিপু। ছবিতে দেখা যায় হাসপাতালের বিছানায় অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় চিকিৎসাধীন। আইডি দিয়ে সে জানায়, দিপু কিছু দিন আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।

এছাড়া দিপু এনএসআইয়ের বিভিন্ন পদের চাকরি দেয়ার কথা বলে মোমিনসহ ৯ জন, প্রাথমিক স্কুলে চাকরি দেয়ার কথা বলে দুজন, পুলিশে চাকরি দেয়ার কথা বলে তিনজন, বিমানবাহিনীতে চাকরি দেয়ার কথা বলে একজন, সুবিধামতো স্টেশনে বদলি করে দেয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত একজন, রাজউক স্কুল ও ক্যামব্রিয়ান স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্য দুজন এবং একজনকে অটোরিকশা কিনে দেয়ার কথা বলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

এখন পর্যন্ত গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ১৮ জন দিপুর কাছে বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হওয়া তথ্য জানিয়েছে। পুলিশের হিসাবে ১৮ জনের কাছ থেকে দিপু বিভিন্নভাবে দুই কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকার বেশিরভাগ নিজের বিলাসিতা, লোক দেখানো দান ও আর্থিক সহযোগিতা এবং তার দুই বড় ভাইকে দেয়ার তথ্য জানিয়েছে দিপু।

রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙাতো

দিপুর কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও ক্ষমতাসীন দল ও নেতাদের পরিচয় ব্যবহার করতো। ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে করোনাভাইরাস মহামারিকে উপলক্ষ করে গড়ে তোলে কথিত মানবিক টিম নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনকে ব্যবহার করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকেও সাহায্যের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দিপু।

এমনকি নিজের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়া অন্য কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট না থাকলেও বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবইয়ের পাতা নকল করতো সে। এই সকল চেক কম্পিউটারের মাধ্যমে এডিট করে নিজের খুশি মতো অঙ্ক বসিয়ে সেগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তিকে সহায়তার কথা বলে নিজের ফেসবুকে প্রচার করতো। মানবিক টিমের নামে সংগঠনের অনুদান হিসেবে বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা পেয়েছে বলেও প্রচার করতো।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বহু প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত দিপু নিজের সুবিধা মতো পরিচয় ব্যবহার করতো। অর্থাৎ যখন যে স্থানে যে পরিচয় ব্যবহার করলে প্রতারণা করতে সহজ হতো সে সেই পরিচয়ই ব্যবহর করতো। এমনকি বিশ বছর বয়সী এই ছেলের প্রযুক্তিজ্ঞান ছিলো উল্লেখ করার মতো।

জিজ্ঞাসাবদে একের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য

জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত দিপুর কাছে প্রাপ্ত সকল তথ্যই চাঞ্চল্যকর। বিশেষ করে প্রতারণার কৌশল হিসেবে যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেছে। সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী পরিচালক, কখনো পুলিশের উপ-পলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছে।

এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য সরকারি বিভিন্ন জিও লেটার ব্যবহার করেছে। এই জিও লেটারগুলো সাধারণত মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়া হয়। কিন্তু সে এগুলো সংগ্রহ করে কমপিউটারে এডিট করে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিতো।

বেশি বয়সী প্রতিষ্ঠিত নারীরা টার্গেট

দিপুর কাছে প্রতারণার শিকার হওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাই নারীদের। বিশেষ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত ও মধ্যবয়সী নারীদের ফাঁদে ফেলত বিশ বছরের দিপু। সম্পর্ক পাতিয়ে একসময় তাদের কাছ থেকে আপত্তিকর ছবি ভিডিও সংগ্রহ করে পরে সেসব দিয়ে আদায় করতো বিপুল অংকের টাকা। এমন নারীর সংখ্যা শতাধিক।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই সকল নারীরা অভিযোগ নিয়ে লোকলজ্জার ভয়ে আমাদের কাছে আসতে পারছে না। কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান, পরিবার রয়েছে। তবে কেউ যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগ দেয় তাহলে আইনি সহায়তা দেবো।’

দিপুর এতসব প্রতারণার কাণ্ডে এখন পর্যন্ত তার পেছনে কারো সহযোগিতা কিংবা কোনো গডফাদারের সন্ধান মেলেনি জানিয়ে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সে নিজেই মূলত প্রতারণার সব কাজ করতো। এমনকি নানাভাবে তার পরিচয় দেয়ার বিষয়টিও সেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার পেছনে গদফাদার বা রাঘববোয়াল বলতে কিছু আমরা পাইনি।’

একের পর এক প্রতারণার পরও পার পেয়ে যাওয়া তার মধ্যে বেপরোয়া ভাব আসে মন্তব্য করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এ যুগ্ম কমিশনার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সে দেখল প্রতারণা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা সে প্রতারণার মাধ্যমে পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রটোকল পেয়েছে। ফলে সে আরও বেশি আত্মবিশ্বাস পেয়েছে। যে সব কর্মকর্তা এই সকল প্রটোকল দিয়েছিলেন তাদের উচিত ছিল আরও যাচাই-বাছাই করা। যেসব জিও বা সরকারি ভিজিট সে দেখিয়েছে সেগুলো একটু যাচাই করলেই তারা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারতেন। সে যে সকল পরিচয় দিয়েছে তার যে বয়স সেই অনুযায়ী সে এই পদে তো যেতেই পারে না।’

দিপুর বিরুদ্ধে তার জন্মস্থান ভোলাসহ বিভিন্ন থানায় বেশ কিছু মামলা আছে। এর মধ্যে ভোলার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল। তবে জামিনে মুক্তির পর তাকে গ্রেপ্তারকারী সেসব পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ দেয় দিপু। তার অভিযোগের কারণে বিপাকে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। সেই অভিযোগ এখনো তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতারণার এত টাকা গেল কোথায়?

প্রতারণা করে দিপু যে টাকা হাতিয়েছে তার বেশিরভাগই নিজে বিলাসিতা আর ভাইদের নামের সম্পত্তি করার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। যুগ্ম কমিশনার মাহবুবুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে যে সকল টাকা দিপু নিয়েছে সেগুলো তার দুই বড় ভাইদের নামে রেখেছে। বাকি টাকা নিজের উচ্চাবিলাসী ভোগ বিলাসের জন্য খরচ করেছে। আমরা তার বিভিন্ন বিলাসিতা প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এছাড়া অন্য কোথাও টাকা রেখেছে কি-না সেটি তদন্ত করছি। এমন কিছু থাকলে আমরা সেটি বের করে নিয়ে আসবো।

(ঢাকাটাইমস/০৭ফেব্রুয়ারি/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :