জেলা-বিভাগ-প্রদেশ প্রসঙ্গে কিছু কথা

এ এস এম আলী কবীর
 | প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৩:৫৯

পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে জেলা ছিল প্রথমে ১৭টি। ১৯৬৮ সালে পটুয়াখালী ও ১৯৬৯ সালে টাঙ্গাইল জেলা গঠনের ফলে জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯টিতে। অনুরূপভাবে দেশে বিভাগের সংখ্যা ছিল প্রথমে ৩টি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী। পরে খুলনাকে বিভাগে পরিণত করায় বিভাগের সংখ্যা ৪টিতে উন্নীত হয়। এ অবস্থায়ই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি।

বলাই বাহুল্য, একসময় রাজশাহী বিভাগ বর্তমান রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগ নিয়ে গঠিত ছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম বিভাগ ছিল বর্তমান চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সমন্বয়ে। আর ঢাকা বিভাগে বর্তমান ৩টি বিভাগ ঢাকা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত ছিল।

১৯৮২ সাল পর্যন্ত দেশের প্রতিটি জেলা এক বা একাধিক মহকুমা (ঝঁন উরারংরড়হ) নিয়ে গঠিত ছিল। দেশে প্রথমে মোট ৫৪টি মহকুমা ছিল। ১৯৭৫ হতে ১৯৮১ সালের মধ্যে দেশের জেলাগুলোতে আরো ১০টি মহকুমা সৃষ্টি করা হয়। এগুলো হলোÑ বরগুনা, ঝালকাঠি, জয়পুরহাট, শেরপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়। এর ফলে মহকুমার সংখ্যা ৬৪তে উন্নীত হয়। তা ছাড়া ১৯৭৮ সালে জামালপুরকে জেলায় পরিণত করায় জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২০-এ।

১৯৮২-৮৩ সালে দেশের সকল থানাকে উপজেলা এবং সকল মহকুমাকে জেলায় পরিণত করার ফলে জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪তে। পরবর্তীতে সাবেক ৪টি বিভাগের অতিরিক্ত দফায় দফায় আরো ৪টি নতুন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহকে বিভাগে পরিণত করায় বিভাগের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮-এ।

লক্ষণীয় যে, দেশে এতগুলো প্রশাসনিক পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও জনবহুল এই দেশটি এখনো এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা রয়ে গেছে। এখানে কোনো প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ উপমহাদেশে আমাদের ন্যায় ছোট ছোট দেশগুলোতে বহু পূর্বেই একাধিক প্রদেশ গঠন করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের কথা উল্লেখ করা যায়। শ্রীলঙ্কায় ৯টি ও নেপালে ৫টি প্রদেশ গঠন করা হয়েছে।

সকল মহকুমাকে জেলায় পরিণত করার পর যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ হতে পারতো মূল ১৭টি জেলাকে বিভাগে, এই ৪টি বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তরিত করা। এ জন্য দুটি মাত্র আদেশই যথেষ্ট ছিল এবং এর কোনো বিরোধী বা সমালোচকও ছিল না।

অনেক যৌক্তিক কারণে জনবহুল এই দেশটিতে একাধিক প্রদেশ গঠন করা উচিত। সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুততর করা ও স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করা ছাড়াও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে দেশে কয়েকটি প্রদেশ গঠন করা অপরিহার্য।

১. সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিভৃত গ্রামে সমাহিত। অথচ স্বাধীনতা বিরোধীদের মরদেহ রাজধানী ঢাকায় সমাধিস্থ। এই অবস্থা চিরকাল বজায় থাকতে পারে না। এর সম্মানজনক অবসান হওয়া দরকার। বাংলাদেশের রাজধানী টুঙ্গিপাড়ায় স্থানান্তর করা না গেলেও দেশের দ্বিতীয় রাজধানী অবশ্যই সেখানে গড়ে তোলা যায়। বঙ্গবন্ধুর নামে সেখানে দ্বিতীয় বা বিকল্প রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করা হবে। সুতরাং গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়া নিয়ে দেশের দ্বিতীয়/বিকল্প রাজধানী গঠন করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত আধুনিক ও বৃহৎ বিমানবন্দরটিও সেখানে নির্মাণ করা যেতে পারে।

২. দেশের অন্যান্য প্রশাসনিক পরিবর্তন:

প্রদেশ

দেশে নিম্নরূপভাবে ৫টি প্রদেশ গঠন করা যেতে পারে:

ক। ঢাকা- ১৬ জেলা

ময়মনসিংহ বিভাগ (৬ জেলা)

ফরিদপুর ব্যতীত

ঢাকা বিভাগের বাকি জেলাসমূহ (৬ জেলা)

সিলেট বিভাগ (৪ জেলা)

খ। চট্টগ্রাম-১১ জেলা

চট্টগ্রাম বিভাগ ও প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগ

গ। উত্তরবঙ্গ- ১৬ জেলা

রাজশাহী বিভাগ (৮ জেলা)

রংপুর বিভাগ ( ৮ জেলা)

ঘ। খুলনা- ১০ জেলা

খুলনা বিভাগ (১০ জেলা)

ঙ। বরিশাল বিভাগ- ৬ জেলা

বরিশাল বিভাগ (৬ জেলা)

প্রস্তাবিত ফরিদপুর বিভাগ (৫ জেলা)

বিভাগ

দেশের পুরাতন ১৭টি জেলার মধ্যে ৮টিই বিভাগে পরিণত হয়েছে। বাকি ৯টি জেলাকে বিভাগে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। এগুলো হচ্ছে:

১) কুমিল্লা (ত্রিপুরা)

২) নোয়াখালী

৩) পার্বত্য চট্টগ্রাম

৪) যশোর

৫) কুষ্টিয়া

৬) পাবনা

৭) দিনাজপুর

৮) বগুড়া

৯) ফরিদপুর (পদ্মা)

প্রদেশ গঠন জরুরি কেন?

প্রদেশ গঠন ব্যতীত সারাদেশ হতে ঢাকামুখী জনস্রোত কখনো বন্ধ হবে না। ঢাকাকে বসবাস উপযোগী করে তুলতে চাইলে প্রদেশ গঠন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

আরেকটি কারণ প্রদেশ গঠনকে অপরিহার্য করে তুলেছে। উচ্চ আদালতে মামলাজট এমনই আকার ধারণ করেছে যে, বর্তমান হারে মামলা নিষ্পত্তি করলে এই জট নিরসনে ৩০ বছরের বেশি সময় লাগবে। এই অবস্থায় জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ হতে চলেছে। এই অবস্থাটা দেশের জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মনে হয়। দেশে ৪-৫টি প্রদেশ বা রাজ্য গঠিত হলে প্রতিটির নিজস্ব হাইকোর্ট থাকবে। এর ফলে উচ্চ আদালতে মামলাজট দ্রুত নিরসনের পথ খুলে যাবে।

আরো কতিপয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ:

রাজধানী ঢাকাকে সকল প্রকার দূষণ ও যানজট মুক্ত করে একে বসবাসোপযোগী করে তোলার জন্য কলকাতার ন্যায় ঢাকা মেট্রোপলিটন জেলা গঠন করা অপরিহার্য।

এর ফলে ঢাকার পৌর পিতারা সুষ্ঠুুভাবে পরিষেবা দানকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারবেন। ফলে নগরীকে পরিচ্ছন্ন রেখে নানা রোগব্যাধি ও মহামারি নিরসনের কাজ সম্পন্ন করা সহজ হবে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার, কেরানীগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জকে এই মেট্রোপলিটন নগরীতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ধামরাইকে মানিকগঞ্জ জেলায় এবং দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলাকে মুন্সিগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

নামকরণ সম্পর্কে:

সম্প্রতি প্রস্তাবিত কুমিল্লা বিভাগের নামকরণ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। দুটি নাম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে কেউ কেউ কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী নাম ত্রিপুরা নামকরণের কথাও বলছেন। একমাত্র জনগণ চাইলেই সরকার সেটা করতে পারেন। যেমন- জনগণের বড় একটি অংশ গাজীপুরের এবং মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নাম যথাক্রমে ভাওয়াল পরগনা এবং বিক্রমপুর পছন্দ করেন। তাদের পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

লেখক: চেয়ারম্যান (সরকারের সচিব), জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :