চৌধুরী ফেরদৌসের ১৩টি কবিতা
চৌধুরী ফেরদৌস। গত শতকের আশির দশকের সব চেয়ে নিভৃতচারী কবি। তার কবিতা বিষয়-বৈচিত্র্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাপ্রবণ। তিনি ছবি আঁকেন, করেন নতুন ঘরানার গানও। লেখেন, সুর করেন, কণ্ঠ দেন নিজেই। প্রকাশ করা হলো তার লেখা একগুচ্ছ 'ষষ্ঠপদী সনেট'।
আলো নিভে গেলে পর যে অন্ধকার জ্বলে ওঠে, তার হাহাকার
সহ্য আছে কার? ফুল ঝরে গেলে পিঁপড়াও আসে না ফিরে,
ভ্রমর তো ছাড়! মৃত নদীটির কথা কখনো কি মনে রাখে
উড়ে-চলা কুশীলব মেঘ? নাটক বা যাত্রাপালা শেষ হলে
একে একে দর্শক-শ্রোতারা কিন্তু চলে যায়। তখন হঠাৎ
নিভে গেলে আলো, ভাঙামঞ্চটাই শুধু মুখথুবড়ে পড়ে থাকে...যা আমি পারি না
আমি পারি না আমার ছায়াটাকে মুছে ফেলতে, সে যতটাই
প্রখর রোদ্দুর হোক। অন্ধকেও পারি না বলতে, আহা! কী যে
সুন্দর আপনার চোখ। তোমরা সহজে পার প্রশংসায় চিড়া
ভেজাতে: আমার কিন্তু নেই তোমাদের মতো জাফরিকাটা হাত,
যে, জ্যোৎস্না দেখেই কেলিয়ে দাঁত, আঙুলে আঙুল কচলাব।
কারণ, আমি তো জানি, চাঁদের যা আলো, সূর্যেরই অণু দান...ফুল ফুটল না
কত যে বসন্ত এল, চলে গেল, ফুল ফুটল না! হাওয়া ছিল,
চাঁদ ছিল, সূর্য ছিল, পাখি ডাকল না। পাতা ঝরে, পাতা ধরে,
কালবৈশাখী ঝড়ে শাখা ভেঙে যায়, দখিনা বাতাস লেগে
সেই ডাল আবার গজায়। বর্ষা ছিল, ভর্সা ছিল, ভিজে ভিজে
কাদাজল হয়ে গেল মাটি। তুমি ছিলে, আমিও ছিলাম, প্রেম
ছিল, তবু সবুজ হয়নি ঘাস উদ্যান জুড়ে পরিপাটি!চৌধুরী ফেরদৌসের চিত্রকর্ম
কে তোমাকে শুদ্ধ নামে ডাকে
তারপর, এইটুকু লাল ঢেলে দিলাম, তোমার জন্য। সেই
লালে রেঙে, পলাশ-শিমুলগুলো ফোটে। আজ কোনো ভাষা নেই,
এই দিন ফিবছর আসে। চেয়ে দেখি, দাউ-দাউ লেলিহান,
থোকা-থোকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রক্ত, ডালে ডালে, এ দেশের
সুনীল আকাশে। সেই সব লাল, সে-আগুন, টিয়ে-কাক-ফিঙে
তার কণ্ঠে তুলে রাখে: পাখি ছাড়া কে তোমাকে শুদ্ধ নামে ডাকে!নিঃসঙ্গতা
গৃহকোণে, এই নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতায়, কে থাকতে
চায়?
এর চেয়ে ভালো, জনপদ থুয়ে নদী-কূলে,
যেখানে জলের
কুলকুল ধ্বনি শোনা যায়, কিংবা অরণ্য-গভীরে
থাকতাম
নিমগ্ন: রাত্রিতে, প্রাতঃকালে, মধ্যদুপুরে কি সন্ধ্যায়, থাকত
পাখির কূজন, আর ঝরত একটি-দুটি পাতা কিংবা হিম
হিমালয়ে, গুহায়, ডাকত ইঁদুরশিশু, থাকত না নিঃসঙ্গতা...মেয়ে চড়ই ছেলে চড়ই
মরে পড়ে থাকল চড়ই, ছেলে চড়ইটা। পাশে বসে আছে
একটি শোকার্ত মেয়ে চড়ই। প্রথমে কিছুক্ষণ সে রাস্তায়
পড়েথাকা চড়ইটার মাথার কাছে এসে অস্থির ডাকল...
সাড়াশব্দ আর প্রতি-উত্তর না পেয়ে মৃত অবশিত ছেলে
চড়ইটার হা-করা ঠোঁটে ঠোঁট রেখে কিছু-একটা খুঁজল!
তারপর আপ্রাণ টানাটানি শেষে চুপচাপ বসে থাকল...তার পরও সূর্য ওঠে
গাছ ফুল ফোটায়, পাখিরা তা বোঝে না। তাই পাতা খসে পড়ে,
ফুলগুলো ঝরে। পাখি উড়ে গেলে রোদেলা সকালে, পড়ে থাকে
দ্যোতনা। মেঘেরা যায় ভেসে, দূর দেশে, ঝিল বলে, 'পদ্ম তুমি,
অমন করে হেস না!' সেই কথা শুনে আর, আকাশের ঘুম
আসে না। রাত্রিতে একা একা জেগে থেকে চাঁদ মুখ লুকায়
পাহাড়ের ওই পারে। তার পরও, আলো করে সূর্য কিন্তু ওঠে...পা পিছলে মানুষ প্রেমে পড়ে
শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ, কোন তারা কোন দিকে ওঠে, কাক-বক
চিনে নিতে হয়। আগে চিনতে পারলে, ভালো বউ, ভালো বরও
মেলে। ভালো, যাচাই-বাছাই ভালো। কনে কি সংসারী, হবু-বর
চাকুরে না কি বেকার? এই বাদবিচার বিয়েতে বেশ চলে:
মানুষ তো ভেবে বিয়ে করে। প্রেম হয় না কক্ষনো স্থান, কাল,
পাত্র মেনে। মনে মন মেললেই, পা পিছলে মানুষ প্রেমে পড়ে...সেই ফুল
অপ্রকাশিত থেকে গেল যে ফুল, সে কি ভুল? তুমি তো যাওনি
সেখানে, ফুটেছে সে যে স্থানে। গন্ধ ছড়িয়ে গেছে তার: একাকার
বনভূমি, তবু ঘ্রাণ পাওনি তো তুমি! ঝিঁঝিঁপোকা থ হয়ে গেল;
জোনাকিরা জ্বলা-নেভা, তা-ও, ভুলে গেল, সে সুবাস পান করে;
মাতাল হয়েছে চাঁদ তার রূপ দেখে! সেই ফুল ফুটেছিল
গুপ্ত এক লেকে: বলো, পাওনি সাক্ষাৎ তার হতভাগ্য কে কে?কাজল পরেছ বলে
কাজল পরেছ বলে কক্ষনো ভেব না হয়ে গেছ বিভাবরী...
ভূষণ ছাড়াই তুমি অনিন্দ সুন্দরী, এই সত্যটা কেন যে
বোঝ না, সেই দুঃখেই আমি হেসে মরি। দিলাম তোমার নাম
তুন্দ্রা। তুমি তো জান না, কী বিচিত্র গোলাপি রক্তাভ লাল হয়ে
ফুটে আছ তুমি, যেন মঙ্গল গ্রহের কোনো অনবদ্য নারী:
তোমার কি লাগে চুড়ি, কপালের টিপ আর বেনারসি শাড়ি!চারটি মেয়ে তিনটি ছেলে
চারটি মেয়ে ও তিনটি তরুণ আড্ডা দিতে দিতে তিন ভাগে
ভাগ হয়ে গেল, পূর্ণিমার রাতে। সবাই গভীর ঘুমে, শুধু
রিসোর্টটা জেগে আছে। একটি ছেলের সঙ্গে দুইটি তরুণী,
দুইটি মেয়ের সাথে এক ছেলে: রিসোর্টের দুটি রুম সারা
রাত জ্বলে। বিশাল বিজন বন, একটি পুকুর আর জ্যোৎস্না
সহবাসটুকু হলে, লনে থেকে যাওয়া ছেলেটির ঢের চলে...সন্ধ্যায়
এবার ফেরার পালা। যুৎসই অপেরার সুচতুর মেঘ,
আরক্ত হয়েছ ঢের, তোমার শরীর জুড়ে মধ্যাহ্নের খেলা:
সূর্য হেলে গেলে আর কতক্ষণ বলো গাঢ় থাকে অষ্টকলা?
নাটক হয়েছে যত মঞ্চস্থ শহরে, তার কিছু প্রেত-ছায়া
প্রলম্বিত হতে হতে নিকোনো উঠোনে এসে ম্লান হয়ে গেছে:
সব গাছ সন্ধ্যায় নীরব হয়, জেগে থাকে শুধু পাখিডাকা।মুখোশ খুলে যায়
এভাবে মুখোশগুলো খুলে যায়, প্রতিপত্তি হারালে। যখন
জমিদারি লাটে ওঠে গোমস্তারা মুখটিপে হাসে, আর নিজ
ছায়াটুকুও থাকে না পাশে, সূর্য লুকিয়ে থাকেন থমথমে
মেঘলা আকাশে। তবু সম্রাট সম্রাটই: হয় তো রবার্ট ব্রুশ...
নয় তো সে মির্জা আবু জাফর সিরাজ-উদ্-দীন মুহাম্মদ:
স্বাধীনতার স্বপ্নস্রষ্টা, যদিও জোটেনি তার স্বভূমে সমাধি!(ঢাকাটাইমস/২৩মার্চ/এফএ)