আদালতের রায় উপেক্ষার চেষ্টা

ফের বালু তোলার অনুমতি পেতে সেলিম খানের দৌড়ঝাঁপ

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট ২০২২, ১১:০২

চাঁদপুরের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ‘বালুখেকো’ সেলিম খান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে এখন পলাতক। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীর তলদেশ থেকে ২০১৬ সাল থেকে সেলিম খানের বালু উত্তোলন করে বিক্রি করাকে অবৈধ উল্লেখ করে ইতমধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

এবার সেলিম খান আদালতের রায় উপেক্ষা করে ছেলে ও ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের নামে পদ্মা ও মেঘনা নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন ও বিক্রির অনুমতি পেতে অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। ওই অনুমতি পেতে তিনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অফিসে গোপন বৈঠকও করেন, যা এরই মধ্যে ফাঁস হয়েছে।

এমনকি সরকারি এ সংস্থার এক উপপরিচালক প্রটোকল ভেঙে সেলিম খানের ছেলে ও ভাইকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার পক্ষে মতামত দিয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছেন। যদিও আপিল বিভাগের রায় অনুয়ায়ী বালুমহল ইজারা বা বালুমহাল ঘোষণার বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্তৃত্ব নেই। এরপরও সরকারি এ সংস্থাটি আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সেই পথেই হাঁটছে।

এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রথমত এই ব্যক্তি (সেলিম চেয়ারম্যান) মেঘনা নদীর অনেক ক্ষতি করেছে।’ তিনি বলেন, ‘মেঘনা নদী ইলিশের অভায়ারণ্য, সেখান থেকে বালু তোলা ঠিক হবে না।’

বিআইডব্লিউটিএ সেলিম খানের ছেলে ও ভাইকে বালু তোলার অনুমতি দিতে বিধি ভেঙে অপতৎপরতা চালাচ্ছে- এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি। যদি তারা এটা করে থাকে তাহলে ওই কর্মকর্তাদের নদী কমিশনে ডেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। প্রয়োজনে আমরা নৌবাহিনীকে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করব বিষয়টিতে দৃষ্টি দিতে। নদী কমিশনকে না জানিয়ে কেউ ওখানে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে পারবে না। আমি বিআইডব্লিউটির ওই কর্মকর্তাদের কমিশনে ডেকে এর ব্যাখ্যা চাইব।’

বালু মহল ঘোষণা বা ইজারা দেয়ার বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্তৃত্ব নেই- আদালত রায়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন বলে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) কাজী মাইনুল হাসান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এছাড়া সেলিম খান ২০১৬ সাল থেকে সরকারকে কোনো রাজস্ব না দিয়ে যে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করেছেন, তাকে অবৈধ বলা হয়েছে রায়ে। ওই বালু উত্তোলন বাবদ তার কাছ থেকে সরকারের আর্থিক ক্ষতি আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

‘বিদ্যমান বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুসারে বালুমহাল ঘোষণার এখতিয়ার স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের। তারা নদী কমিশন, মৎস বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ অংশীজনদের সাথে কথা বলে প্রয়োজন হলে বালুমহাল ঘোষণা করবে এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করবে। আর প্রয়োজন মনে না করলে ঘোষণা করবে না।’ বলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগের আদেশের পরও বিআইডব্লিউটিএ বা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যা করেছে তা অবৈধ। যেখানে বিআইডব্লিউটিএর বালুমহাল ইজারা দেয়া বিষয়ক কোনো কর্তৃত্ব নেই, সেক্ষেত্রে তারা চিঠি চালাচালি করে কোন যুক্তিতে। তাদের এ কর্মকাণ্ড আদালতের রায় অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘনের শামিল।

নদী বিনষ্টে সেলিম খানের নতুন অপতৎপরতা

চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীর তলদেশ থেকে দেশীয় প্রযুক্তির ড্রেজার দিয়ে ‘জনস্বার্থে’ বালু তোলা ও বিক্রির অনুমোদন দিতে হঠাৎ তৎপর হয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এ অনুমোদন পেতে আবেদন করেছে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের ছেলে শান্ত খান ও তার ভাই বোরহান খানের প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার নয়টি মৌজা থেকে তিন বছরে নয় কোটি ঘনফুটের বেশি বালু উত্তোলন ও বিক্রির অনুমোদন চেয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ত্বরিতগতিতে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে নৗপরিবহণ মন্ত্রণালয়। নৌসচিবের দপ্তর থেকে বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইতিবাচক মতামত দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চাঁদপুর বন্দর কর্মকর্তা।

এছাড়া প্রটোকল ভেঙে ওই প্রতিবেদনের অনুলিপি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও নৌসচিব মো. মোস্তফা কামালের একান্ত সচিবকে দেওয়া হয়েছে। তবে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর একান্ত সচিবকে কোনো অনুলিপি দেওয়া হয়নি। যদিও সম্প্রতি প্রকাশিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় অনুযায়ী এ সংস্থাটির এ বিষয়ক কোনো কর্তৃত্বই নেই।

আবেদনে যেসব স্থান থেকে বালু উত্তোলন করার কথা বলা হয়েছে, সেই মৌজাগুলো হলো- চাঁদপুর সদর উপজেলার মেঘনা ও পদ্মা নদীর বাঁশগাড়ী, রাজরাজেশ্বর, নিলারচর ও ইব্রাহীমপুর এবং হাইমচর উপজেলার চরসলাদী, পশ্চিম চরকৃষ্ণপুর, নীলকমল ও মনিপুর।

আরও জানা গেছে, বালু তোলার দুই আবেদন নিষ্পত্তিতে রহস্যজনক কারণে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ও বিআইডব্লিউটিএ চরম গোপনীয়তা বজায় রাখছে। একই সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে আবেদন দুটি নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে।

নৌসচিবের বরাবর সেলিম খানের ছেলে শন্ত খানের ‘মেসার্স শান্ত এন্টারপ্রাইজ’র আবেদন উপস্থাপন ও এ বিষয়ে ‘বিধি মোতাবেক’ ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি ইস্যু করার ফাইলে একই দিনে স্বাক্ষর করেছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা।

অপরদিকে এ দুটি আবেদন নিয়ে সেলিম খানের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন সংস্থাটির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা। এ গোপন বৈঠকের খবর ফাঁস হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যান বালুখেকো সেলিম খান। ওই ঘটনার পর চাঁদপুর এলাকা পরিদর্শনেও গেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। সম্প্রতি আবেদন দুটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে নৌমন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।

এ বিষয়ে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ একটি মতামত দিয়েছে। মন্ত্রণালয় তাদের কাছে মতামত চাওয়ার প্রেক্ষিতে তারা মতামত দেন।’ আদাালতের রায়ের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘রায়ে যে আদেশ আছে তার বাইরে আমরা যাব না।’

এদিকে চলতি সপ্তাহে সেলিম খানের একটি মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই রায়ে চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার ২১টি মৌজার মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু উত্তোলনের জন্য সেলিম খানকে দেওয়া অনুমতি বাতিলের বিষয়টি বহাল রয়েছে। একই সঙ্গে তার কাছ থেকে রাজস্ব (রয়্যালটি) আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

আপিল বিভাগের এই রায়ে হাইকোর্টের বালুমহাল ঘোষণাকে গুরুতর ভুল হিসাবে উল্লেখ করা হয়। সেলিম খানকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দিতে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব নির্দেশ উল্লেখ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেলিম খান তার নিজের নামের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠান দিয়ে বছরের পর বছর বালু উত্তোলন করে আসছেন। নির্দিষ্ট মৌজার বাইরে আশপাশ সব এলাকায় দেশীয় ড্রেজার দিয়ে শত শত বাল্কহেডে বালু বিক্রি করতেন। সম্প্রতি তা উচ্ছেদ করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/১৩আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অপরাধ ও দুর্নীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অপরাধ ও দুর্নীতি এর সর্বশেষ

পল্লবীতে পাভেল হত্যা: নেপথ্যে মাদক ব্যবসা, গ্রেপ্তার ৮

মাদক-ইয়াবা কারবারে বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের হটলাইন থেকে গ্রাহককে ফোন, অ্যাকাউন্টের টাকা হাওয়া

রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে আটক ৮, মামলা ৬

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি গ্রেপ্তার 

এটিএম বুথের প্রহরী হত্যা: টাকা লুটের উদ্দেশ্যে নাকি ব্যক্তিগত কারণ? কী বলছে পুলিশ?

রাজধানীতে এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা

কেএনএফকে সহযোগিতা, বান্দরবান থেকে একজন গ্রেপ্তার

ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার সেই চিকিৎসকের মৃত্যু

রাষ্ট্রপতির আত্মীয় পরিচয়ে প্রতারণা, নিঃস্ব বহু ট্রাভেল ব্যবসায়ী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :