নিজেই মুমূর্ষু দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
| আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১০ | প্রকাশিত : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:০৫

সংকটের শেষ নেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে। বর্তমানে চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালই মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছে।

এছাড়াও হাসপাতালে অনিয়ম ও দালালদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ কারণেও প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীসহ তাদের স্বজনরা। দিন দিন এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ছে। এক কথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দিনাজপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল।

দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে মোট ৬০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও সেখানে আছেন মাত্র ২৪ জন চিকিৎসক। ৩৬ জন চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে।

এছাড়াও কার্ডিওলজি, শিশু, এনেসথে, রেডিওলজি, প্যাথলজি, অর্থো-সার্জারি, চক্ষু, মেডিসিন, ওরাল সার্জারি, মেডিকেল অফিসার, ইমারজেন্সী মেডিকেল অফিসার, হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন রোগ, নাক-কান গলার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদগুলো শূন্য রয়েছে। এতে করে গরিব ও অসহায় রোগীরা পড়েছেন বিপাকে। হাসপাতালে সেবা নিতে এসেও ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই।

হাসপাতালে সার্জারি বিভাগে ডাক্তার না থাকায় বাইরের ক্লিনিকে বা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেও হিমশিম খাচ্ছেন গরিব ও অসহায় রোগীরা। সাধারণ রোগীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।

হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা যায়, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক না থাকায় ২৬ বেডের নারী ও ৫৯ বেডের পুরুষ ওয়ার্ডের বিছানাগুলো অধিকাংশই রোগীশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে।

অন্যদিকে নার্স ও দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণেও প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীসহ তাদের স্বজনরা। সে জন্য হাসপাতালের নার্সদের বিরুদ্ধেও রয়েছে দায়সারা দায়িত্ব পালন আর রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ। এতে দিন দিন এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ছে। নার্স এবং দালালদের দৌরাত্ম্য কৌশলে হাসপাতাল থেকে রোগী ক্লিনিকে চলে যাচ্ছে।

বোচাগঞ্জ উপজেলার মাহেরপুর থেকে আসা মোকলেসুর রমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘তার স্ত্রীর ডেলিভারি বাবদ সকল ওষুধ তাকে বাহির থেকে কিনতে হয়েছে। কোন প্রকার ওষুধের সুবিধা সরকারি হাসপাতাল থেকে তিনি পাননি।’

বিরল উপজেলার পলাশবাড়ী থেকে আসা রোগী আজাহার আলী রোগী বলেন, ‘শরীরে পুষ করা সুঁই, স্যালাইন, ওষুধ কোনো কিছুই হাসপাতাল থেকে দেয়নি, সব বাহিরে থেকে কিনতে হয়েছে।’

খানসামা উপজেলার কাচিনিয়া থেকে আসা ফারুক হোসেন বলেন, 'হাসপাতালে হার্নিয়া অপারেশন করতে এসেছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে ঢুকেই শুনি এখানে কোনো চিকিৎসক নেই। ফলে বাধ্য হয়েই বাইরে অপারেশন করাতে হচ্ছে। হাসপাতালের একজনের মাধ্যমে একটি ক্লিনিকে যাচ্ছি।’

দিনাজপুরে অগণিত বে-সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রাহুগ্রাসে হাসপাতালে এসেও রোগীরা অসহায়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে নিজস্ব অথবা পছন্দ মতো বে-সরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের যেতে বাধ্য করাচ্ছে দালাল, নার্স ও চিকিৎকেরা। সেখানে এক প্রকার রোগীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

সদরের নয়নপুর থেকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডাক্তার দেখাতে এসেছেন মর্জিনা বেগম।

তিনি বলেন, ‘সদর হাসপাতালে কম খরচেই চিকিৎসা পাওয়া যায় এজন্য এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখি ডাক্তার নেই। তাই বাইরে ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালাম।’

দিনাজপুরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. ফজলুর রহামান জানান, দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে মোট ৬০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও সেখানে মাত্র ২৪ জন চিকিৎসক। ৩৬ জন চিকিৎসকের পদই শূন্য রয়েছে। ফলে প্রতিদিন যেখানে আড়াই থেকে তিন’শ রোগী ভর্তি থাকত সেখানে বর্তমানে দুই’শ রোগীও ভর্তি থাকছে না।

প্রতি মাসে এখানে মেজর ও মাইনর মিলিয়ে ২০০ থেকে ৩০০ জন রোগীর অপারেশন হত।

সেখানে গত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ৬৮ জন, ডিসেম্বর মাসে ৬৫ জনের মেজর অপারেশন হয়েছে। তবে চলতি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মেজর অপারেশন হয়েছে ১০১ জনের আর মাইনর অপারেশন হয়েছে ১৯৮ জনের।

মেজর অপারেশনের মধ্যে হার্নিয়ার, হাইড্রোসিল, গোল ব্লাডার, লিভার কিডনি, পাইলস ইত্যাদি অপারেশন করা হত। চিকিৎসক না থাকার কারণে এসব অপারেশন প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে হৃদরোগ, চর্ম ও যৌন, নাক-কান গলার চিকিৎসক নেই। গুরুত্বপূর্ণ এসব চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার যেই অপারেশন হাসপাতালে আমরা ফ্রি করাই সেই অপারেশন বাইরে করতে গেলে ৭ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।'

তিনি আরও বলেন, ‘সার্জারি বিভাগে মেজর ও মাইনর দুই ধরনের অপারেশন করা হয়ে থাকে। চিকিৎসক না থাকার কারণে অপারেশন প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।’

পর্যবেক্ষযলণে দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী সংকট। নেই হাসপাতালে আধুনিক মানের যন্ত্রপাতি। মান্ধাতা আমলের কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ান। সংশ্লিষ্ট জনবলের অভাবে বিকল হয়ে আছে অনেক যন্ত্রপাতি।

অধিকাংশ হাসপাতালই অপরিচ্ছন্ন টয়লেটসহ পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই নাজুক। নোংরা টয়লেটের দুর্গন্ধে রোগীর স্বজনের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

জরুরি বিভাগ খোলা থাকলেও বহির্বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় ছোট দুর্ঘটনা, জ্বর, মাথা ও পেটে ব্যথা, পেটে সমস্যা, বমি এবং সর্দি-কাশির মতো অসুখে ভুক্তভোগীদের চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে হাসপাতালের ইনডোরে রোগীদের অবস্থা শোচনীয়।

ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। হাসপাতাল চত্বরে তারা সকাল থেকে ভিড় করে থাকেন।

শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় জেনারেল হাসপাতালে রোগীর আগমন বেশি। তবে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত জেলাবাসী।

(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :