১৫ই আগস্ট ১৯৭৫, ইতিহাসের জঘন্যতম কালো অধ্যায়

শেখ মুজিবের মৃত্যু ও বিশ্বমানবতার বিপর্যয়!

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
  প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০৯:১৪| আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৭
অ- অ+

পৃথিবীর সেরা রাজনীতিবিদগণের জন্য একটি দৈব মুকুট রয়েছে। অন্তর্দৃষ্টি অসীমতা লাভ না করলে বিষয়টির সঠিক আত্মোপলব্ধি করা সত্যিই সহজ কাজ নয়। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে পুঁজিবাদী জোট, সমাজতান্ত্রিক জোট দীর্ঘদিন ভাগাভাগি করে কেউ দিনে, কেউ রাতে এ মুকুটের স্বাদ গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তৃতীয় নেত্র (থার্ডআই) ওপেন হয়ে জোট নিরপেক্ষ আরেকটি শক্তি তাদের অস্তিত্বের জানান দিলে, এ মুকুট যতটা স্পর্শের কাছাকাছি এসেছিল পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রবাদীদের কাছে, তা যেন ক্রমশই আলেয়া রুপ ধারণ করতে থাকল। দৈব মুকুটে অলৌকিক মনস্তত্ত্বের উপস্থিতি থাকায় বিশ্বমানবতার সেবাদাস রুপে যে সকল বিশ্বনেতারা নিজেদেরকে তৈরি করতে পারেননি, শুধুমাত্র ক্ষমতার দৃশ্যমান মানদণ্ডে সেরা ক্ষমতাশালী নেতা হিসেবে আস্ফালন করেছেন, তারা প্রত্যেকেই প্রকৃত অর্থে এ মুকুট স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মানবতার স্খলনকারীদের শক্তি-সামর্থের সাথে এ ঐশ্বরিক মুকুট পরিধানের সম্পর্ক বৈরী এবং বিপরীত। পাওয়া, না পাওয়া কিংবা অন্য কেউ পেতে পারে, তা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রের ইতিহাস মানবসভ্যতায় অনেক অনেক প্রাচীন।

পৃথিবীর ইতিহাসে পঁচাত্তরের ১৫’ই আগস্ট রাজনীতির এ দৈব মুকুট যেন উপমহাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, তেমনি একটি বিশ্ব ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নে, নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন পৃথিবীর আকাশে বাংলার প্রান্তরে উদিত সূর্য, বিশ্ব মানবতার প্রতীক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব, শৌর্য-বীর্য, সাহস, মানুষকে আকৃষ্ট করার অতুলনীয় সম্মোহনী শক্তি এবং বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের শোষিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত, হতদরিদ্র মুক্তি সংগ্রামী মানুষ ও মানবতার পক্ষে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বনেতাদের কাছে তাঁকে যতটাই আকর্ষণীয় করে তুলেছিল, বিপরীতে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ঈর্ষণীয় হয়ে উঠছিলেন বিশ্বের 'শান্তি ও মানবতার প্রতীক' হিসেবে। অদূর ভবিষ্যতে পরাশক্তিসম্পন্ন নেতাদের ছাড়িয়ে মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে সে সময় শেখ মুজিবের সমান্তরালে দৌঁড়ানোর মত আর কোনো বিশ্বনেতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অনেকেই একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে বিষয়টিকে দেখবার চেষ্টা করলেও, বঙ্গবন্ধুর পূর্বে জেলখানায় অবরুদ্ধ থেকেও একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেয়া যায়, এমনতর অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার আর কোনো উদাহরণ ছিলনা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে। সে সময় বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে একটু দেখতে পাওয়া, করমর্দন করা কিংবা পাশে বসে আলাপচারিতার ছলে ক্যামেরা বন্দী হওয়ার অধীর আগ্রহ, লোভ ও ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে অনেক বিশ্বনেতার বক্তব্য থেকে।

বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত হওয়া কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।”

ব্রিটিশ লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেন, “শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং ডি ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।”

ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়ে বলেন, “আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।”

বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেন সেদিন শোক দিবস পালন করেন। এমন কি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে জি মোস্তফাকে সেদিনই ইরাক থেকে বের করে দেন। সংক্ষুব্ধ আচরণ করে সাত দিনের মধ্যে বাকিতে দেওয়া ইরাকি তেলের টাকা পরিশোধের হুকুম দেন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।”

বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এতটা দুঃখ পেয়েছিলেন যে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- “তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।”

বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ সম্মান ও একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, “তিনি তাঁর দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অন্য দেশের কারাগারে থেকে, শুধু তাঁর নামের জাদুমন্ত্রে পৃথিবীর ভৌগোলিক রেখা পরিবর্তন করে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটান। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির নেই।” তিনি আরও জানান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেদিন মালয়েশিয়ার মসজিদে তাঁর জন্য দোয়া করা হয় যেন আল্লাহ ইসলামের মহান খলিফাদের সঙ্গে শেখ মুজিবকে বেহেশত নসিব করেন।

লৌকিকতা ছাড়ালেই কেবল একজন মানুষের পক্ষে এমন উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব। ঈর্ষান্বিত হয়ে শেখ মুজিব বেঁচে থাকতে এমনতর বিশ্বাস প্রকাশে জোর করে মুখে কুলুপ আটকে রাখলেও, শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরে শত্রু-মিত্র সকল কাতারের অনেক বিশ্বনেতাই নিঃসংকোচে এমন মার্গীয় ব্যক্তিত্বের উচ্চতা নিয়ে সত্য প্রকাশ করে প্রশংসিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। মতামত পর্যালোচনায় একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে, মতামত প্রদানকারী বেশিরভাগ নেতা তাদের নিজেকে ছাড়িয়ে তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষ তাদের দেখা তুলনামূলক বিশ্লেষণে, বিশ্ব জাতীয়তাবাদী ও মানবতাবাদী নেতাদের মধ্যেও অন্যতম হিসেবে দেখার চিত্রটি তাদের বক্তব্যে ফুঁটে উঠেছে বেশ পরিষ্কার ভাবে। ভারতের খ্যাতনামা সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর দৃষ্টিতে, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো নেতাকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ মনে করতেন না। বরং, আফসোস করে বলতেন ভারতের নেতারা তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ করতে শেখাননি, তারা ভারতীয়দের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে পরিচিত করাতে পারেননি, যা একমাত্র বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মানুষকে এ বীরোচিত সম্মানে বিশ্ববাসীর সামনে পরিচিত করাতে সক্ষম হয়েছেন। খানিকটা তুলনামূলক বিচারে তিনি কেবলমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

স্মার্টনেস বিচারে বিশ্ব প্ল্যাটফর্মে সে সময় বঙ্গবন্ধুর ‘স্টাইল’, বিশেষ করে পায়ের উপরে পা তুলে বসার যে রাজকীয় ধরণ, ‘ফ্যাশন’ বিবেচনায় ব্যবহৃত পাইপ ও সুগন্ধি এরিনমোর তামাক, চেষ্ট কোট, সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা এবং সেই সাথে দীর্ঘকায় শারীরিক গঠন, দীপ্তিময় দৃষ্টিশক্তি, দরাজ কন্ঠ প্রভৃতি মিলিয়ে যে সামগ্রিক অভিব্যক্তি ফুঁটে উঠতো, তুলনামূলক শারীরিক ভাষার শৈল্পিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ বিশ্বে আর হয়তো একজন নেতাও ছিলেন না তখন। সেই সাথে বক্তব্য কিংবা ভাষণ প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর বাগ্মিতা ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সমন্বিত সৌন্দর্য ছিল অনন্যসাধারণ। অন্তত, সমসাময়িক কালে তুলনা করার মতো বিশ্বে কেউ ছিলেন বলে আমার জানা নেই।

বঙ্গবন্ধুকে তুলনামূলক উচ্চতায় ঈর্ষা করার মত শত শত জানা ঘটনা যেমন রয়েছে, তেমনি অজানা ঘটনা রয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি। সময়ের প্রবাহমানতায় সামান্য কিছু আরও হয়তো বা জানা যাবে তাঁর মহান কীর্তি, তবুও তার অজানাই রয়ে যাবে বেশিটুকু। কেননা, মরণোত্তর শেখ মুজিবের মাথায় যেন সেই দৈব মুকুট দৃশ্যমান হতে না পারে, সে চেষ্টার ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত রয়েছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতা মূলত অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য থেকে যুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পতম সময়ে ছিনিয়ে আনা সোনালী ফসল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেই পেরেছিলেন। ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলার কারণটি হল, আমাদের যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ যেমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল, তেমনি করে এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আমেরিকার সরাসরি অংশগ্রহণ, আর তা রুখে দেবার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ এবং ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। প্রকট ও প্রচ্ছন্ন ভাবে আমেরিকা তথা পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন করা, তেমনি ভারত রাশিয়ার বাইরেও কিছু বন্ধুরাষ্ট্রের মানবিক সমর্থন ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, আমেরিকান নিক্সন প্রশাসন এক পর্যায়ে তার বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কড়া হুশিয়ারি ও সতর্ক করতে বাধ্য হন এই মর্মে যে, জেলখানায় বঙ্গবন্ধুকে আটকে রেখে বিলম্ব করা হলে কিংবা অন্যথা কিছু ঘটালে সারাবিশ্ব বিস্ফোরন্মুখ হয়ে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যাবে। এমন কি, আমেরিকা ও পাকিস্তান তাদের বৈশ্বিক সমর্থন হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর বিজয় যেমন মিত্র দেশগুলির বিজয়, বিপরীতে পাকিস্তানের পরাজয় তথা আমেরিকা আর পশ্চিমাদের পরাজয় হিসেবেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সে বিবেচনা থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য থেকে অর্জিত সাফল্য বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। সহজ কথায়, বঙ্গবন্ধুই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক, যাঁর সাফল্যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক বাঙালি জাতিরাষ্ট্র। গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিনির্ভর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠি সকল বিবেচনায় সকলের সাংবিধানিক সমঅধিকারের ভিত্তিতে রচিত ধর্মনিরপেক্ষতা, আর কৃষ্টি, কালচার, শিল্প-সাহিত্য সকল বিবেচনায় নিজস্বতা সম্পন্ন স্বকীয় সমাজতন্ত্র, এই ছিল তাঁর বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের মূলভিত্তি।

হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের তরঙ্গ এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে, এমন কি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা অনুরণিত হয়েছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত আর কোনো নেতা পাওয়া বিরল, যার অনুপ্রেরণা হৃদয়ে ধারণ করে অন্য কোনো দেশের যোদ্ধারা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এ পর্যালোচনায় শ্রদ্ধাঞ্জলি রেখে বলতেই হয় ‘বঙ্গবন্ধু ইজ দ্যা গ্রেটেষ্ট’। তৎকালীন সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে আর কোনো বিশ্ব নেতাকে এ আলোচনায় নিয়ে আসা খুবই দুষ্কর, যার ব্যক্তিগত ইমেজ বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করা যায়। প্রসঙ্গক্রমে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বিষয়ক আলোচনায় দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলেও, খুব সহজ করে যা বলা হয় তা হল- নিক্সন প্রশাসনের সিআইএ, পাকিস্তানের কেজিবি দেশের অভ্যন্তরে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লুটেরা, পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী মৌলবাদী চরিত্রের রাজাকার-আলবদরদের ভূমিকা, ক্ষমতার চেয়ারে বসতে না পারা ক্ষমতালোভী ভ্রান্ত কিছু ভিন্ন মতাদর্শী রাজনৈতিক তরুণদের জিঘাংসা, সেই সাথে পথভ্রষ্ট বিকৃত মানসিকতার বিপথগামী সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংস তাণ্ডব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খুনের শিকারে পরিণত করেছে।

গবেষক বিশ্লেষকদের এসকল মতামত যেমন সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বীকার্য, সেই সাথে বিশ্লেষণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বেশিরভাগ গবেষকেরাই পরিস্থিতি বিবেচনায় হয় এড়িয়ে গিয়েছেন, নতুবা এ ভাবনা থেকে কৌশলে বিরত থাকার চেষ্টা করেছেন কিংবা দৃষ্টির সীমানাকে এক্ষেত্রে প্রশস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুপক্ষের দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা এতটা সহজে কি করে এমন নৃশংস খুন করার দুঃসাহসকে বাস্তবে পরিণত করতে সক্ষম হল? বাংলার আকাশে সূর্য অস্তমিত করতে যে ষড়যন্ত্রের জন্ম হয়েছিল, এমনটা হতে পারে বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শুভাকাঙ্ক্ষী কোনো কোনো বিশ্বনেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছেন যে আশংকা থেকে, সে আশঙ্কাকে রুখে দেবার ক্ষেত্রে তাদের শিথিল মনোভাব প্রদর্শন কিংবা রহস্যজনকভাবে নীরব থাকার বিষয়টি ইতিহাসের চোখকে এড়াতে পারে না।

বিশ্বের নজিরবিহীন যুদ্ধ ইতিহাসের এই ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সৈন্যদলকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি সহাস্যে করলেও, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের কিছু অংশ ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদগণ এবং ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনুযোগের সুর অনুরণিত হয়েছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তদুপরি, তাড়াহুড়ো করে বঙ্গবন্ধুর ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সাথে সখ্যতা তৈরীর প্রবণতায় ভারতীয় সমালোচকদের চাপে স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা প্রচেষ্টায় যতটুকু আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তা প্রশংসনীয় হলেও যথেষ্ঠ ছিল কিনা কিংবা আরও উত্তম বিকল্প সহযোগীতার হাত বাড়ানোর সুযোগ ছিল কিনা যে রূপের আলোয় আলোকিত করে আমাদেরকে চিরস্থায়ী করেছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে, সে আফসোস থেকেই যায়। ভাতৃপ্রতিম বন্ধু রাষ্ট্রের অনন্য ভূমিকা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, তা দিবালোকের মত সত্য। এমন বন্ধুর অনুযোগে অন্যতম প্রধান অনুঘটকের কাজ করে থাকতে পারেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। বৃটেনের রাজকীয় প্রটোকল ভেঙে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ৮’ই জানুয়ারি ১৯৭১ এ বরণ করে নিতে তিনি যে নাটকীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সর্বমহলে অত্যন্ত প্রশংসিত। কিন্তু, বিশ্ব ইতিহাসে রয়্যাল প্রেসিডেন্টের নির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়নের তিনি যে অতিমাত্রার আড়ম্বর দেখিয়েছিলেন, তা ব্রিটেনের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি ঘটেনি বলে অনেক ব্রিটিশ নাগরিক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সেই অতি উৎসাহের সঙ্গত কারণ খুঁজে পান নি। কিন্তু- ‘মনের কথা জানে গোবিন্দ’, হয়তো এডওয়ার্ড হিথের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারেনি সেদিন অনেক বিশ্বনেতারাও। যে কাজটি পাকিস্তানিরা করতে পারেননি জেল জুলুম কিংবা অস্ত্রের মুখে, সে কাজটি খুব সহজে করতে পেরেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। জাতিরাষ্ট্র জন্মের প্রসঙ্গটি যেহেতু নিশ্চিত হয়েছে, আলাপচারিতায় সমর্থনের প্রসঙ্গটি প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে মিশিয়ে দিলেন অনুযোগের বিষবাষ্প এতটা সুকৌশলে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি যেন স্বদেশ ফেরার পথেই বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দেন। কারণ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়েছিল এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে তিনি ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসবেন এ বিষয়টি জানতেন এডওয়ার্ড হিথ। আর সেখানেই তিনি সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন ধারণা করা যেতে পারে। ফলে শুরুতেই বৃটেনের সমর্থনের প্রয়োজনে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে উন্নত বন্ধুত্বের অধিকারে বঙ্গবন্ধু বিষয়টিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন। সেদিন অনুযোগের সাথে ঈর্ষান্বিত হওয়ার মতো কোনো প্রেক্ষাপট কংগ্রেস রাজনীতিতে জন্ম নিয়েছিল কিনা, সে বিষয়টি গবেষণা ছাড়া বলা মুশকিল। হয়ত বা জন্মেনি, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দল হিসেবে কংগ্রেস দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, সে দিনের সে আলোচনায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের অব্যবহিত পর যে সকল গভীর সংকট মোকাবেলা করতে হবে, সে প্রেক্ষাপটে এত দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের অসুবিধাটুকু বন্ধু হিসেবে আলোচনায় আনার প্রাসঙ্গিকতা অনুভব করতেই পারি। তার কতটুকু আলোচিত হয়েছিল আমার জানা নেই, তবে বিশ্বের চিরাচরিত নিয়মে যদি কিছু সংখ্যক ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরও কিছু কাল থাকতো, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হত কিনা, কিংবা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র এত সহজে বাস্তব রূপ লাভ করতে পারতো কিনা, এক কথায় পঁচাত্তরের ১৫’ই আগস্টের ভয়াবহতা এত দ্রুত বাংলার মাটিতে সংগঠিত হত কিনা, সে সকল প্রশ্নের উত্তর জানবার আগ্রহ ইতিহাসবেত্তাদের থেকেই যাবে। বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হলে তা ভারতের কংগ্রেসের রাজনীতিকেও যে প্রভাবিত করবে, সে সময়ের কংগ্রেস তা উপলব্ধি করতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মাত্র কুড়ি পঁচিশ বছরের মাথায় সে অন্ধকার এমনভাবেই ধরা দিয়েছে যে, আজ ধরাশায়ী কংগ্রেসের বুক চিরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা গেলে আজকে কংগ্রেসের রাজনীতির ভাগ্যেও হয়তো এত দ্রুত পতনের মুখ দেখতে হতো না। আর রাজনীতিতে যারা সবসময়ই অন্যের চাক থেকে মধু আহরণ করে বেঁচে থেকেও মানুষের মাঝে তাদেরকে অতি প্রয়োজনীয় ভাবতেন, ভারতীয় রাজনীতির সঙ্কটকালে বিগত নির্বাচনে কলকাতা ভিত্তিক কমিউনিস্টরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে তাদের সমর্থনের নজিরও হয়ত সৃষ্টি হত না। সময়ের বর্তমানে এ কথা বলাই যায় পুরো ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যেমন দুর্বল হয়েছে, সেই সাথে বামপন্থী রাজনীতির কবরও রচিত হয়েছে। বিশ্লেষণের এ প্রেক্ষাপটে আমরা অনেক সৌভাগ্যবান, বাংলাদেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের চেতনা তথা বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের চর্চায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। প্রাজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর সাফল্যের ইতিহাস বিশ্বে সমাদৃত ঠিকই, কিন্তু দেশী-বিদেশী ঈর্ষান্বিত রাজনৈতিক চরিত্রের ষড়যন্ত্র তাঁরও প্রাণ কেঁড়ে নেবার উন্মত্ত নেশায় মত্ত তা সহজেই বলা যায়। দৈব আশীর্বাদেই তিনি বার বার প্রাণে বেঁচে আমাদেরকে শেষ বিন্দু পর্যন্ত দিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাথায় শোভিত দৈবমুকুটের আলোকাশীর্বাদে আমরা এখনও আলোর পথেই হেঁটে চলেছি।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ফরিদপুরে দেড় লাখ টাকায় ‘বিক্রি হওয়া’ সেই শিশু উদ্ধার
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল ইসি
ঝিকরগাছায় পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্য
পরমাণু যুদ্ধের হুমকি ভারত সহ্য করবে না: মোদি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা