ঢাকা টাইমস একান্ত

আমরা আগে নগর গড়ি, তারপর পরিকল্পনা করি: অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল

অনলাইন ডেস্ক
| আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৩ | প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৪

মাঝে-মধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ। সর্বশেষ শনিবার সকালে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে সৃষ্ট ভূমিকম্পে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা কেঁপে ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ভূমিকম্প নিয়ে ঢাকা টাইমসের মুখোমুখী হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শেখ শাকিল হোসেন

কেন ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে?

ড. মাকসুদ কামাল: বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের এই অঞ্চলে বড় বড় ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য-প্রমাণ আছে। যদি কোনো অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের অতীত ইতিহাস থাকে, তার অর্থই হল, একটা নির্দিষ্ট সময় পর ওই অঞ্চলে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হবে। আমাদের যে ভূতাত্ত্বিক প্লেট আছে, যেমন- ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ সাব-প্লেট, সবগুলোই সক্রিয়। বাংলাদেশ এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এ কারণে অতীতে এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়েছে এবং এখনো বড় ভূমিকম্প হওয়ার মতো ভূতাত্ত্বিক অবকাঠামো বিরাজমান।

১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বড় ভূমিকম্প হচ্ছে না। কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরে এর সঞ্চারণশীলতা আছে। এ কারণে এখানে থাকা ভূতাত্ত্বিক ফাটলরেখাগুলো বেশি পরিমাণে এনার্জি স্টোর করে রাখতে পারে না। ভূমিকম্প তখনই হয় যখন ভূতাত্ত্বিক ফাটলরেখাগুলোর এনার্জি স্টোর করে রাখার ইলাস্টিক লিমিট থাকে না। এ বছর অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে যাদের মাত্রা ৫ এর কম-বেশি। আমাদের এই অঞ্চলে ‘নিউ টেকটনিক ফল্ট’ থেকে মাঝারি মাত্রার কিংবা মাঝারি থেকে একটু নিচের মাত্রার ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে।

মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে এত তীব্রতা অনুভবের কারণ কী?

ড. মাকসুদ কামাল: সর্বশেষ ভূমিকম্পের কথাই ধরি। লক্ষ্মীপুর-কুমিল্লা অঞ্চলে পলিমাটির পুরুত্ব মোটামুটি ২০ কিলোমিটার। এর পরেই আছে ভূত্বক। রামগঞ্জের ভূমিকম্পটি গভীর ভূত্বকে হয়েছে। এই ভূমিকম্পকে আমরা বলি ‘ডিপ ক্রাস্টাল আর্থকুয়েক’। আমাদের অঞ্চলে এ ধরনের ভূমিকম্পের বৈশিষ্ট হলো– ডিপ ক্রাস্টাল ফল্টগুলো ৫ বা ৪ কিংবা সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে ভবন তৈরি করা হলে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ ভূমিকম্পের কারণে আমরা এত ঝাঁকুনি অনুভব করতাম না। এ ভূমিকম্পে আমরা যে তীব্রতা অনুভব করেছি, সাধারণত ৫ দশমিক ৩ থেকে ৫ দশমিক ৫ ম্যাগনিটিউড মাত্রার ভূমিকম্পে এ তীব্রতা অনুভূত হবার কথা নয়। এ তীব্রতা অনুভূত হওয়ার মূল কারণ হলো আমাদের অবকাঠামোগুলো ভূমিকম্প-তরঙ্গ সহনীয় নয়। আমরা ঘরের আসবাবপত্রগুলো ভূমিকম্পের কথা বিবেচনা করে ঘরের মধ্যে সেগুলোর অবস্থান কোথায় হবে, সেটি নির্ধারণ করি না। এগুলোকে আমরা বলি নন-স্ট্রাকচারাল এলিমেন্টস। আর ভবনের কাঠামোকে বলি স্ট্রাকচারাল এলিমেন্টস। আমাদের দেশের স্ট্রাকচারাল এবং নন স্ট্রাকচারাল এলিমেন্টস দুটোই অপরিকল্পিতভাবে হয়। এজন্য মাঝারি মাত্রার ৫ ম্যাগনিটিউডের একটি ভূমিকম্পের তীব্রতা ৬ ম্যাগনিটিউডের মতো অনুভূত হচ্ছে।’

অপরিকল্পিত নগরায়ন সম্পর্কে কী বলবেন?

ড. মাকসুদ কামাল: আমাদের দেশে আগে আমরা নগর গড়ে তুলি, তারপর পরিকল্পনা করি। কিন্তু উন্নত দেশে, এমনকি আমাদের মতো কিছু দেশেও আগে পরিকল্পনা করা হয় তারপর কোথায় স্কুল হবে, কলেজ হবে, কোথায় সরকারি স্থাপনা হবে, কোথায় হাসপাতাল হবে– এগুলো নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশে আগে হাসপাতাল করে তারপর ‘এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ করা হয়েছে এমন নজিরও আমার জানা আছে।

কিছু কিছু হাসপাতাল এমন জায়গায় করা হয়েছে যেগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি হলো আমাদের কালচার। এগুলোই প্রকৃত অর্থে নগরের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ভূমিকম্পের তীব্রতা ৬ এর ওপরে হলে দুর্বল অবকাঠামো ভেঙে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। যদি ৬ ম্যাগনিটিউডের ভূমিকম্প হয় তাহলে তীব্রতা ৭ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামেও বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। এই ভবনগুলো ‘বিল্ডিং কোড’ সম্পর্কে অবহিত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের সহযোগিতা না নিয়েই তৈরি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটি হলো, যখন কোনো পরিকল্পনা হবে তখন কোন এলাকা কিসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেটা বিবেচনায় রেখে অবকাঠামো তৈয়ার করতে হবে। সরকারকে ‘বিল্ডিং কোড’ শক্ত আইনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইন না মানলে সাজার কথাও বলা আছে। কিন্তু তারও বাস্তবায়ন নেই। যারা মানবে না তাদের জন্য সাজার ব্যবস্থা করা উচিত।

ঢাকার ঝুঁকি কি বাড়ছে?

ড. মাকসুদ কামাল: ঢাকার আপদ কম, কিন্তু বিপদ বেশি। চট্রগ্রাম-সিলেটের তুলনায় ভূমিকম্পের আপদের দিক দিয়ে ঢাকার ঝুঁকি কম। কিন্তু ঢাকা যেহেতু রাজধানী এবং এখানে ভবনের পরিমাণ বেশি, এজন্য ঢাকার বিপদাপন্নতা বেশি। কারণ, ঢাকা হচ্ছে পুরাতন শহর নিয়ে। এখানে অনেক পুরাতন ভবন আছে। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার-অনুসন্ধানের জন্য যানবাহন নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রবেশও কঠিন। রাস্তার যে প্রশস্ততা থাকা দরকার সেটিও নেই। এসব কারণে ঢাকার বিপদাপন্নতা বেশি।

ভূমিকম্পে ঝুঁকি কমাতে আপনার পরামর্শ কী?

ড. মাকসুদ কামাল: বর্তমানে প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ বা তারও কম মানুষ শহরে বসবাস করে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে দেশের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। সেজন্য ভবিষ্যতে যেখানে নগরায়ন হবে, সে জায়গাটি যাতে পরিকল্পিতভাবে এবং ‘ঝুঁকি’ বিবেচনায় রেখে হয়। স্কুল, কলেজে, হাসপাতাল, প্রভৃতিকে আমরা ‘কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন’ বলি। এগুলো করার সময় যেখানে মাটি ভালো, যে জায়গার মাটির কম্পন কম অনুভূত হবে, সেখানে কত তলা ভবন করা উচিত, এগুলো বিবেচনায় রেখে যদি ভবন তৈরি করা হয়, তাহলে গোড়াতেই ঝুঁকিটা কমিয়ে নিয়ে আসা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোথায় কোন ধরনের স্থাপনা দরকার, সেটি যদি আমরা নির্ধারণ করি, তাহলে ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে নিয়ে আসা যাবে।

শনিবারের ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। উপাচার্য হিসেবে আপনি কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

ড. মাকসুদ কামাল: শনিবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র আবাসিক হল থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছে। অনেকে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে আহত হয়েছে। ভূমিকম্প চলাকালীন সময় কী করণীয়, এই সচেতনতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কী করণীয় সেটা নির্ধারণ করতে প্রভোস্ট স্টান্ডিং কমিটির সভা ডেকেছি। প্রত্যেকটি হল এবং হোস্টেলে আমরা ‘পরিবেশ ও দুর্যোগ সচেতনতা’ বিষয়ক ক্লাব করব। সেই ক্লাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আমাদের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র আছে কিন্তু এটা কিভাবে চালাতে হবে সেটা নিয়ে ধারণা নেই। ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে কি করণীয় সেটি অবহিত করা এবং হলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যাতে আরও বাড়ানো যায়, এসব বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হবে। যারা এই ক্লাবের সদস্য হবে আমরা তাদের সার্টিফিকেট দিব। এমন পরিকল্পনা বিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেয়া উচিত। আমার অনুরোধ, বিষয়গুলো যাতে স্কুল পর্যায়ে টেক্সটবুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। প্রত্যেকটি ভবনে একটি ‘ইভাকুয়েশন’ রোড থাকতে হবে। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম ইভাকুয়েশন রোড, ভূমিকম্প হলে শিক্ষার্থীরা কোন জায়গায় দাঁড়াবে, কতক্ষণ দাঁড়াবে, ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে তারা সিঁড়ি দিয়ে নামবে কিনা, লিফট ব্যবহার করবে কিনা, এই ধারণাগুলোর স্বল্পতা আছে। আমরা ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, এসব উদ্যোগ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়বে।

(ঢাকাটাইমস/৩ডিসেম্বর/এসকে/জেডএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

বেড়ার মেয়র আসিফ ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, দেশ ছাড়লেন কীভাবে? কৌতূহল সর্বত্র

শিক্ষকদের পেনশনের টেনসনে স্থবির উচ্চশিক্ষা

কেরাণীগঞ্জে দেড় কোটি টাকার নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরুর সন্ধান

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর উদ্যোগ কতটা গ্রহণযোগ্য? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

সর্বজনীন পেনশনে অনীহা কেন, যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনেতারা

সাদিক অ্যাগ্রোর সবই ছিল চটক

ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কমিটি দিতে ধীরগতি যে কারণে

রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নেই চিকিৎসা সক্ষমতা

মাগুরায় বাড়ি-জমি উত্তম কুমারের: কোথাও খোঁজ নেই তার, দুদকের অনুসন্ধান সম্পন্ন

কোথায় পালিয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার, জানে না পুলিশ, স্থায়ী বরখাস্ত হলেই ডুমাইনে ভোট

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :