একান্ত সাক্ষাৎকারে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ
প্রথম আক্রমণ করলাম আখাউড়ার সিংগারবিল
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন তখনই যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। চাচার বয়সি একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে আমরা ৮ জন ট্রেনিং নিতে ৩১ আগস্ট ভারতে যাই। সেখানে এক মাস প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর প্রথম আক্রমণ করি আখাউড়ার সিংগারবিলে। এতে ঘটনাস্থলেই তাদের একজন ক্যাপ্টেনকে মারা যেতে দেখি। পরের দিন সিংগারবিলে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মরে পড়ে আছে। এর কয়েক দিন পর সিলেটের মাধবপুরে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রায় ৭০০ পাকিস্তানি সেনা অস্ত্রসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে টানা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আসে সেই কাক্সিক্ষত বিজয়। যে বিজয়লাভের জন্য আমরা খেয়ে না খেয়ে জীবনবাজি রেখে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। এভাবেই একাত্তরের রণাঙ্গনের স্মৃতিকথা ঢাকা টাইমসের কাছে তুলে ধরেন শরীয়তপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এম মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।
বৃহস্পতিবার একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মা-বাবা ভাই-বোনের মায়া ছেড়ে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থেকে যুদ্ধ করেছি। চোখের সামনেই অনেক সহযোদ্ধাকে হত্যা করতে দেখিছি, যা মনে হলে খুব কষ্ট লাগে।
ভারতে প্রশিক্ষণে কীভাবে গেলেন তার রয়েছে নানা গল্প। তিনি বলেন, একদিন আমরা নৌকাযোগে কুমিল্লার ষাটনল এলাকায় গেলাম। ওখান থেকে কুমিল্লার চান্দিনা গেলাম, চান্দিনা থেকে গোমতী পার হয়ে গেলাম দিঘিরপাড়, এরপর আরও কিছু এলাকা অতিক্রম করে কোনাবন দিয়ে আমাদের ইন্ডিয়ায় যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল। এই জায়গাটুকু পার হতে আমাদের ছয় দিন সময় লাগে। কেননা আমরা রাতের বেলা যখনই প্রস্তুতি নিই ঠিক তখনই কোনো না কোনো সমস্যার কারণে বের হতে পারি না। পাকিস্তানি আর্মিদের টহল ছিল যার কারণে আমাদের অনেক সময় লাগে।
আমাদেরকে সেখান থেকে ছয় সেপ্টেম্বর হাপানিয়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়, তারপর সেখানে আমাদের সময় কাটতে থাকে। আমরা রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছু নিজেরাই করতাম। সেখানে ৭০ ফুট নিচ থেকে পানি তুলে আমাদের রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজকর্ম চলত এবং আমরা নিজেরাই পরিবেশন করতাম, সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল। অক্টোবরের দুই তারিখে আমরা শুনলাম যে ক্যাপ্টেন নাসির সাহেব আসছেন আর্মিতে লোক রিক্রুট করার জন্য। এই কথা শুনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা ৯ জনের মধ্যে তিনজন রিক্রুট হলাম। ২ তারিখে রিপোর্ট করার পর ওনারা চলে গেলেন। এরপর আরো একটু পরে এসে আমাদেরকে নিয়ে গেল ফটিকছড়ি। সেখানেই আমাদের ট্রেনিং শুরু হবে। এই ফটিকছড়িতেই ছিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, আমরা সেখানে ১১ তারিখ পৌঁছালাম এবং ১৮ তারিখে আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। ভোর পাঁচটা থেকে শুরু করে দেড়টা পর্যন্ত আমাদের ট্রেনিং হতো, সকালে কিছুক্ষণ শরীর চর্চা করার পর এসে আমরা রুটি আর এক মগ চা দিয়ে সকালে নাস্তা করতাম। আমরা এগুলো খেয়ে চলে যেতাম আবার ট্রেনিং গ্রাউন্ডে এবং সেখানে একটা-দেড়টা পর্যন্ত ট্রেনিং হতো। ট্রেনিং শেষ করে আবার তাঁবুতে এসে গোসল করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতাম, এরপর ট্রেনিংয়ের সঙ্গে ছিল ডিউটি একেক দিন রাতে একেক গ্রুপের এবং দিনে ভাগ করে বিভিন্ন জায়গাতে ডিউটি করতে হতো আমাদের। আমি ট্রেনিংয়ে খুব ভালো করেছিলাম, এই জন্য আমাকে প্লাটুন টুআইসিতে সুযোগ দেয় এবং আমাদের যিনি ল্যান্সনায়ক ছিলেন তাকে বিভিন্ন কাজ এবং অন্যদের ডিউটি ভাগ করার কাজে সহযোগিতা করতাম। এভাবে দীর্ঘ এক মাস আমাদের ট্রেনিং চলে। হ্যান্ড গ্রেনেড রাইফেল এলএমজি এসএমজি সাবমেশিনগান টুইস্ট মটার থ্রি ইন্সমটার ও অন্যান্য অস্ত্রের ওপর আমাদের ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং শেষে আবার নতুন করে ডাক এলো যে আমাদেরকে এখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে তিন ভাগে ভাগ করে। সেই মতে আমি সেকেন্ড বেঙ্গলে পড়ে গেলাম। সেকেন্ড বেঙ্গলের অবস্থা ছিল আমাদের পাশের পাহাড়ে, আমার সঙ্গে যারা পড়ল, আমরা সবাই মিলে ওই পাহাড়ে চলে গেলাম এবং সেখানে কিছুদিন থাকার পর নভেম্বরের শেষের দিকে শুরু হলো আমাদের শত্রুর ওপর আঘাত হানার সময় এবং নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা প্রস্তুতি নিতে রাখলাম এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ৬ তারিখে আমরা প্রথম আক্রমণ করলাম আখাউড়ার সিংগারবিল। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা থেকে সেলিং আর ইন্ডিয়ানরা আগরতলা থেকে সেলিং করে। এই যুদ্ধে আমাদের একজন ক্যাপ্টেন মারা যায় এবং আমরা সেখানে আত্মগোপন করি। সেই অবস্থায় একটি টিয়ারশেল এসে আমাদের একজনের ওপর পড়ে এবং সেখানে সে মারা যায়। এরপরের দিন আমাদের ব্যাটেলিয়ন সিঙ্গারবিলে যায় এবং দেখি অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মরে পড়ে আছে এবং আমরা বুঝতে পারি যে আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। এরপর আমরা আবার ফিরে গেলাম আগরতলায়।
আমাদের ব্যাটেলিয়ন আবার গেল সিলেটের মাধবপুর। সেখানে গিয়ে আমরা কয়েক দিন অবস্থান করলাম। সেখানে প্রায় সাতশ রাজাকার আমাদের এখানে আত্মসমর্পণ করল এবং তারা সব অস্ত্রসমর্পণ করল। এর মধ্যে একটা অঘটন ঘটল। সিলেট-চট্টগ্রাম রোড পার হওয়ার সময় আমাদের সেকেন্ড বেঙ্গলের সিও নাসির সাহেবের তলপেটে গুলি লাগলো এবং রফিক নামের একজন হাবিলদার মারা গেল। সেখানে আমরা কিছু দিন অবস্থান করার পর আবার রওনা দিলাম কুমিল্লার দিকে। কুমিল্লা থেকে গেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এরপর আশুগঞ্জ আখাউড়া হয়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। এর মধ্যে রাতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের অনেক যুদ্ধ হয়েছে। আমরা আগাইছি এবং তারা পিছিয়েছে। এভাবে আমরা আশুগঞ্জ পার হয়ে ঢাকার উদ্দেশে যখন যাচ্ছি তখন আমরা মুড়াপাড়ায় কয়েকদিন যুদ্ধ করে আসি। শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে নারায়ণগঞ্জের ডেমরায় অবস্থান করলাম। ১৫ তারিখ রাতে আমরা সেখানে আসলাম কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে আমরা একটা ব্যাটালিয়ন সেখানে এসে বসে আছি। ১৬ তারিখে যখন স্বাধীনতার ঘোষণা হলো তখন আমরা ডেমরা থেকে স্টেডিয়ামে আসি এবং সেখানে দুই দিন অবস্থান করি এবং আমরা চলে গেছি রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে গিয়ে আমাদের তাঁবু টানানো হয় এবং ওখানে আমরা দীর্ঘদিন অবস্থান করি। জানুয়ারি ২৯ তারিখে কোরবানি ঈদ হয়েছিল। সে ঈদের পর মিরপুর ১২ নম্বরে অনেক পাকিস্তানি অস্ত্র জমা দেবে সেগুলো আনার জন্য আমাদের সিও সাহেব মইনুল হোসেন চৌধুরী (সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও) অর্ডার করলেন যে আগামীকাল ৩০ তারিখ যেতে হবে মিরপুর ১২ নম্বরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঈদের দিন দুপুরের খাবার খেয়েই রাতের মধ্যে ট্রাক করে চলে গেলাম মিরপুর ১২ নম্বরে। সারারাত মিরপুর ১২ নম্বরের এদিক সেদিক ঘুরাফেরা এবং সেদিকের পরিস্থিতি অবজারভেশন করা এবং তারপর ৩০ জানুয়ারি ভোর ছয়টায় আমরা ১২ নম্বরে ঢুকে পড়ি। ঢুকে পড়েই আমরা সেখানে অবস্থান নেই এবং অবস্থান নেওয়ার পর দেখি কোনো রুমে কোনো পুরুষ লোক নাই, সেখানে কয়েকটা রুমের ভেতরে তখন আমাদের কমান্ডার আমাদেরকে বলল যে তোমরা ছাদের ওপর উঠে এদিক সেদিকে দেখো যে কি অবস্থা। তার কথা মতোই সেখানে সবকিছু করা হচ্ছিল, ঠিক এই মুহূর্তে দেখা গেল কিছু লোক আমাদের দিকে গুলি করতে করতে আগাইতেছে। আমরা তখন আমাদের কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করলাম যে ঘটনা কি? তখন সে বলল এই লোকগুলো হচ্ছে মুক্তিফৌজ। তারা আমাদের সহযোগিতার জন্য আসতেছে। আমাদের একজন এলএমজি ম্যান এবং একজন হাবিলদার ১২ নম্বর পানির ট্যাংকের নিচে একটি মসজিদ ছিল। সেখানে অবস্থান নিলেন যারা আসতেছে তাদের প্রতিহত করার জন্য এবং আমরা তাদের পেছনে অবস্থান নিলাম এবং রাইফেল তাক করলাম যে কিছু দেখা যায় কি না। হঠাৎ দেখা গেল ওই এলএনজি নিয়ে যে অবস্থান করেছিল আবুল খায়েরের পিঠে গুলি লেগেছে, তার গুলি লাগার পর আমাদের হাবিলদার অলিউল্লাহ আমাদের এলএমজি ম্যান আবুল খায়েরকে মসজিদে নিয়ে রাখল।
মসজিদের রেখে মসজিদ থেকে বের হয়ে উনি যখন মসজিদের সামনে দাঁড়ালেন সে সময় একটা গুলি গিয়ে লাগলো তার বুকে, তিনি পড়ে গেলেন। এই দৃশ্য দেখে আমি ও ইকরামুল হকসহ কয়েকজন মিলে পূর্ব দিকে দেওয়াল টপকিয়ে ওপাশে গিয়ে দেখলাম যে আমাদের রেজিমেন্টের কিছু লোক সেখানে অবস্থান করছে। এই মুহূর্তে আমরা নিজেরাই হতভম্ব হয়ে গেছি এবং নিজেদের গ্রেনেড নিজেদের লোকদের উপরেই মারছি, আবার ওরাও গালাগালি করছে। আমাদের সঙ্গে এক সহকর্মী ছিলেন তার নাম ছিল আব্দুল হাই। হঠাৎ তার নাকের উপরে গুলি লাগলো এবং সে পড়ে গেল এই অবস্থা দেখে আমরা সবাই হতাশ হয়ে গেলাম। কি হবে, বসে বসে আমরা চিন্তা করছি যে দূর থেকে একটা বিল্ডিং এর ছাদের উপর থেকে আমাদের দিকে তাক করে গুলি করতেছে এবং আমরাও গুলি করতেছি। এইভাবেই চলছে কিন্তু কেউ বের হওয়ার মত সুযোগ নাই। এভাবে চলতে চলতে যখন আসর নামাজের আযান দিল। আমাদের সঙ্গে থাকা সুবেদার চান মিয়া আর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম সাহেব- উনারা এসে আমাদেরকে বলল এখন আর আমাদের এখানে বসার সময় নাই। এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে, যদি না বের হতে পারি তাহলে আমরা বাঁচতে পারব না। যা হোক আমরা সেখান থেকে উনাদের কথা মত সবাই মিলে ১০-১২ জন রাইফেল চতুর্দিকে তাক করে মিরপুর উত্তরের দিকে (তখন সেখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে) আমরা বের হই। এছাড়া বের হওয়ার আর কোনো রাস্তা ছিল না।
আমরা উত্তরদিকে বের হয়ে গেলাম এবং সেদিকে গিয়ে দেখি জমিতে ধান লাগানো ছিল এবং সেগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের এগোনো লাগবে এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিল হাবিলদার চান মিয়া। আর মিরপুর থানার ওসি, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম সাহেব, এছাড়া আরো ১০-১২ জন ছিল। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে ওইখানে গিয়ে যখন লাফিয়ে পড়লাম তখন আমরা সবাই কাদার ভেতর আটকে গেলাম। পিছন দিক থেকে বিহারীরা আমাদেরকে গুলি করছে এবং ইয়া আলি ইয়া আলি বলে এগিয়ে আসছে। এ সময় আমরা একটি জামা পরা অবস্থায় পানিতে ভেসে উপরে গিয়ে উঠলাম। ওপাড়ে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, তখন আমরা দেখতে পারলাম শেষ মুহূর্তে আমরা মাত্র তিনজন লোক- আমি, হাবিলদার চান মিয়া ও আরেকজন লোক। এই তিনজন ওখান থেকে বের হয়ে ওপাড়ে পৌঁছালাম। ওখান থেকে হেটে আমরা টঙ্গী যাই। সেখান থেকে একটা ট্রাক নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে আমাদের সিও সাহেবকে এ ব্যাপারে জানানো হয়। আর এই যুদ্ধে আমাদের প্রশিক্ষিত সুবেদার হাবিলদার লেন্সনায়ক- এরকম ৪০ জন লোক মারা যায়। আর সেই লাশ গুলো রেখেছিল পানির ট্যাংকির নিচে কারণ বহু বছর পর সেখানে অনেক মানুষের হাড় পাওয়া যায় এবং আমরা সে মনে করলাম যে এই সেই মানুষের লাশগুলোর হাড়গোড়, যারা ওই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল আমাদের সমস্ত লোককে ওই ওখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তারপর আমরা চলে আসলাম সেখানে আসি আমি পাঁচ তারিখে রিপোর্ট করলাম এবং বললাম যে আমি আর এখানে চাকরি করব না। তখন ৬ তারিখে আমাকে রিলিজ দেওয়া হয় এবং আমি বাড়িতে চলে আসি তারপরে লেখাপড়া শুরু করি।
(ঢাকাটাইমস/৮ডিসেম্বর/এমএইচ)