শেরপুরে ব্রি-২৯ ধানের চারায় গোড়া পচা রোগ, ব্যাপক ক্ষতির মুখে চাষিরা

শেরপুরের বিভিন্ন এলাকার বিপুল পরিমাণ জমিতে চলতি বোরো মৌসুমের ব্রি-২৯ ধানের সদ্য সবুজ হওয়া চারায় গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগী চাষিরা বলছেন, ধানের সবুজ পাতা ক্রমেই হলদে থেকে লাল বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। সার-কীটনাশক প্রয়োগ করেও কোনো সুফল না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।
অন্যদিকে জেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিপর্যয় ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ে বিষয়টি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, এবার জেলার সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮৯ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৯ জাতের ধানের আবাদ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শেরপুর সদর উপজেলার রৌহা বিল ও পাকুড়িয়া ইউনিয়নের খামারপাড়া, বাদাপাড়া, বাটিয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, ফকিরপাড়া এলাকায় যেসব কৃষক এবার ব্রি-২৯ ধান আবাদ করেছেন তারাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
রৌহা বিলে দেড় একর জমিতে ২৯ ধান লাগিয়ে ছিলেন শেখহাটি গ্রামের কৃষক রহমত আলী। গোড়া পচে তার সম্পূর্ণ ক্ষেতের ধানের চারাই নষ্ট হয়ে গেছে।
রহমত আলী বলেন, বড় আশা করে দেড় একর জমিতে ব্রি-২৯ ধান রোপন করেছিলাম। এখন ক্ষেত পচে সব নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষি অফিস থেকে দুইবার কীটনাশক প্রয়োগ করতে বলেছে। কিন্তু তা দেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি।
একই এলাকার কৃষক দোলা মিয়া বলেন, পাতা সবুজ হয়ে আসার পরপরই গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে। নানা ধরণের সার-বিষ দেয়া হলেও গাছ বাঁচানো যাচ্ছে না।
একই এলাকার আরেক কৃষক রুহুল কবির বলেন, ধান যদি না হয়, খাব কী, চলব কিভাবে আর ধার-কর্জ পরিশোধই বা করবো কেমনে।
শেখহাটি এলাকার কৃষাণী হাফেজা বেগম বলেন, তিন বিঘা জমিতে ব্রি-২৯ ধান আবাদ করেছি। সম্পূর্ণ ক্ষেত এখন লাল হয়ে গেছে। সার-বিষ সব কিছু দেওয়া হয়েছে। কোনো কাজ হয় নাই।
পাকুরিয়া ইউনিয়নের খামারপাড়া, বাদাপাড়া, বাটিয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, ফকিরপাড়া ঘুরে জানা যায়, কৃষক সৌকত আলীর আড়াই একর, সোহাগ মিয়ার দুই একর, আজহার আলীর দুই একর, ইব্রাহীমের এক একর, আতর আলীর দেড় একর, মহেজ আলীর দুই একর, কাজল মিয়ার পাঁচ কাঠা, মুরাদ মিয়ার দশ কাঠা, চুন্নু শেখের দশ কাঠা, সোহেল মিয়ার এক একর, লান্ডু মিয়ার দেড় একর, মুসলিম মিয়ার দেড় একর, আনসার আলীর এক একরসহ শতাধিক কৃষকের বিপুল পরিমাণ জমির বোরো ধানের চারা গাছে পচন ধরেছে।
বাদাপাড়া গ্রামের কৃষক মুরাদ মিয়া জানান, তাদের অনেকে ঋণ বা ধার-দেনা করে বোরোর আবাদ করেছেন। কথা ছিল, নতুন ধান পেয়ে তারা সেই দেনা পরিশোধ করবেন। কারও আবার এ ফসলের ওপরই নির্ভর করছে বছরজুড়ে খোরাকির। কিন্তু ভালো ফলন তো দূরের কথা, চারা রোপণের পর বাড়ন্ত সময়েই ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
শেরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রহমতউল্লাহ বলেন, শেখহাটি এলাকার রৌহা বিলে একরের পর একর জমির ২৯ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতি শেরপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক সোলাইমান আহাম্মেদ বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তারা বলছেন, নিম্নমানের বীজের কারণে এমনটা ঘটছে। তাহলে আমাদের কথা হচ্ছে, এই নিম্নমানের বীজ বাজারে কেন বিক্রির অনুমতি দেয়া হলো।
পাকুরিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, চারা রোপণে কৌশলগত ভুল এবং রোপণের সময় প্রচণ্ড শীত ছিল। এছাড়া ব্রি ধান-২৯ বীজের বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। তবে পরামর্শ মেনে ব্যবস্থা নিলে পচনরোধ সম্ভব বলে মনে করছেন এই উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা।
শেরপুর শহরের নিউ মার্কেট এলাকার বীজের ডিলার জাফর আলী বলেন, ব্রি ২৯ ধানের গাছে পচন রোগ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। পচন নিয়ন্ত্রণের জন্য গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে না করলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ বিষয়ে কৃষক ভাইদের সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ মোতাবেক সঠিকভাবে মাঠে পদক্ষেপ নিতে হবে ।
শেরপুর শহরের শেখহাটি বাজারের সার ও ধান বীজের ডিলার মনিরুজ্জামান বলেন, ধানের বীজ শোধন করার জন্য পানির সঙ্গে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কৃষক ভাইয়েরা এটাতে অভ্যস্ত নন। তাই ব্রি ২৯ ধানে পচন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এ ছাড়া ক্ষেতে পটাশ ও জিংক ব্যবহার না করার কারণেও পচন রোগ হতে পারে। শুধুমাত্র বীজের জন্য এমন অবস্থা হয়েছে সেটা সঠিক নয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় এ বছর ৯১ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৮৯ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ ভাগ।
অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আরও বলেন, এ সময়ে দিনের তাপমাত্রা বেশি, রাতের তাপমাত্রা কম থাকছে। রাতে ও সকালে কুয়াশা পড়ার কারণে কিছু কিছু ধান গাছে ছত্রাকজাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। আমাদের মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছেন। তিনি বর্তমান আবহাওয়ায় সরকার অনুমোদিত কীটনাশক কার্বেনডাজিম গ্রুপের নাইম, ভেজিস্টিন ও ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগে কৃষকদের পরামর্শ দেন।
(ঢাকাটাইমস/১০মার্চ/এআর)

মন্তব্য করুন