ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৩

কোরআনে বর্ণিত হাজার বছর আগের ভবিষ্যদ্বাণী ও কেয়ামতের ভয়ংকর দৃশ্য

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫৫ | প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ২০:২৮

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কুরআনুল কারীমের ২৩তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসীর করছি। বাইশতম পারার শেষে সেসব নবীর আলোচনা করা হয়েছিল, আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে এক জনপদের হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে জনপদবাসী হেদায়েতের পথে চলেনি। তারা যখন একে একে তিনজন নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন এক ব্যক্তি দৌড়ে সে সম্প্রদায়ের নিকট আসে।

আগের পর্ব: পর্দা পালনে মানতে হবে কোরআনের যেসব নির্দেশনা

মুফাসসিরগণ বলেন, তার নাম ছিল হাবিবে নাজ্জার। নবীদের কষ্ট দেওয়া হলে আল্লাহর আজাব নেমে আসতে পারে বলে সে তার সম্প্রদায়কে সতর্ক করে। তাদেরকে নবীদের অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়। যখন সে তাদেরকে বিষয়টি বোঝালো, আর সবার সামনে নিজের ঈমান আনার ঘোষণা দিলো, তখন সকলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে শহিদ করে ফেলল।

শাহাদাতের পর সে জান্নাতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করে। যখন সে মুমিনদের জন্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত জান্নাতের নেয়ামত প্রত্যক্ষ করার সুযোগ লাভ করে, তখন নিজের অজান্তেই তার জবান থেকে বেরিয়ে আসে, হায় আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আমাকে যে সম্মানিত ও সৌভাগ্যবান করেছেন, আমার সম্প্রদায় যদি তা জানত!' (২৭)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মুমিন ব্যক্তি জীবদ্দশায় যেমন নিজ সম্প্রদায়ের কল্যাণকামী ছিল তেমনি মৃত্যুর পরেও সে কল্যাণকামী যেমন এরপর আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের উপর আফসোস করে বলেন, তাদের নিকট যে রাসুলই আসে তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। কউল্লিখিত বিষয় ছাড়াও সুরা ইয়াসিনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, নিম্নে তা

তুলে ধরা হল:

আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, একত্ব এবং তার কুদরতের যেসব তাকবিনি (সৃষ্টিগত) বিষয় কোরআনে বারবার উল্লেখ হয়েছে, তার মধ্যে তিন ধরনের দলিল এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

১. মৃত জমিন, বৃষ্টির মাধ্যমে যাকে জীবিত করা হয়।

২. দিনরাত, চন্দ্র-সূর্য।

৩. জাহাজ ও নৌকা, যা সমুদ্রে চলাফেরা করে।

এসব দলিলের মাধ্যমে সুরা ইয়াসীন এমন এক বাস্তবতার কথা ঘোষণা করেছে, যা কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালের বিজ্ঞানচর্চাকারী বা গবেষকরাও জানতো না।

হাজার বছর আগের ভবিষ্যদ্বাণী

৩৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, পবিত্র সে সত্তা, যিনি জমিন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদ, মানুষ এবং যা তারা জানে না, তার সব জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। (৩৬)

আগেকার মানুষদের ধারণা ছিল, শুধু মানুষ ও প্রাণীদেরই জোড়া হয়ে থাকে আর বর্তমানকালের বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর প্রমাণিত হয়েছে যে, জোড়া জোড়া শুধু মানুষই নয়; বরং উদ্ভিদ এবং গোটা বিশ্বের সব জিনিসেই তা পাওয়া যায়। (যেমন বিদ্যুৎয়ের মাঝে পজেটিভ ও নেগেটিভ।) এমনকি বস্তুর সবচেয়ে ক্ষুদ্রাংশ-পরমাণুরও দুটি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে ইলেকট্রন অপরটি প্রোটন। এই দুই অংশ নর-মাদিতুল্য।

অথচ সুরা ইয়াসিন ও সুরা জারিয়াতে এ ব্যাপারে হাজার বছর পূর্বেই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুরা জারিয়াতে বলা হয়েছে, আমি প্রত্যেক জিনিসকে জোড়া বানিয়েছি, যাতে তোমরা শিক্ষা লাভ করো। (৪৯-৫১)

কেয়ামতের ভয়ংকর দৃশ্য

এরপর সুরা ইয়াসিনে কেয়ামতের ভয়ংকর দৃশ্য এবং শিঙ্গায় ফুৎকারের আলোচনা করা হয়েছে। যখন প্রথমবার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে মানুষজন তখন নিজ নিজ

কাজ-কারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকবে। ইসরাফিল আলাইহিস সালামের শিঙ্গার আওয়াজ শুনে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। একে الفع ( )ভীতি সৃষ্টিকারী ফুৎকার) বলা হয়।

দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুৎকারের পর চিরঞ্জীব মহান আল্লাহ ছাড়া সকলেই মৃত্যুবরণ করবে। কেউ জীবিত থাকতে পারবে না। একে نفخة الصعق (বজ্রাঘাতকারী ফুৎকার, যার মাধ্যমে সকল জীবজন্তু মৃত্যুবরণ করবে) বলা হয়।

তৃতীয়বার যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখন সকলেই কবর থেকে উঠে আসবে। এটাকে نفخة البعث )পুনরুত্থানের ফুৎকার) বলা হয়। এরপর প্রকৃত বিচারক আল্লাহর সামনে হাজির হবে। সেখানে কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। মুমিনদের জান্নাত এবং তার নেয়ামত দ্বারা পুরস্কৃত করা হবে। যেসব অপরাধী দুনিয়াতে ভালো মানুষদের সাথে মিলেমিশে ছিল, তাদেরকে পৃথক করা হবে। তাদের মুখে মোহর এঁটে দেওয়া হবে। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।'

যেহেতু এ সুরায় পুনরুত্থান নিয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে, তাই এ সংক্রান্ত আলোচনার মাধ্যমেই সুরাটি শেষ হয়েছে। বলা হয়েছে, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নন? হ্যাঁ, তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। তিনি যখন কোনোকিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন 'হও', তখনই তা হয়ে যায়। (৮১-৮২)

সুরা সাফফাত

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ১৮২। রুকুসংখ্যা: ৫

যেসব ফেরেশতা সর্বদা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত, তাসবিহ ও প্রশংসায় লিপ্ত থাকে, তাদের আলোচনা দিয়ে সুরাটি শুরু হয়েছে।

এরপর জিনদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যখন তারা চুপিসারে গিয়ে ঊর্ধ্বজগতের ফেরেশতাদের খবর শোনার চেষ্টা করত, তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মাধ্যমে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হতো।

পুনরুত্থান

সুনার সাফফাতে পুনরুত্থান, হিসাব-নিকাশ ও প্রতিদান বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পুনরুত্থান বিষয়ে মুশরিকদের অবস্থান অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। তারা পুনরুত্থান নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। তাদের বোধগম্য হয় না যে, হাড্ডি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মাটিতে মিশে যাওয়ার পর মানুষকে কীভাবে দ্বিতীয়বার জীবিত করা হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে বিষয়টা তারা কঠিন ও অসম্ভব মনে করে তা আল্লাহর জন্য আদৌ কঠিন নয়। ইসরাফিল যখন তৃতীয়বার শিঙ্গায় ফুঁক দেবে তখন তারা কবর থেকে বেরিয়ে আসবে। (১৯)

এরপর তারা অত্যন্ত আফসোস-অনুশোচনার সাথে বলবে, এটি হচ্ছে কৃতকর্মের প্রতিদান দিবস, আমরা যাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতাম। এরপর তাদেরকে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। তারা সেখানে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। নিজেদের গোমরাহির কারণে একে অপরকে অভিযুক্ত করবে। (২০-৩৫)

জান্নাতিদের পরস্পর আলোচনা

জাহান্নামিদের পরস্পর অভিসম্পাৎ ছাড়াও এ সুরার মাধ্যমে জান্নাতিদের মধ্যকার পরস্পর আলোচনার বিষয়টি জানা যায়। যখন তাদেরকে সব ধরনের নেয়ামত দেওয়া হবে, তারা শাহজাদাদের চেয়ে বহুগুণ সুখময় জীবনযাপন করবে তখন তারা নিজেদের অতীত স্মরণ করবে। তাদের একজন বলবে, আমার এক বন্ধু ছিল। সে আমাকে বলত, এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় যে, তোমরা পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাক! এটা কীভাবে সম্ভব যে, যখন আমরা মরে মাটি ও হাড্ডি হয়ে যাব তখন আমাদের দ্বিতীয়বার জীবিত করা হবে! আমাদের থেকে গোটা জীবনের আমলের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে! কাউকে প্রতিদান দেওয়া হবে, কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে! এগুলো তো আমার বোধগম্য হয় না! জানি না কেন তোমরা এসবের প্রতি অযৌক্তিক বিশ্বাস রাখো!

এরপর সে তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে, তোমরা কি ওই লোকটাকে দেখতে চাও? তখন সে উঁকি দিয়ে ওই যুক্তিপূজারি ও আখেরাত অস্বীকারকারী বন্ধুকে জাহান্নামের মাঝখানে প্রজ্বলিত হতে দেখবে। তখন সে তাকে বলবে, তুমি তো আমাকে ধ্বংসই করে দিয়েছিলে! আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ না হলে আমিও তাদের সাথে (জাহান্নামে) উপস্থিত হতাম। (৫০-৬০)

বিভিন্ন নবীর ঘটনা

এরপরে এ সুরায় বিভিন্ন নবীর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে শাইখুল আমবিয়া হজরত নুহ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তার সম্প্রদায় তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। এসব মিথ্যাবাদীকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে।

হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম

এরপর দুই ধাপে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম ধাপে তার তাওহিদের দাওয়াত দেওয়ার কথা আলোচিত হয়েছে। তিনি তার গিতা ও সম্প্রদায়কে কীভাবে ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন, কীভাবে তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ থেকে অপারগতা প্রকাশ করেছেন, কীভাবে তাদের মূর্তিগুলোর নাকাল দশা করে ছেড়েছেন, মুশরিকরা তাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য কো নপদ্ধতি অবলম্বন করেছিল আর আল্লাহ তায়ালা তাকে কীভাবে সেখান থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন- এসব বিষয় এখানে আলোচনা করা হয়েছে। (৮৩-৯৮)

দ্বিতীয় ধাপে নিজ সন্তানকে জবাই করার প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি শুধু সুরা সাফফাতেই উল্লেখ হয়েছে। কোরআনুল কারিমের অনেক জায়গায় হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আলোচনা এলেও এই ঘটনা সর্বত্র আলোচনা করা হয়নি। এটি সুরা সাফফাত ছাড়া কোথাও আলোচিত হয়নি।

ইবরাহিম আলাইহিস সালামের গোটা জীবনই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিপদ-মুসিবতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এ পরীক্ষাটি অন্যান্য পরীক্ষার তুলনায় কঠিন ছিল। তিনি স্বপ্নে দেখেন তাকে নিজ সন্তানকে জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি তাসলিম ও রেজা (আল্লাহর বিধান মেনে নেওয়া এবং তার উপর সন্তুষ্টি) প্রকাশের জন্য তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে যান। সন্তানকে স্বপ্নের কথা শোনানো হলে তিনিও তার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।'

জবাই শুরু করা মাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসে, ইবরাহিম, তুমি তোমার স্বপ্ন পুরা করেছ। নিঃসন্দেহে এটা ছিল অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা। এখন তুমি তোমার ছেলের পরিবর্তে দাঁড়িয়ে থাকা জন্তুটি জবাই করো। নেককারদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। (৯৯-১১০)

তৃতীয় ঘটনাটি হজরত মুসা এবং হজরত হারুন আলাইহিমাস সালামের।

চতুর্থ ঘটনা হজরত ইলিয়াস আলাইহিস সালামের। তাকে শামের এক সম্প্রদায়ের নিকট নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তারা বাআল নামক মূর্তির পূজা

করত। এই মূর্তির নামানুসারে বা'লাবাক্কু শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল, দামেশকের পশ্চিমাঞ্চলে আজও যার প্রভাব বিদ্যমান।

পঞ্চম ঘটনাটি হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ভাতিজা লুত আলাইহিস সালামের, যাকে জর্দানের সাদুমবাসীদের নিকট আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু হতভাগারা নিকৃষ্ট কাজে এবং কুফুরিতে অন্ধ হয়ে পড়েছিল। হেদায়েতের বাণী শোনার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। পরিশেষে যন্ত্রণাদায়ক আজাবের মাধ্যমে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।

ষষ্ঠ ঘটনাটি হজরত ইউনুস আলাইহিস সালামের, যাকে কিছুদিন মাছের পেটে থাকতে হয়েছিল। আজাব আসতে দেখে তার সম্প্রদায় তাওবা করেছিল।

নবীদের ঘটনা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে, নবীদের ব্যাপারে আমার ওয়াদা সত্য হয়েছে। তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত ও বিজয়ী হয়েছে। আর আমার বাহিনী সবসময় বিজয়ী হয়। (১৭-১৭৩) সুরার শেষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিরোধীদের থেকে বিমুখ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সবশেষে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও তাসবিহের বর্ণনা রয়েছে।

সুরা স-

এটি মল্কি সুরা।' আয়াতসংখ্যা: ৮৮। রুকুসংখ্যা: ৫

সুরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমের শপথ করেছেন। হয়তো কোরআন মাজিদ মুজিজা হওয়ার ব্যাপারে বা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতার ব্যাপারে এ শপথ করা হয়েছে।

এ সুরার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিম্নে তুলে ধরা হল:

১. আল্লাহ তায়ালার একত্ব এবং তার মহত্ত্বের উপর তাকবিনি (অপরূপ সৃষ্টিরাজির মাধ্যমে) দলিল উল্লেখ করার পরে বলা হয়েছে, মুশরিকরা অহংকার, বোকামি ও মূর্খতার মধ্যে ডুবে আছে। তারা আশ্চর্য হয় যে, তাদেরকে বোঝানোর জন্য তাদেরই একজনকে কীভাবে নবী বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা বলত, আমরা তো বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন খোদা বানিয়ে রেখেছিলাম; কিন্তু নবী বলে যে, সমস্ত মানুষ ও জীবন-মৃত্যুর পুরো ব্যবস্থার জন্য একজন মাত্র খোদাই যথেষ্ট!

২. কাফেরদের বোকামিপূর্ণ কথাবার্তা উল্লেখ করার পর পূর্ববর্তী জাতিগোষ্ঠীর মাঝে যারা অহংকারী ও মুশরিক ছিল, তাদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। যারা মিথ্যা ও অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তায়ালার আজাবের উপযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। (১২-১৪)

৩. পূর্ববর্তী জাতিগুলোর অহংকারী ও মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের পরিণাম উল্লেখ করার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দাউদ আলাইহিস সালাম

অপরদিকে হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের ঘটনা স্মরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাকে আল্লাহ তায়ালা জাহেরি-বাতেনি, দীনি ও দুনিয়াবি সব ধরনের শক্তি দিয়েছিলেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আরেকদিন আহার করতেন। রাতের অর্ধেক সময় ঘুমাতেন আর অর্ধেকে আল্লাহর ইবাদত করতেন। বিশাল সাম্রাজ্যের বাদশাহ ছিলেন তিনি। অনেক বড় নবী ছিলেন। তার জিকিরকারী অন্তর ও শোকরগুজার জবান ছিল। জাদুময়ী কণ্ঠ ছিল। যখন তিনি যাবুর তেলাওয়াত করতেন, পাখিরা তা শোনার জন্য থেমে যেত। যখন আল্লাহর প্রশংসায় তিনি জবান মশগুল রাখতেন তখন পাহাড়ও তার সাথে প্রশংসায় লিপ্ত হয়ে যেত।

হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের পাশাপাশি তার পুত্র হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামেরও গুণ-কীর্তন করা হয়। উপায়-উপকরণের দিক থেকে তার সাম্রাজ্য পিতার সাম্রাজ্য থেকেও অধিক শান-শওকতের অধিকারী ছিল। বাতাস ও জিনজাতিকে তার অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।

আইয়ুব আলাইহিস সালাম

৪. তৃতীয় পর্যায়ে সুরা স-দে হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালামের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তিনি হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বংশধর ছিলেন। তার অঢেল ধনসম্পত্তি ছিল। বহু বাগ-বাগিচা ও বড় বড় প্রাসাদ ছিল। অনেক শস্যক্ষেত্র ও গবাদিপশু ছিল। তার অনেক চাকরবাকর এবং সন্তানসন্ততি ছিল।

আল্লাহর পক্ষ থেকে তার পরীক্ষা নেওয়া হয়। একে একে সবকিছু হারিয়ে যায়। সন্তানরা মারা যায়। চতুষ্পদ জীব-জন্তু ও ধনসম্পদ বিলীন হয়ে যায়। বাগবাগিচা ও গবাদিপশু মারা যায়। বড় বড় প্রাসাদ মাটিতে ধসে পড়ে। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা তাকে ছেড়ে চলে যায়। ধনাঢ্যতা ও প্রাচুর্যের স্থানে দরিদ্রতা জেঁকে বসে। তিনি নিজেও মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছু তাফসিরের কিতাবে আছে, দীর্ঘ আঠারো বছর এ বিপদ স্থায়ী হয়েছিল।১ কিন্তু আইয়ুব আলাইহিস সালাম কখনো স্বীয় পন্থা পরিবর্তন করেননি। সর্বদা তিনি শোকর ও কৃতজ্ঞতা আদায় করেছেন। পরিশেষে এ পরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্বের চেয়েও বহুগুণ বেশি নেয়ামত দান করেন।

৫.

হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম ছাড়াও সুরা স-দে হজরত ইবরাহিম, হজরত ইসহাক, হজরত ইয়াকুব, হজরত ইসমাইল, হজরত ইয়াসাআ, হজরত জুলকিফল আলাইহিমুস সালামের বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সকলের প্রশংসা করা হয়েছে। পরিশেষে ইবলিসের সাথে হজরত আদম আলাইহিস সালামের যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, কিছুটা বিস্তারিতভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তার নবীকে হুকুম দিয়েছেন, আপনি আপনার দাওয়াতের বাস্তবতা এবং তার উদ্দেশ্য তুলে ধরুন। আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই। এটা তো বিশ্ববাসীর জন্য এক উপদেশ। কিছুকাল পর অবশ্যই তোমরা এর সংবাদ জানতে পারবে। (৮৬-৮৮)

সুরা যুমার

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ৭৫। রুকুসংখ্যা: ৮

এ সূরার মূল বিষয় হচ্ছে তাওহিদের আকিদার বর্ণনা করা। কেননা তাওহিদের *বিশ্বাসই ঈমানের ভিত্তিমূল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় মুজিজা কোরআনুল কারিমের আলোচনার মাধ্যমে এ সুরার সূচনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল কৃত, যিনি বিজয়ী ও হেকমতের অধিকারী।

এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যেন সমস্ত মুসলমানকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইবাদতকে আল্লাহর জন্য নিষ্ঠাপূর্ণ করো। লৌকিকতা ও লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে কখনো ইবাদত করবে না। সামনের আয়াতগুলোতে শৈলী পরিবর্তন করে রাব্বুল আলামিনের একত্বের উপর বিভিন্ন দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে। শিরক প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

তিনটি অন্ধকার

এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, মাতৃগর্ভে মানুষের সৃষ্টির ব্যাপারে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে তিনটি অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। (৬)

এটা কোরআনের জ্ঞানগত বিরাট মুজিজা। বিংশ শতাব্দীতে এসে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করেছে, কোরআন তা হাজার বছর পূর্বেই উল্লেখ করে দিয়েছে। ডাক্তার ও চিকিৎসকগণ বলেন, বাহ্যত এটাকে একটিমাত্র পর্দার মতোই দেখায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে তিনটি পর্দা রয়েছে। কোরআন তিনটি পর্দাকে তিনটি অন্ধকার বলে উল্লেখ করেছে। যেহেতু এ পর্দা বাচ্চাকে আলো থেকে বাঁচিয়ে রাখে তাই একে অন্ধকার বলা হয়েছে।

মুমিন মুশরিকদের দৃষ্টান্ত

তাওহিদের দলিল উপস্থাপন এবং কুফর-শিরক প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ তায়ালা একত্ববাদী মুমিন এবং মুশরিকদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। মুশরিকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন গোলামের মতো, যার মালিক কয়েকজন, মেজাজ-মর্জি ও আচার-উচ্চারণের দিক থেকে যারা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যর অধিকারী। তাদের পরস্পরে কোনো মিল-মহব্বত নেই। তাদের একজন এ গোলামকে ডান দিকে পাঠালে দ্বিতীয়জন তাকে বাম দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। একজন তাকে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলে দ্বিতীয়জন তাকে বসার নির্দেশ দেয়। সে হয়রান হয়ে যায় যে, সে কার কথা মানবে আর কার কথা অমান্য করবে!

পক্ষান্তরে একত্ববাদীর দৃষ্টান্ত এমন এক গোলামের মতো, যার মালিক একজন। তার চরিত্র অত্যন্ত ভালো। সে নিজ গোলামের ইচ্ছা ও মর্জির প্রতি লক্ষ রেখে থাকে। (২৯)

নিঃসন্দেহে এই গোলাম নিষ্ঠার সাথে তার খেদমত করবে। সে নিজ মনিব থেকেও সদাচরণের আশা করবে। এ মালিক যখন রাব্বুল আলামিন হবেন, বান্দা যখন সর্বস্ব দিয়ে তার হয়ে যাবে, নিঃসন্দেহে তখন তার মানসিক প্রশান্তি ও সুখের কাছে বাদশাহিও তুচ্ছ মনে হবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :