ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২২

পর্দা পালনে মানতে হবে কোরআনের যেসব নির্দেশনা

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
 | প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৪

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ঢাকা টাইমস এর আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারিমের ২২তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসির পেশ করছি।

আগের পর্ব: যে কারণে আমাদের নামাজ গোনাহ থেকে ফেরায় না

একুশতম পারার শেষের কিছু আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র স্ত্রীদের সম্বোধন করা হয়েছিল। যেহেতু বাইশতম পারার শুরুতে এ সম্বোধনের কিছু অংশ স্থান পেয়েছে; তাই এখানে সে সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হলো।

এসব আয়াতের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, যখন মুসলমানদের ধারাবাহিক বিজয় শুরু হয় তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তার নিকট ব্যয় ও খরচাদি বৃদ্ধি করার আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত আয়াত নাজিল হয়।

এতে তাদেরকে দুই বিষয়ের যেকোনো একটি নির্বাচন করার অধিকার দেওয়া হয়। প্রথম হয়তো তারা সুখী জীবনযাপন করবে। এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তারা পৃথক হয়ে যাবে। নয়তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থেকে সংকীর্ণ জীবনযাপন করবে। যখন তিনি তাদেরকে এ ইচ্ছাধিকার প্রদান করেন তখন তারা সকলেই আখেরাতকে প্রাধান্য দেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের ফজিলত বর্ণনা করে তাদেরকে সাতটি বিধান দেওয়া হয়।

১. পরপুরুষের সাথে কোমল ভাষায় (অথবা আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে) কথা না বলা।

২. প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া। কেননা ঘরই মুসলিম নারীর নিরাপদ ঠিকানা।

৩. জাহেলিযুগের নারীদের মতো নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করা।

৪. নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।

৫. জাকাত আদায় করা।

৬. আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা।

৭. আল্লাহর আয়াত ও হেকমতের যেসব কথা শোনানো হয়, তা স্মরণ রাখা।

এ ছাড়াও বাইশতম পারায় সূরা আহযাবে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো:

১. একটি ইসলামি সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে দশটি গুণ থাকা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তারা ক্ষমা এবং মহাপ্রতিদান পেতে পারে। ইসলাম, ঈমান, সর্বদা আনুগত্য, সত্যবাদিতা, ধৈর্য, খোদাভীরুতা, সদকা, রোজা, লজ্জাস্থানের হেফাজত ও অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করা। (৩৫)

যায়েদ বিন হারিসা ও যায়নাব বিনতে জাহাশ-এর ঘটনা

২. সূরা আহযাবে সেই প্রসিদ্ধ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার কারণে শত্রুরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা করে থাকে। বিষয়টি হচ্ছে, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পালকপুত্র যায়েদ বিন হারিসা এবং তার ফুফাতো বোন হযরত যায়নাব বিনতে জাহাশ- এর মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না, এবং শেষপর্যন্ত তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায়, তখন আল্লাহর নির্দেশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়নাবকে বিয়ে করেন। এ কারণে অনেক সমালোচনা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালকপুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন বলে! জাহেলিযুগে এ ধরনের বিয়েকে হারাম মনে করা হতো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি নিজে এ বিয়ে করিয়েছি ভবিষ্যতে যাতে পালকপুত্রের স্ত্রী বিয়ে করার ক্ষেত্রে মুসলমানগণ কোনো সমস্যায় না পড়ে। (৩৭)

একাধিক বিয়ের উপর আপত্তি ও তার অসারতা

প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন। ইসলাম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রুরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর একাধিক বিয়ের প্রশ্নে বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপন করে থাকে। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, তিনি প্রবৃত্তির স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এসব বিয়ে করেছিলেন। নাউজুবিল্লাহ। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। তা হলে তাদের আপত্তির অসারতা আমাদের সামনেসুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

প্রথম বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা যৌবন এমন একজন নারীর সঙ্গেই কাটিয়েছেন, যিনি বয়সের দিক থেকে তার চেয়ে দ্বিগুণ বড় ছিলেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করেননি। আবার হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছাড়া অন্য স্ত্রীদের যখন তিনি বিয়ে করেছিলেন, তখন তিনি বার্ধক্যের বয়সে উপনীত (পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে) ছিলেন।

দ্বিতীয় বিষয় হল, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কুমারী স্ত্রী ছিল না। নাউজুবিল্লাহ, যদি একাধিক বিয়ের মাধ্যমে প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো তার উদ্দেশ্য হতো তা হলে তিনি যুবতী কুমারী নারীদের বিয়ে করতেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একাধিক বিয়ের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত এবং শরিয়তে ইসলামির বহুমুখী প্রচার ও শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যের পাশাপাশি কিছু সামাজিক ও রাজনৈতিক হেকমতও নিহিত ছিল। সংক্ষেপ করার স্বার্থে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশ করতে পারছি না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাঁচটি বিশেষ গুণ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে মুমিনদের আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দিয়েছেন, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তার পাঁচটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এক. তিনি নিজ এবং অন্যান্য উম্মতের ব্যাপারে কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য প্রদান করবেন। কেননা গোটা দুনিয়ার মানুষ সকলেই তার উম্মত। যারা ঈমান এনেছে, তারা ‘উম্মতে ইজাবাত’ আর যারা ঈমান আনেনি তারা ‘উম্মতে দাওয়াত’।

দুই. মুমিনদেরকে তিনি সফলতা ও জান্নাতের সুসংবাদাতা।

তিন. কাফের ও পাপাচারীদের আজাব ও ধ্বংসের ব্যাপারে সতর্ককারী।

চার. তিনি সৎকাজ, ইসলাহ, উত্তম চরিত্র এবং ইসতিকামাতের প্রতি আহ্বানকারী।

পাঁচ. তিনি সম্পদ, ক্ষমতা, দুনিয়া, জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রতি দাওয়াতদাতা নন। বরং তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত দিয়ে থাকেন। যার উদ্দেশ্য হলো উম্মাহকে ইসলাহ করা।

এতে সন্দেহের কী আছে যে, নবীদের সর্বোত্তম আমল হচ্ছে দাওয়াত প্রদান। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন, তার চেয়ে উত্তম কথা কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে। নিজে সৎকাজ করে এবং বলে নিশ্চয় আমি মুসলমানদের একজন। তিনি হচ্ছেন ‘সিরাজুম-মুনির’ তথা উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার নুরময় আগমনের মাধ্যমে অন্ধকার দূর হয়েছে। বিভিন্ন সন্দেহের অপনোদন ঘটেছে। (৪৫- ৪৭) আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে তুলনা দিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার মাধ্যামে শিরকের ভ্রষ্টতা দূর করেছেন। গোমরাহ লোকদের হেদায়েত দিয়েছেন। ঠিক যেমন সূর্যের আলোতে রাতের অন্ধকার দূর হয়ে যায়, মানযিলে মাকসুদে সহজে পৌঁছা যায়।

কিছু আদব ও শিষ্টাচার

সূরা আহযাবে কিছু আদব ও শিষ্টাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, জাহেলিযুগের লোকেরা যা জানত না। এখানে তার তিনটি আদবের কথা উল্লেখ করা হলো:

১. অনুমতি ব্যতীত কারো ঘরে প্রবেশ না করা।

২. যদি খাওয়ার দাওয়াত দেওয়া হয় তা হলে খাবার খেয়ে উঠে যাওয়া। কথাবার্তায় মত্ত হয়ে মেজবানকে কষ্ট না দেওয়া।

৩. গায়রে মাহরাম নারীদের থেকে কোনোকিছু চাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে পর্দার আড়ালে থেকে তা চাইতে হবে। পর্দা ব্যতীত তাদের সামনে আসা যাবে না। তবে নিজ মাহরামদের সামনে পর্দা করার প্রয়োজন নেই। (৫৩-৫৫)

৪. একবার দুরুদে দশটি রহমত এবং একবার সালামে দশবার শান্তি

৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সম্মানবিষয়ক আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান নিয়ে আলোচনা করেছেন। মুমিনদেরকে তার উপর দুরুদ-সালাম পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার উপর দুরুদ-সালাম প্রেরণ প্রকৃতপক্ষে আমাদেরই সম্মান ও মর্যাদা উঁচু হওয়া এবং গুনাহ মোচনের মাধ্যম। (৫৬)

আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলেন। তার চেহারায় তখন খুশি ভাব ছিলো। সাহাবিগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা আপনার চেহারায় খুশির আভা দেখতে পাচ্ছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আজ আমার নিকট এক ফেরেশতা এসেছিল। সে বলেছে, হে মুহাম্মদ, আল্লাহ তায়ালা যা বলেছেন এ ব্যাপারে কি আপনি খুশি নন? আপনার উম্মতের যে আপনার প্রতি একবার দুরুদ পাঠাবে, তার উপর দশটি রহমত নাজিল করা হবে। যে একবার সালাম পাঠাবে, তার উপর দশবার শান্তি বর্ষিত হবে। আমি ফেরেশতাদের উত্তর দিয়েছি যে, আমি খুশি আছি।'

পর্দার বিধান

প্রথমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের ব্যাপারে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়েছে। এরপর সাধারণ মুসলিম নারী-স্ত্রী, মেয়ে, মা সবাইকে পর্দার বিধান দেওয়া হয়। পর্দা নারীর ইজ্জত ও সম্মানের কারণ। শরয়ি পর্দাতে কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখা আবশ্যক।

ক. পর্দা এমন হতে হবে যে, তার দ্বারা গোটা শরীর আবৃত হয়ে যায়।

খ. পর্দা দৃষ্টি আকর্ষণকারী হতে পারবে না।

গ. পর্দা এত পাতলা হতে পারবে না, যার মাধ্যমে দেহের আবরণ প্রকাশ পায়।

ঘ. পর্দা প্রশস্ত হতে হবে। এতটা সংকীর্ণ হবে না, যা ফেতনা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ঙ. দেহের অঙ্গ প্রতিভাত হয়ে ওঠে।

চ. এমন সুগন্ধিযুক্ত হতে পারবে না, যার ঘ্রাণ অন্যের নিকট পৌঁছে। পুরুষের পোশাকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না।

ছ. কাফের ও মুশরিক নারীদের পোশাকের মতো হতে পারবে না।

জ. প্রসিদ্ধির পোশাক তথা মানুষ যা প্রসিদ্ধির জন্য পরে থাকে তেমন না হওয়া। হাদিসে

এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ধমক এসেছে।

সূরার শেষাংশে ফরজ-ওয়াজিব প্রভৃতি শরয়ি বিধানের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিধানগুলো আমানত, আল্লাহ যা বান্দার নিকট সোপর্দ করেছেন। আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কেননা তাদের মাঝে তা বহনের যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যেহেতু মানুষকে চিন্তাভাবনা এবং ভালোমন্দের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা দিয়েছেন; তাই তারা এ বোঝা বহন করেছে। কিন্তু তারা (অর্থাৎ মানুষের মাঝে মুশরিক ও মুনাফিকরা) এর হক আদায় করতে পারেনি।

সূরা সাবা

একটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫৪। রুকু সংখ্যা: ৬

আল্লাহ তায়ালার প্রশংসার মাধ্যমে সূরাটি শুরু হয়েছে। যিনি সকল সৃষ্টি-জীবকে সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বজগতের সুন্দর ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। বিশ্বের প্রতিটি বিষয়ের খবরাখবর তার জানা রয়েছে। তার কোনো কাজ হেকমত থেকে খালি নয়। এরপর মুশরিকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা হিসাব-নিকাশ ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন অস্বীকার করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনার রবের শপথ করে বলুন, কেয়ামত অবশ্যই আসবে। নেককারদের এর উত্তম প্রতিদান দেওয়া হবে, এবং পাপীদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে। (২)

এ ছাড়াও এ সূরায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

হযরত দাউদ ও হযরত সুলাইমান আলাইহিমাস সালাম

১. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এবং সাবাবাসীদের ওপর আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞদের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।

উল্লিখিত দুই ব্যক্তি আল্লাহর নবী ছিলেন। তারা কৃতজ্ঞ বান্দা ছিলেন। দাউদ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা চমৎকার কণ্ঠস্বর প্রদান করেছিলেন। তিনি যখন আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করতেন তখন পাহাড় এবং পাখিরা তার সাথে তাসবিহ পাঠ করত। তিনি যখন যাবুর তেলাওয়াত করতেন তখন প্রাণীরাও তার তেলাওয়াত শুনত।

আল্লাহ তায়ালা তার জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলেন। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবে তা ভাঁজ করতে পারতেন। তা দিয়ে যা খুশি বানাতে পারতেন। তিনি একটি কারখানা তৈরি করেছিলেন। সেখানে লোহা দিয়ে মজবুত বর্ম বানানো হতো। একে দুনিয়ার প্রথম স্টিলমিল বলা যায়।

যেভাবে আল্লাহ তায়ালা দাউদ আলাইহিস সালামের উপর বিভিন্ন নেয়ামত দিয়েছিলেন তেমনিভাবে তার পুত্র সুলাইমান আলাইহিস সালামকে বহু নেয়ামত দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে পাখিদের ভাষা শিখিয়েছিলেন। ‘তামা’ তার জন্য প্রবাহিত ঝরণার রূপ ধারণ করত। তিনি তা দ্বারা যা খুশি অতি সহজেই তা বানাতে পারতেন।

জিনদেরকে তার অনুগামী করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি নির্মাণ ও বহনের ভারী ভারী কাজ আনজাম দিতেন। বাতাসকে তার অধীন করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে যেমন বিমান রয়েছে তেমনি তার হাওয়াই সিংহাসন ছিল, যা এক সকাল ও এক বিকালেই দুই মাসের রাস্তা অতিক্রম করতে পারত।

এমন সব আশ্চর্য আশ্চর্য নেয়ামত সত্ত্বেও পিতা ও পুত্র কেউ-ই বিন্দুমাত্র অহংকার করেননি; এমনকি তারা একমুহূর্তের জন্যও আল্লাহ তায়ালার জিকির ও শোকর থেকে উদাসীন হননি; অথচ খুব কম মানুষই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকে।

ইয়ামেনের সাবাবাসীদের ঘটনা

এই সূরায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ইয়ামেনের সাবাবাসীদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম ঘটনাটি মুমিন ও শোকরগুজারদের জন্য আলোর মিনার হলে দ্বিতীয় ঘটনাটি কাফের ও অবাধ্যদের অন্ধকারের এক নমুনা। অঢেল রিজিক, স্বাস্থ্যকর মনোরম পরিবেশ, উর্বর জমিন, ফলবান বাগান প্রভৃতি নেয়ামত তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। পানি জমা করার জন্য একটি ড্যাম ছিল, যাকে ‘‘সাদ্দে মা’রাব’’ বলা হতো। কিন্তু তারা এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি। বরং তারা অকৃতজ্ঞতা করেছে। অকৃতজ্ঞদের পরিণতি যেমন হয় তাদেরও সেই পরিণতি হয়েছিল।

বাঁধ ভেঙে তাদের উপর আজাব নেমে আসে। বাঁধভাঙা পানিতে তাদের বাগবাগিচা, খেত-খামার সব ভেসে যায়। যেখানে ফল-ফলাদি ছিল সেখানে কিছু ঝোপ-জঙ্গল পড়ে রয়। এভাবেই সাবাবাসীরা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেয়। (১৫-২১)

মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাস ও তার খণ্ডন

২. এই সূরায় ধারাবাহিকভাবে মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাস ও মতবাদকে বিভিন্ন দলিল-প্রমাণ দিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। কখনো তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা তাদেরকে ডেকে আনো, যাদেরকে তোমরা বিপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে করো। তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ যে, তারা তোমাদের কীরূপ উপকার পৌঁছাচ্ছে?

কখনো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার রীতিতে প্রশ্ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বল আসমান-জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিজিক দেন? কখনো এমন প্রশ্ন করা হয়েছে যে, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর সাথে অংশীদার মনে করো, তাদেরকে একটু সামনে ডাকো তো, যাতে আমরা দেখতে পারি যে, তাদের মধ্যে কোন কোন গুণ রয়েছে, যার কারণে তোমরা তাদেরকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে করো? (২২-২৭)

ধনাঢ্যতা ও প্রাচুর্য কাফেরদের অবাধ্যতার মূল

সূরা সাবায় এরপর ধনাঢ্যতা ও প্রাচুর্যকে কাফের ও মুশরিকদের অবাধ্যতার মূল সুরাণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা এগুলো নিয়ে এতই গর্ব করত যে, আপি কারণ ছিল আমাদের মতো অর্থশালী ও সম্পদশালীদের দুনিয়াতেও আজার সের করতে পারবে না, আখেরাতেও না।

কোরআনের ভাষায়, তারা বলে- ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততির দিক থেকে আমরা তোমাদের চেয়ে এগিয়ে আছি। আমাদেরকে সাজা দেওয়া হবে না।

তারা আখেরাতকে দুনিয়ার অনুরূপ মনে করত। তাদের ধারণা ছিলো আল্লাহ তায়ালা যেভাবে দুনিয়াতে তাদেরকে সুখে-শান্তিতে রেখেছেন তেমনিভাবে আখেরাতেও তাদেরকে সুখ-শান্তিতে রাখবেন। তাদেরকে উত্তর দেওয়া হয়েছে, আপনি বলে দিন আমার প্রতিপালক যাকে ইচ্ছা তার জন্য রিজিক প্রশস্ত করে দেন বা সংকীর্ণ করে দেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। (৩৬)

অর্থ-সম্পদ-হেতু গর্ববোধ তাদেরকে (মক্কার মুশরিকদেরকে) রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করত। তারা তাকে পাগল বলে আখ্যা দিতেও পিছপা হতো না। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে রাসূল, বলুন, আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি। আল্লাহর জন্য তোমরা এক-একজন ও দু-দুজন করে দাঁড়াও। অতঃপর চিন্তাভাবনা করো। (আর তা করলে তোমাদের ঠিকই বুঝে আসবে যে) তোমাদের সঙ্গীর মধ্যে (অর্থাৎ আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে) কোনো উন্মাদনা নেই। তিনি তো আসন্ন কঠোর শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেন মাত্র। (৪৬)

শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, পরকালে তারা ঈমান আনতে চাইবে; কিন্তু তাদের ও তাদের ইচ্ছার মাঝে পর্দা ফেলে দেওয়া হবে। তারা ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে রইবে। (৫৪)

সূরা ফাতির

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৪৫। রুকু সংখ্যা: ৫

এ সূরায় একত্ববাদের প্রতি দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের ওপর দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। শিরকের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। সঠিক দীনের উপর কায়েম থাকার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সূরার শুরুতে বিশ্বজগতের স্রষ্টার গুণ-কীর্তন করা হয়েছে, যিনি মানুষ, ফেরেশতা ও জিনদের সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বজগতের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অপরূপ সৃষ্টিগত (তাকবিনি) বিষয়ের প্রতি মানুষের মনোনিবেশ করা হয়েছে।

মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের উপর এমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দলিল দেওয়া হয়েছে, যা শহুরে গ্রাম্য সকল মানুষেরই বোধগম্য হয়। বলা হয়েছে, যে আল্লাহ বৃষ্টি থেকে মৃত জমিন জীবিত করেন, দিবারাত্রিকে একের পর এক নিয়ে আসেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করাতে সক্ষম, তিনি মৃতকে সক্ষম।

জীবিত করতেও এভাবে এ সুরাটি ঈমান, হেদায়েত এবং কুফুরি ও গোমরাহির মাঝে বিভিন্ন চাক্ষুষ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পার্থক্যরেখা টেনে দিয়েছে। এ সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেমনভাবে অন্ধ ও চক্ষুষ্মান, জীবিত ও মৃত, অন্ধকার ও নুর, আলো ও ছায়া সমান হতে পারে না তেমনিভাবে মুমিন ও কাফের সমান হতে পারে না। (১৯-২২)

এরপর পুনরায় তাওহিদ ও আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার দলিল-প্রমাণ নিয়ে এ সূরায় আলোচনা করা হয়েছে। রং-বেরঙের ফুল, সাদা-কালো-লাল পাহাড়-পর্বত, বিভিন্ন ভাষাভাষী ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ, হাজারও শ্রেণির পাখি, মাছ, কীট- পতঙ্গ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে রাব্বুল আলামিনের কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।

কিন্তু এসব নিদর্শন দেখে-শুধু সেসব ব্যক্তির অন্তরে ভীতি সৃষ্টি হয়, যাদের জ্ঞান রয়েছে, যারা বাস্তবতার উপর পড়ে থাকা পর্দা সরিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারে। কেননা যার মধ্যে যত বেশি আল্লাহর পরিচয় ও তার অসীম কুদরতের জ্ঞান থাকবে, তার মধ্যে ততই খোদাভীতি এবং তার মহত্ত্ব তৈরি হবে। এ কারণে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে গোটা মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল। তিনি নিজেই বলেন, ‘আল্লাহর শপথ, তোমাদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা বেশি আল্লাহকে ভয় করি।’

আলেমগণ বলেন, প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানী তারাই, যারা আল্লাহর পরিচয়, তার সৃষ্টি ও কুদরতের জ্ঞান রাখার পাশাপাশি তাকে ভয়ও করে। যে আল্লাহকে ভয় করে না, সে আলেম বা জ্ঞানী নয়। কেননা তার অর্জিত জ্ঞান যদি অন্তরে খোদাভীতি জাগ্রত না করে, তা হলে সে এখনও পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। এজন্য বিশ্বজগতের বিভিন্ন বিষয়ে যারা জ্ঞান রাখেন, তারাও জ্ঞানী। অর্থাৎ চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদ, মহাকাশ এবং ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে যারা গবেষণা করেন, তাদেরকেও জ্ঞানী বিবেচনা করা হয়। অথচ তাদের অন্তরে খোদাভীতি না থাকার কারণে কোরআনের ভাষা অনুযায়ী তারা প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানী নয়। আসল সত্য হল, তারাও যদি সঠিকভাবে বিশ্বজগতের রহস্যাদির উপর দৃষ্টি দেয় তা হলে তারাও আল্লাহ তায়ালার একত্ব ও শক্তির কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। এর ফলে তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি তৈরি হবে।

এরপরে এ সূরায় পৃথিবীতে ছড়ানো-ছিটানো দলিল-প্রমাণ থেকে লিখিত দলিল (কোরআন) প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সেসব লোকের প্রশংসা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে। (২৯-৩০)

এরপর উম্মতে মুহাম্মদি-যাদের উপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

১. জালেম: এমন গুনাহগার মুসলমান, যার গুনাহ তার নেকির চেয়ে বেশি।

২. মুকতাসিদ: মধ্যমপন্থি, যার গুনাহ ও নেকি সমান সমান।

৩. সাবিক: সত্যবাদী মুমিন, যারা ইবাদত ও আনুগত্যের দিক থেকে অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে।

পরিশেষে এ তিনও শ্রেণির ঠিকানা জান্নাতেই হবে। কেউ সরাসরি জান্নাতে যাবে আর কেউ গুনাহের সাজা ভোগ করার পর জান্নাতে যাবে।

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালার ধৈর্য ও তার সহনশীলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি গুনাহের কারণে সাথে সাথেই পাকড়াও করেন না। যদি তিনি এমনটা করতেন তা হলে পৃথিবীতে মানুষ তো দূরের কথা, কোনো জীবজন্তু ও প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারত না। তিনি সকল অপরাধের সাজার একটি সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন। সে সময় যখন চলে আসবে তখন পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হবে।

সূরা ইয়াসিন

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৮৩। রুকু সংখ্যা: ৫

সহজে মৃত্যু হওয়ার জন্য মুসলমানরা এ সুরাটি পড়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ লোক এর ওপর আমল করে না। অথচ প্রকৃত সাওয়াব তো আমল করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এ সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের সত্যতার ব্যাপারে কোরআনের শপথ করেছেন। (২-৪)

এরপর সেসব কুরাইশ কাফেরের আলোচনা করা হয়েছে, যারা কুফর ও গোমরাহির ক্ষেত্রে অনেক আগে বেড়ে গিয়েছিল। ফলে তারা আল্লাহ তায়ালার আজাবের উপযুক্ত হয়েছে।

এরপর এক জনপদের আলোচনা করা হয়েছে, যারা একে একে তিনজন নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। এরপর তাদেরই মধ্য থেকে হকের অনুসারী, তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী এক ব্যক্তি তাদেরকে বুঝিয়েছে। কিন্তু তারা তাকে শহিদ করে ফেলেছে। কথাবার্তার কিছু অংশ তেইশতম পারার শুরুতে উল্লেখ হয়েছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :