প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। প্রকৃতিতে এখন তীব্র তাপদাহ। ছাতি ফাটা রোদে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। ভয়াবহ গরমে ঘরের বিছানা-বালিশ, আসবাবপত্র সব গরম হয়ে যাচ্ছে। ঘরের যত ফ্যান আছে, সিলিং ফ্যান, টেবিল ফ্যান সব চালিয়েও ঠাণ্ডা হচ্ছে না মানুষ। বাড়ির সবাই শরীর জ্বালাপোড়া থেকে শুরু করে পানিশূণ্যতাজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মুখে পড়েছেন। হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। গাছপালা কেটে ফেলা, গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাশয় ভরাটের কারণেই দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।
হিটওয়েভের কারণে বাড়ছে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়াসহ নানা ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে হৃদরোগে আক্রান্ত, ওজন বেশি রয়েছে এমন ব্যক্তি, প্রেশারের ও ডায়াবেটিসের রোগী, বয়ষ্ক মানুষ, শিশু, গর্ভবতী, খেলোয়াড় এবং যারা বাইরে কায়িক পরিশ্রমের পেশার সাথে জড়িত তারা সবচাইতে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকেন তাপপ্রবাহের সময়। তীব্র দাবদাহ থেকে শরীরে কী কী সমস্যা দেখা যেতে পারে-
হিট র্যাস
গরম বেড়েছে। এ গরমে দীর্ঘসময় কাটালে ঘাম হবে। এ প্রচণ্ড ঘাম থেকে শরীরে বাড়তে পারে হিট র্যাস বা ঘামাচি। এ ঘাম থেকে ঘর্মগ্রন্থিতে দেখা দেয় বিশেষ সমস্যা। ত্বকের এ অংশ ইরিটেট হয়ে গেলে ছোট ছোট গুটি বের হয়। তাই সতর্ক থাকতেই হবে।
হিট স্ট্রোক
দাবদাহ বাড়লে শোনা যাবে হিট স্ট্রোকের কথা। অনেকেই হিট স্ট্রোকের সমস্যা সম্পর্কে জানেন না। এক্ষেত্রে শরীর সঠিকভাবে ঠান্ডা হতে পারে না। শরীর নিজে থেকে ঠান্ডা হতে না পারলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় না। ফলে স্ট্রোকের মতো নানা লক্ষণ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যাওয়া, কিছু বুঝতে না পারা, কাঁপুনি পর্যন্ত হতে পারে। অনেক সময় এর থেকে অসুস্থ ব্যক্তি কোমায় চলে যান। এমনকি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াও অসম্ভব নয়।
হিট এক্সইউশন
ঘাম হলে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকবে লবণ ও পানি। কিছু পরিমাণ লবণ ও পানি বের হলে তেমন সমস্যা হয় না। তবে অনেকটা বেরিয়ে যেতে শুরু করলে দেখা দিতে পারে সমস্যা। এ সমস্যারই নাম হিট এক্সহউশন। এক্ষেত্রে অত্যধিক পানি পিপাসা, মাথা ঘোরা, চোখে কমা দেখা, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হিট ক্রাম্পস
শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি এবং লবণ বেরিয়ে যেতে থাকলে অনেক সমস্যাই দেখা দেয়। আর এমনই একটি সমস্যা হলো, হিট ক্রাম্পস। এক্ষেত্রে পেশিতে টান লাগে। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড ব্যথা হয়। মানুষ সেই অঙ্গটি ওই নির্দিষ্ট সময়ে নাড়াতে পারেন না। হিট ক্রাম্পস পা, হাত, কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে হতে পারে।
হিট সিনকোপ
দীর্ঘক্ষণ গরমে থাকার জন্য শরীরে অনেক সমস্যাই দেখা দেয়। এমনই একটি সমস্যা হলো হিট সিনকোপ। তীব্র গরমের কারণে মাথা ঘুরতে শুরু করে। মাথা ঘোরা ছাড়াও এ সময় কম দেখা, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ হিট র্যাস ছাড়া প্রতিটি সমস্যাই হলো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি।
গরমে সুস্থ থাকতে সতর্ক থাকা ছাড়া কোনো গতি নেই। সচেতন থাকলে অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। জেনে নিন প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ-
সূর্যের আলো এড়িয়ে চলা
সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রোদের তীব্রতা বেশি থাকে। এ সময় জরুরি কাজ না থাকলে বাইরে বের না হওয়াটাই ভালো।
ছাতা ব্যবহার
বাইরে বের হলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করা, যাতে সরাসরি রোদের মধ্যে থাকতে না হয়। এ সময় চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপও ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসকের মতে, যারা মাঠেঘাটে কাজ করেন, তারা মাথায় 'মাথাল' জাতীয় টুপি ব্যবহার করতে পারবেন, যা তাদের রোদ থেকে রক্ষা করবে।
বেশি করে পানি পান করা
গরমে ঘাম হয়ে শরীর থেকে প্রচুর পরিষ্কার পানি বের হয়ে যায়, তখন ইলেট্রোলাইট ইমব্যালান্স তৈরি হতে পারে। এ কারণে এই সময়টাতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। লবণ মিশিয়ে পানি পান করতে পারলে আরও ভালো। ফলের জুস খাওয়া শরীরের জন্য ভালো, তবে এ জাতীয় জুস খাওয়ার সময় দেখে নিতে হবে সেটি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত পানি দিয়ে তৈরি কিনা। খোলা, পথের পাশের দুষিত পানি বা সরবত এড়িয়ে চলতে হবে।
সূতির কাপড় পরতে হবে
গরমের এই সময়টায় জিন্স বা মোটা কাপড় না পরে সুতির নরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এ ধরনের কাপড়ে অতিরিক্ত ঘাম হবে না এবং শরীর ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করবে। গরমের সময় কালো বা গাঢ় রঙের কাপড় এগিয়ে সাদা বা হালকা রঙের কাপর পরিধান করা ভালো, কারণ হালকা কাপড় তাপ শোষণ করে কম।
সঠিক জুতা নির্বাচন
গরমের সময় খোলামেলা জুতা পরা উচিত, যাতে পায়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। কাপড় বা সিনথেটিকে বাদ দিয়ে চামড়ার জুতা হলে ভালো, কারণ এতে গরম কম লাগে। সম্ভব হলে মোজা এড়িয়ে চলা যেতে পারে।
ভারী ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন
ভারী ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার হজম করতে সময় বেশি লাগে। ফলে সেটি শরীরের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে এবং শরীরের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য সেটি আরো বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। খাবারের মেন্যু থেকে গরমের সময় তেলযুক্ত খাবার, মাংস, বিরিয়ানি, ফাস্টফুড ইত্যাদি বাদ দেয়া যেতে পারে। বরং শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া যেতে পারে। পুরনো বা বাসী খাবার না খাওয়াগরমে খাবার-দাবার তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বাসী খাবার বা আগের দিন রান্না করা খাবার খাওয়ার আগে দেখে নিতে হবে যে, সেটি নষ্ট কিনা। এ জাতীয় খাবার খেলে ডায়রিয়া, পাতলা পায়খানাসহ পেটের অসুখ হতে পারে।
ঘরে পানি ভর্তি বালতি রাখা
এসি না থাকলেও সমস্যা নেই। ঘরের ভেতর ফ্যানের নীচে একটি পানি ভর্তি বালতি রাখুন, যা ঘরকে খানিকটা ঠাণ্ডা করে তুলবে।
প্রতিদিন অবশ্যই গোসল করা
গরমের সময় প্রতিদিন অবশ্যই গোসল করতে হবে, যা শরীর ঠাণ্ডা রাখবে। দিনে একাধিকবার হাত, মুখ, পায়ে পানি দিয়ে ধুতে পারলে ভালো। বাইরে বের হলে একটি রুমাল ভিজিয়ে সঙ্গে রাখতে হবে, যা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুখ মুছে নেয়া যাবে।
হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা
প্রচণ্ড গরমে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে মাংসপেশি ব্যথা, দুর্বল লাগা ও প্রচণ্ড পিপাসা হওয়া, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলে প্রেশার পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এছাড়া প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো অধিকসংখ্যক গাছ লাগানো। কারণ প্রচন্ড তাপ থেকে পরিত্রাণ পাবো গাছের কাজকর্মে। বৃক্ষই পারে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা কমিয়ে রাখতে। বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানায় গাছ, যাকে ফটোসিন্থেসিস বলে। এ প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় অক্সিজেন। বায়ুমণ্ডল শুদ্ধ করার প্রাকৃতিক সম্পদ গাছ, বৃক্ষসমৃদ্ধ অরণ্য। আমাদের দরকার গাছ লাগানো, বৃক্ষ সম্পদ নষ্ট না করা। গাছ লাগানো মানে যে কোনও গাছ। বড় বৃক্ষ না হোক, বাঁশ-ঘাস-লতা হলেও নিজ গুণে সেই উদ্ভিদ বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেবে। অর্থাৎ আমাদের অক্সিজেন জোগাবে, ধরণী শীতল হবে।
(ঢাকাটাইমস/২৩ এপ্রিল/আরজেড)

মন্তব্য করুন