তীব্র গরমে কোন পাত্রে পানি পান করলে শরীর ঠান্ডা থাকে
দুর্বিষহ গরম থেকে রেহাই মিলছে না। কাজের প্রয়োজনে না চাইলেও রোদে বেরোতে হয় অনেককেই। তীব্র গরমে অনেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব দেখা দেয়। গরমে তৃষ্ণায় শান্তিলাভের জন্য স্বাস্থ্যকর পানির গুরুত্ব অপরিসীম। পানি শরীরের যাবতীয় অরগ্যানগুলো সচল রাখে, জীবন্ত রাখে।
প্রচন্ড তাপে ঘামের সঙ্গে পানি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম বেরিয়ে যায় বলে শরীরে ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়। তাই পানি খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে। ডিহাইড্রেশন রোধ করতে মাঝে-মধ্যে খেতে হবে লবণ-চিনির শরবত কিংবা ইলেকট্রল মেশানো পানি। বরফ বা ঠান্ডা পানি না-খাওয়াই ভালো। ত্বক সুস্থ, সুন্দর রাখার জন্য পানির বিকল্প নেই।
পানির স্বল্পতা দেখা দিলেই শরীরে নানাবিধ অসুস্থতা বাসা বাঁধা শুরু করে। যে কারণে বিশুদ্ধ পানি পানের প্রতি সবসময় জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এই পানি কীভাবে সংরক্ষণ করা উচিৎ, কী ধরণের পদার্থের পাত্রে পানি পান করলে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং শরীর ঠান্ডা থাকে সে বিষয়ের প্রতি একেবারেই জোর দেওয়া হয় না। অথচ পানি যে পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়, সেই পাত্রের উপাদান পানিতে পরিবর্তন ও পানিতে কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন তৈরি করার জন্য দায়ী।
গরমে বাড়ি ফিরে ফ্রিজের কনকনে ঠান্ডা পানি পান করলে গলায় সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। যাদের ঠান্ডা লাগার ধাত রয়েছে, তারা অনেক বেশি সমস্যায় পড়েন ফ্রিজের পানি পান করলে।
ফ্রিজের ঠান্ডা পানি যতটা সম্ভব কম খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এর বদলে বাড়িতে রাখতে পারেন মাটির কলস কিংবা তামার পাত্র। মাটির পাত্র এবং তামার পাত্রে রাখা পানি পান করা বেশি স্বাস্থ্যকর। গরমে শরীরও ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। জেনে নিন মাটির পাত্র এবং তামার পাত্রে রাখা পানি আপনাকে কীভাবে উপকার করবে-
মাটির পাত্র
রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচায় মাটির পাত্র। গরমে রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচতে আপনাকে সাহায্য করবে মাটির পাত্রে রাখা ঠান্ডা পানি। এটি সান স্ট্রোক থেকে সুরক্ষা দেবে। মাটির পাত্রে রাখা পানি পান করলে শরীরের গরম অনেকটাই কমে গিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়।
এছাড়া শরীরের মেটাবলিজম সঠিক রাখতে কাজ করে মাটির কলসি। মাটির পাত্রে একধরনের ইলেকট্রন থাকে যেটি শরীরের জন্য উপকারী। যে কারণে মাটির পাত্রে রাখা পানি পান করলে শরীরে মেটাবলিক রেট বাড়তে থাকে।
গরমে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা পানি পাওয়ার জন্য মাটির কলসির বিকল্প নেই। এটি এসময় শরীরের পক্ষে খুবই সহায়ক। এই পানি শরীরের আর্দ্রতা ধরে রাখতে কাজ করে। ফলে শরীর থাকে অনেকটাই সতেজ। এতে কোনো ধরনের রাসায়নিক থাকে না। যে কারণে এই পানি পানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয়ও নেই।
কাদা-মাটিতে থাকে অণুবীক্ষণিক ছোট ছোট ছিদ্র। ফলে এই কাদা-মাটির তৈরি পাত্রে পানি রাখা হলে বাষ্পীভবন ঘটে। আর এই প্রক্রিয়ায় পানি ঠাণ্ডা হয়।
মাটি প্রাকৃতিক ক্ষার সমৃদ্ধ এবং তা যখন পানির অম্লতার সংস্পর্শে আসে তখন তা পিএইচ’য়ের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। পানির সুষম পিএইচ বা অম্ল-ক্ষার নিয়ন্ত্রণে রেখে গ্যাসের ব্যথা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
খনিজ উপাদান এবং ইলেক্ট্রম্যাগনেটিক শক্তিতে সমৃদ্ধ থাকে কাদা-মাটি। তাই মাটির পাত্রে পানি সংরক্ষণ করা হলে তা পানির আরোগ্য ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
শরীরে টক্সিক কেমিক্যালের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে মাটির পাত্রে রাখা পানি। লোহা, স্টিল কিংবা প্লাস্টিক জাতীয় পাত্রে পানি রাখলে সেখান থেকে নানা ধরনের দূষিত পদার্থ ঢুকতে পারে শরীরে। তবে মাটির পাত্রে পানি রাখলে সেটি সম্ভব নয়। শরীরের অ্যাসিড দূর করতেও কাজ করে এটি।
মাটির কলসিতে পানি রাখলে পরিপাকতন্ত্র উন্নত হয়। পাকস্থলীতে খাবার হজমের জন্য অনেক রকম অ্যাসিড তৈরি হয়। মাটির পাত্রে পানি রাখলে জলে ক্ষার জাতীয় উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে এই পানি পান করলে পেটের বিভিন্ন প্রকার অ্যাসিড কিছুটা প্রশমিত হয়, অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য বজায় থাকে। গরমে হজম করতে অসুবিধা হয়, মাটির পাত্রে রাখা পানি পান করলে ভাল হজম হয়।
তামার পাত্র
সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে শরীরকে রক্ষা করে তামা। তামাতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের বৈশিষ্ট্য। যার অর্থ হল মুক্ত র্যাডিক্যালগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে নেগেটিভ প্রবাবগুলিকে দূর করতে সাহায্য করে। ফ্রি- র্যাডিক্যালগুলোর প্রভাব ক্যানসারের রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
উচ্চ-রক্তচাপে আক্রান্তেদর জন্য তামার পাত্রে পানি খাওয়া ভাল। মানসিক চাপ, স্ট্রেস কমিয়ে মানুষের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এই পদ্ধতি দারুণ কার্যকরী। তামা মানবদেহে অতিরিক্ত চর্বিকে হঠানোর জন্য দারুণ ভূমিকা পালন করে। ওজন কমাতে ও শরীরের চর্বি বার্ন করতে তামার পাত্রের পানি পান বেশ ভাল।
গবেষণায় জানা গিয়েছে, যে সব ব্যক্তিরা তামার পাত্রের জল পান করেন, সেই সব ব্যক্তিরা যখন বিশ্রামের মুডে থাকেন, তখনও শরীরে ফ্যাট বার্ন করতে তামা সাহায্য করে। তবে খেয়াল রাখা উচিত, অত্যাধিক পরিমাণে তামা যেন শরীরে প্রবেশ না করে, অতিরিক্ত তামা শরীরে বিষক্রিয়া করতে পারে।
প্রসঙ্গত, রক্তপাতজনিত ব্যাধী থাকলে তামার পাত্রের পানি পান করা বা ব্যবহার না করাই শ্রেয়। তামার পাত্রে কখনও গরম পানি বা খাবার রাখবেন না।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে সবসময় গোলাকার পাত্রের মধ্যেই পানি রাখা বা সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছে। পানি পান করার সর্বোত্তম তাপমাত্রা হল ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পানি পান করা। মানে ঘরের সাধারণ তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে। সেই তাপমাত্রায় জল আপনার শরীরকে হাইড্রেশন রাখতে সাহায্য করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে তামার মধ্যে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ও ভাইরাস থাকে। এগুলো ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে তামার। তাই তামার পাত্রে পানি ধরে রেখে তা পান করলে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তামার মধ্যে থাকা বিশেষ উপাদান আমাদের খাবার হজমে সাহায্য করে। পাকস্থলীকে ভালো রাখে তামা। তাই তামার পাত্রে পানি খাওয়া অভ্যেস করতে পারলে হজম ক্ষমতা অনেকটাই উন্নত হবে। যারা গ্যাস অম্বলের সমস্যায় ভোগেন, অবশ্যই তামার পাত্রে পানি খাওয়া অভ্যেস করুন। আলসার, বদহজম এবং লিভারে সংক্রমণ থাকলে তামার পাত্রে পানি খাওয়া অভ্যেস করুন। এর ফলে কিডনিও ভালো থাকে।
ত্বক ভাল রাখতেও সাহায্য করে এই অভ্যাস। এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট নানা ভাবে ত্বকের যত্ন নেয়।
হার্টের অসুখ এমনকি ক্যানসার রোধ করতেও তামা অত্যন্ত উপযোগী। হার্টরেট, রক্তচাপ এবং রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে তামা। এর ফলে তামার বোতলে পানি খেলে হার্টের অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে। এছাড়া তামার মধ্যে আছে ক্যানসার-রোধ করার উপাদান।
অনেকেই তামার গ্লাস বা বোতলে জল খান। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য পানি রেখে খেলে কেউ উপকার পাবেন না। এর জন্য অন্তত আট ঘণ্টা রেখে দিতে হবে পানি।
তামার পানিতে আয়রন সঞ্চার করে, ফলে রক্তে আয়রনের মাত্রা বাড়তে পারে। তাই তামার বোতলে পানি পানে অ্যানিমিয়ার সমস্যা কমতে পারে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে গরমে শরীর বেশ ঠান্ডা থাকে।
(ঢাকাটাইমস/২৯ এপ্রিল/আরজেড)