এক যুগের বেশি সময় ‘অফিস ফেরারি’ জামায়াতে ইসলামী

ঢাকার বড় মগবাজারে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয়। প্রায় ১৩ বছর ধরে দলটির এই কার্যালয় বন্ধ। পাশাপাশি পুরানা পল্টনে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী কার্যালয়েরও একই দশা। এক যুগের বেশি সময় ধরে এই দুটি কার্যালয়ে দলটির নেতাকর্মীদের আনাগোনা নেই। সেই হিসাবে বলা যায় এক যুগ ধরেই অফিসিয়ালি ফেরারি জামায়াতে ইসলামী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। সেসময় জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরও জোরালো হয়।
তবে গত ১৫ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংস হওয়ার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করে ধর্মভিত্তিক দলটি নিষিদ্ধের বিষয়ে একমত হন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতারা।
এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা মহানগরী অফিস সরেজমিনে দেখা গেছে, অফিস দুটিতে দলটির কোনো কার্যক্রমই নেই। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতের এই দুই কার্যালয়ে পুলিশ তালা দেয়। এরপর থেকে এই অবস্থায় পড়ে রয়েছে কার্যালয় দুটি।
রাজধানীর মগবাজার ওয়ারলেস রেলগেট পার হয়ে একটু সামনে গেলেই বামপাশে একটি গলি। স্থানীয়দের কাছে ব্যাপারি গলি নামে পরিচিত। ওই গলিতে ঢুকেই হাতের বামে চারতলা বিশিষ্ট ঘিয়ে রংয়ের পুরাতন একটি ভবন।
৫০৫ নং হোল্ডিংয়ের ভবনটি মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শন করেন প্রতিবেদক। দেখা গেছে, কার্যালয়টির প্রধান গেট ভিতর থেকে তালাবন্ধ। গেটটিও হয়ে গেছে জরাজীর্ণ। মাকড়সার জাল ও ধূলোর আস্তরণ পড়েছে। চেপে ধরেছে লতায়-পাতায়। সবমিলিয়ে যেন ভূতুড়ে পরিবেশ।
ভবনটির সামনে ডেইলি মিল্ক এন্ড মিল্ক প্রডাক্টস্ নামে একটি দোকান। সেটির মালিক স্বপন ঢাকা টাইমসকে জানান, তিনি গত এক যুগে এখানে কাউকে আসতে দেখেননি। লোকজনের আসা-যাওয়া না থাকায় অনেকেই এখন সেটিকে ভূতের বাড়ি বলেই চেনে।
পাশেই মায়ের আশীর্বাদ বিরিয়ানী এন্ড ক্যাটারিং হাউজ নামে খাবার হোটেল। হোটেলটির এক কর্মচারী রায়হান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি এখানে একমাস হলো কাজ শুরু করেছি। কখনো কোনো নেতাকর্মীকে এখানে আসতে দেখিনি। তবে ভিতরে কয়েকজন থাকেন। তারা এই ভবন পাহারা দেন।’
এরপর কার্যালয়টির প্রধান গেটের সামনে গিয়ে ডাকাডাকির এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীর আলম নামে লুঙ্গি ও টিশার্ট পরিহিত এক ব্যক্তি বেরিয়ে আসেন। নিজেকে ভবনের নিরাপত্তাকর্মী বলে পরিচয় দেন তিনি।
জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, গ্যারেজের জায়গাটিতে কোনো গাড়ি নেই। একপাশে পরিত্যক্ত টেবিল-চেয়ার স্তূপ করে রাখা। আরেক পাশে রয়েছে ইট-মাটি ও ময়লার স্তূপ। এর পাশেই দেয়াল বেয়ে প্রধান গেটের ওপর দিয়ে উঠেছে করলা গাছ।
নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা টাইমসকে জানান, ২০১১ সাল থেকে কার্যালয়টি বন্ধ। দলটির কোনো নেতাকর্মীও এখানে আসে না। তিনিসহ সাতজন নিরাপত্তাকর্মী পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন।
জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে আলাপকালে হাজির হন আজাদ নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘চারতলা ভবনটির মূল মালিকানা জামায়াতের দারুল ইসলাম ট্রাস্টের। মাস শেষে ট্রাস্ট থেকে আমাদের বেতন দেওয়া হয়।’
‘আসলে এখানে জামায়াতের নেতাকর্মীরা কেউ আসেন না। আমরা সাতজন ভবনটি দেখাশোনা করি। তেমন কোনো কাজ নেই আমাদের। বেশিরভাগ সময় অলস কাটাই’—যোগ করেন আজাদ।
কাছাকাছি পরিবেশ দেখা গেছে পুরানা পল্টনের জামায়াতের ঢাকা মহানগরী কার্যালয়ের। ভবনটির নিচতলার একপাশ পুরোপুরি বন্ধ। এমনকি অফিসটিতে প্রবেশের প্রধান দ্বারটিও এখন নেই। পাশেই নতুন একটি ভবন হওয়ায় প্রধান গেটটিও আড়ালে পড়ে গেছে। সিকিউরিটি গার্ডরা নতুন ভবনের পাশ দিয়েই চলাফেরা করেন। বুধবার সকালে সরেজমিনে প্রতিবেদক এমনটাই দেখতে পান।
জামায়াতের এই অফিসের গেটে একাধিকবার টোকা দেওয়ার পর শামসুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি গেট খুলে দিয়ে পরিচয় জানতে চান। পরিচয় জানার পর তিনি ভিতরে কার্যালয়টিতে নিয়ে যান।
কার্যালয়টি ঘুরে দেখা যায়, ৯তলা বিশিষ্ট ভবনটির প্রত্যেকটি ফ্লোরই এখন আর ব্যবহার হয় না। ব্যবহার না হওয়ায় ধুলাবালি পড়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে।
এই ভবনটিতে শামসুদ্দিনসহ চারজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত। তাদের মধ্যে শামসুদ্দিন ও শেখ জাকির নামে আরেকজনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। আলাপকালে তারা জানান, কার্যালয় বন্ধ হওয়ার পর থেকে এখন আর কোনো নেতাকর্মী আসে না।
শামসুদ্দিন বলেন, ‘আগে মাঝেমধ্যে কেউ কেউ আসত। তবে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে এখন আর কেউ আসে না। কিছুদিন আগে আমাদের একজন গাড়ি ড্রাইভার এসেছিল, তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।’
শেখ জাকির বলেন, ‘আমরা চারজন নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। আমরাই থাকি এখানে। আর কেউ থাকে না। কেউ আসেও না।’
(ঢাকাটাইমস/৩১জুলাই/ডিএম)

মন্তব্য করুন