অ্যালকোহল বাড়াতে পারে মারাত্মক রোগের ঝুঁকি
অ্যালকোহল বা মদের নেশা সর্বনাশা। বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রার অ্যালকোহল বা মদ একটি অংশ হয়ে উঠেছে। পার্টি ও উৎসবমুখর পরিবেশে অ্যালকোহল পানে অভ্যাসের শিকার হতে হচ্ছে৷ অভিজাত পরিবারে মদ্যপান স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অ্যালকোহল সেবনে কেউ সাময়িকভাবে কিছুটা আরাম অনুভব করতে পারে; কিন্তু বেশি অ্যালকোহল সেবনে রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেল বৃদ্ধি পেতে পারে, যার ফলে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে হার্টঅ্যাটাক এবং স্ট্রোক হতে পারে। রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেল বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ হতে পারে। নিয়মিত অ্যালকোহল পান করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তবে অ্যালকোহল সবসময়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করেন এবং একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক মেক-আপ করেন তাদের অ্যালকোহল-সম্পর্কিত সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা ছয় গুণ বেশি। অ্যালকোহল দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির গণনা এখানেই শেষ নয়। এটি পান করলে স্বাস্থ্যের আরও অনেক ক্ষতি হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, অ্যালকোহল শরীরকে পানিশূন্য করে দেয়। ফলে ডিহাইড্রেশনের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। ত্বকের সংক্রমণ, এমনকি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সারা বিশ্বে এই আসক্তির কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অ্যালকোহল ও স্বাস্থ্য বিষয়ে ডব্লিউএইচওর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ২০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি অ্যালকোহলের কারণে ঘটে। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, অ্যালকোহল–সংশ্লিষ্ট নৃশংসতা, নির্যাতন, নানা রোগ ও অসুস্থতা এর জন্য দায়ী।
অ্যালকোহল মস্তিস্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক, ব্রেন, মুড বা আচরণ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ড্রাগের উপর নির্ভরতা বাড়ায় এমনকি বেহুঁশ হয়ে মানুষ কি করছে তা অনুধাবন করতে পারে না। অ্যালকোহল বা মদ পান করে গাড়ি চালানোর প্রত্যক্ষ কুফল হিসেবে অনেক লোক মারা গেছে!
রসায়নে অ্যালকোহল বলতে এমন সব জৈব যৌগকে বোঝায়, যাদের হাইড্রক্সিল কার্যকরী গ্রুপটি একটি অ্যালকাইল বা অ্যারাইল গ্রুপের কার্বনের সাথে একটি বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই অ্যালকোহল বলতে ইথাইল অ্যালকোহলকেই বোঝানো হয়েছে। অ্যালকোহল বা ইথাইল অ্যালকোহল মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া লিভারের উপর অ্যালকোহলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমরা প্রায় সকলেই জানি।
অ্যালকোহলের যথেচ্ছ ব্যবহারে মানুষের যক্ষ্মা, এইচআইভি ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আমাদের শরীর এলকোহল পানীয়কে এসিটাইলডিহাইডে রূপান্তরিত করে। এসিটাইল ডিহাইড একটি কারসিনোজেন অর্থাৎ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান।
অ্যালকোহল সরাসরি সাত ধরনের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে- মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সার (ওরাল ক্যাভিটি, ফেরিংস ও ল্যারিংস), খাদ্যনালী ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে- প্রোস্টেট এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের সাথেও অ্যালকোহলের যোগসূত্র থাকতে পারে; যদিও তার কোনো স্পষ্ট এবং জোরাল প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যারা নিয়মিত মদ্যপান বা অ্যালকোহল সেবন করে থাকেন, তাদের যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, এইচআইভি বা এইডস, যৌনবাহিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। কারণ অতিরিক্ত মদ্যপানকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণে নিজেদের সম্পৃক্ত করে থাকে। ফলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদে অ্যালকোহল সেবনের ফলে মস্তিস্ক, যকৃত ও হার্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিরোসিস, অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস, ফাইব্রোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, এরিথমিয়া, স্ট্রোক, প্যানক্রিয়েটাইটিসের মতো প্রাণঘাতি রোগ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে অ্যালকোহল সেবনের ফলে মুখ, গলা, ব্রেস্ট এবং লিভারের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল সেবনে ডিমেনসিয়া হতে পারে। বিয়ার, ওয়াইন, এলকোহল যেকোনো রূপে সেবন করলে বেশি প্রস্রাব করতে হয়। এলকোহল মুখকে শুষ্ক করে এবং ডিহাইড্রেশন করে থাকে। এ অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে থাকে।
অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মদ পান করলে ঘুমের স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হতে পারে। যারা অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য এই অভ্যাস ক্ষতিকর। মদ খাওয়া ছেড়ে দিলে ঘুম ভাল হয়।
মদ খাওয়া ছাড়তে না পারলে জিম, ডায়েট করেও রোগা হতে পারবেন না। কারণ, মদে ক্যালোরির পরিমাণ বেশি। দিনের পর দিন এই ক্যালোরি-যুক্ত পানীয় মেদের স্তর বাড়িয়ে দেবে।
নিয়মিত মদ পান করার অভ্যাস থাকলে লিভারের ক্ষতি হতে বাধ্য। মাসখানেক মদ না খেলে লিভারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষতি রুখে দেওয়া যায়।
মদ পান করার অভ্যাস ত্যাগ করলে মস্তিষ্কের স্নায়ুর বয়সজনিত সমস্যাও রুখে দেওয়া যায়। টানা তিরিশ দিন মদ না খেলে স্মৃতি লোপ পাওয়া, ভুলে যাওয়া কিংবা উদ্বেগের মতো সমস্যাও বশে রাখা যায়।
অতিরিক্ত মদ পান করলে অল্প বয়সেই ত্বক বুড়িয়ে যেতে পারে। ত্বকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দু’টি প্রোটিন হল ‘কোলাজেন’ এবং ‘ইলাস্টিন’। এই দু’টি উপাদান ত্বকের গঠন এবং টান টান ভাব বজায় রাখতেও সাহায্য করে। বেশি মদ পান করলে এই দু’টি উপাদান নষ্ট হয়। ফলে ত্বকে টান টান ভাব নষ্ট হয়। বয়সজনিত নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়।
অ্যালকোহল পানে মহিলাদের ভ্রূণ অ্যালকোহল সিন্ড্রোম হতে পারে। মাঝে মাঝে মদ পান করে এমন প্রমাণ রয়েছে গর্ভবতী মা ভ্রূণের বিকাশকে বিপন্ন করতে পারে এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরনের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্বাভাবিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধি এবং ধীর বিকাশ।
নিয়মিত অ্যালকোহল পান করা আপনার সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে । আপনি যদি অ্যালকোহল পানে আসক্ত হন তবে এটি বাইপোলার ডিস-অর্ডার, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
যে কোনও অভ্যাস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মনের শক্তি শরীরের তুলনায় অনেক বেশি৷ তাই মদ পানের আসক্তি ত্যাগের ক্ষেত্রে মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করুন৷ সঙ্কল্প নিন সুস্থ শরীর গঠনে মদ বা অ্যালকোহল পান আপনি ছেড়ে দেবেনই৷
(ঢাকাটাইমস/৭ সেপ্টেম্বর/আরজেড)