বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র-হুমকি বরদাস্ত করা হবে না: ১২ দলীয় জোটের নেতারা

বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ও হুমকি বরদাস্ত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা।

তারা বলেন, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য ক্ষমা চাইতে হবে। ভারতের আগ্রাসী নীতির ফলে প্রতিবেশী সবগুলো দেশের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

নেতৃবৃন্দ বলেন, “পাকিস্তান-নেপাল-শ্রীলংকা-মালদ্বীপ-আফগানিস্তান কেউই ভারতকে বিশ্বাস করে না। সবাই এখন ভারতের অবিবেচক ও নেতিবাচক আচরণে অতিষ্ঠ। ভারতের পুতুল শেখ হাসিনা সরকারের কারণে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাংলাদেশের জনগণ ভারতের উৎপীড়নে ক্ষুব্ধ ছিল। খুনি হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত আরও দৃঢ়ভাবে বৈরী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারতের আগ্রাসী মনোভাব এবং কর্তৃত্বশীল আচরণকে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই মেনে নেবে না।”

মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ১২ দলের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের আগ্রাসী হুমকির প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সমাবেশ শেষে প্রেসক্লাব চত্বরে একটি সংক্ষিপ্ত মিছিল বের করেন নেতারা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত এক মাসের কার্যকলাপের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান ভূমিকা হলো আমাদের দেশের পররাষ্ট্রনীতি তার নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং খুব ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ভারত আমাদের দেশের বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেনি। ভারতকে আমরা আজও বন্ধু হিসেবে গণ্য করতে চাই। কিন্তু তাদের থেকে কোনো অবন্ধুসুলভ আচরণ সহ্য করতে পারি না। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এই কথাগুলো বলেছেন। সেই কারণে রাজনাথ সিং এত ক্ষুব্ধ হয়েছেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের চারদিকে আজ একটি অশান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, অরুণাচলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ভারত যদি তার পরিস্থিতি পরিবর্তন না করে তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কী নেমে আসবে সেটা আমরা জানি না। অরুণাচল প্রদেশে ইতিমধ্যে ৬০ কিলোমিটার ভিতরে আরেকটি রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের ভূখণ্ডে কোনোভাবেই অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হোক সেটা আমরা চাই না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমরা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে, সার্বভৌমত্বের অক্ষুণ্ণতা নিয়ে আগামীদিনে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে পথ চলতে চাই। ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়া, আমাদের সীমান্তের সমস্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করা।”

সভাপতির বক্তব্যে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র এবং বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ভারতের এমন বক্তব্যে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। সরকারের উচিত এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করা। ভারত যদি আমাদের ওপর চোখ রাঙায়, তাহলে সেই চোখ উপড়ে ফেলার ক্ষমতা আমাদের আছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুধু কোটার জন্য করা হয়নি, এটা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল।”

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদেরকে আরও কঠোর এবং শক্ত হতে হবে। আমরা আপনাদেরকে সাহায্য করব। আপনারা মৌলিক সংস্কার করে একটা সুন্দর নির্বাচন দিবেন।”

প্রধান বক্তা বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নানারকম সংকটে পড়েছে। তবুও সেখানকার মানুষ বলে এখনো কেন শেখ হাসিনার বিচার হচ্ছে না। এই এক মাস পাঁচ দিনে শেখ পরিবারের কাউকে বিচারের আওতায় আনলে মানুষ বিশ্বাস করতো। আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি। জনগণ বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা প্রশ্ন তুলছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বলব, অপরাধীরা কোথায়?”

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা মন্ত্রী আমিও কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মন বড়। তারা ক্ষমা করতে জানে। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিবেন সেটা কেউ মেনে নেবে না।”

তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিন। আজকে দেশবাসী সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকি। আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা যাতে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে না পারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে ইনশাআল্লাহ।”

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, “ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আমরা বরদাস্ত করব না। ভারতের আগ্রাসনের দিন শেষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। সুতরাং বাংলাদেশের দিকে নজর না দিয়ে নিজের ঘর সামলান। মণিপুরে কিন্তু সাত রং এর পতাকা উড্ডীন হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে সাবধান।”

তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে খুনি, দুর্নীতিবাজ এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার ভিত্তিতে আগামীতে বাংলাদেশ সংস্কার হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম বলেন, “মণিপুর কিন্তু ইতিমধ্যে ভারতের পতাকা ছিঁড়ে ফেলেছে। তারা নিজেদের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। সুতরাং ভারতকে বলব, আগে নিজেদের ঘর সামলান। বাংলাদেশ নিয়ে কোনো চক্রান্ত মেনে নেওয়া হবে না। এটা ওলি-আউলিয়াদের দেশ। এটা সম্প্রীতির দেশ।” তিনি বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন সেটা বাস্তবায়ন করুন। আমরা সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ চাই না। অবিলম্বে আপনারা রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।”

অন্য বক্তারা বলেন, দেশের মালিক জনগণ। অথচ ভারত বরাবরই জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ছলেবলে কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত শেখ হাসিনার অবৈধ সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কবর দিতে দ্বিধা করেনি।

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, ভারতকে আগ্রাসী নীতি ও ভূমিকা ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ন্যায়সংগত ও বন্ধুসুলভ আচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের আস্থা লাভ করতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে, ৫৪টি অভিন্ন নদীর ন্যায়সঙ্গত পানি বণ্টনের চুক্তি করতে হবে এবং খুনি হাসিনা ও পলাতক অপরাধীদের বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ করতে হবে। হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার চেষ্টাই ভারতের বিচ্যুত পররাষ্ট্রনীতিকে যৌক্তিক কক্ষপথে ফিরিয়ে আনবে এবং সেটাই হবে ভারতের জন্য উত্তম পন্থা।

বাংলাদেশ এলডিপির অতিরিক্ত মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটুর পরিচালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব শাহ আহমেদ বাদল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি–জাগপার সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের সিনিয়র সহ-সভাপতি শওকত আমীন, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি– পিএনপির চেয়ারম্যান ফিরোজ মো. লিটন ও নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি মাস্টার এম এ মান্নান প্রমুখ।

(ঢাকাটাইমস/১০সেপ্টেম্বর/এমআই/এফএ)