গণমাধ্যম সংস্কারে সবার পরামর্শ নিয়ে কমিশন গঠন হবে: নাহিদ ইসলাম
গণমাধ্যম সংস্কারে মালিক, সাংবাদিক, সম্পাদকসহ অন্যান্য সব পক্ষের সঙ্গে বসে পরামর্শ নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘সংবাদ মাধ্যম সংস্কার: কেন? কীভাবে?’ শীর্ষক একটি মুক্ত আলোচনায় তথ্য উপদেষ্টা এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের গঠনের জন্য সব পক্ষের সঙ্গে বসা শেষ হয়নি। মালিক, সাংবাদিক, সম্পাদকসহ অন্যান্য সব পক্ষের সঙ্গে বসে পরামর্শ নিয়ে কমিশন গঠন করা হবে। সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বসা হয়েছে। আজকের এই আলোচনাটাও এক ধরণের ইনসাইট দেবে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বসতে হবে। সব পক্ষের সঙ্গে বসে তাদের একটা পরামর্শ নিয়ে আমরা সংস্কার কমিশনটা ঘোষণা করতে পারবো।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সবসময় সম্পাদক বা মালিক পক্ষের সঙ্গে বসা হচ্ছে, কিন্তু যারা মাঠে কাজ করেন তাদের ভয়েজ আমাদের কাছে আসে না। এই অনুষ্ঠান সেই দূরত্ব দূর করতে ভূমিকা পালন করবে। ভবিষ্যতে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করার চেষ্টা করবো।’
তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যখন মুক্ত গণমাধ্যম বা গণ্যমাধ্যম সংস্কারের কথা বলছি আজকের আলোচনায় সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বকেই সেন্ট্রাল পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়েছে। এটা খুবই যুক্তিযুক্ত যে, সাংবাদিকতা যদি একটা পেশা হয়, তাহলে কতটুকু পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সেই কাজ যদি না করতে পারে তাহলে তার কারণ ও সমস্যা কী, সেটা থেকেও বের করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ থাকে। সাংবাদিকতাকে এক ধরনের আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা থাকে। অর্থনৈতিকভাবে গণমাধ্যমকে নানা ধরনের বাধা দেওয়া হয়। সাংবাদিকতাকে যদি পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে চিন্তা করি, তাহলে সে ধরনের চর্চা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। আমাদের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি গড়ে ওঠেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার খুব অল্প সময়ের দায়িত্বের অভিজ্ঞতায় সাংবাদিকতা নিয়ে আমি যেটি বুঝেছি সেটি হচ্ছে এখানে নানামুখী স্টেক হোল্ডার ও পরস্পর বিরোধী পক্ষ রয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে ও ঐক্যমতে আসতে হবে। যখন ওয়েজবোর্ডের কথা আসে তখন সম্পাদক ও মালিকরা এর বিরোধিতা করে। আবার অনেক সময় বিভিন্ন হাউজ থেকে বেতন পরিশোধ করা হয় না। মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা এগুলো নিয়ে অভিযোগ করেন, আমি যতটুকু জানতে পেরেছি।’
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘তাহলে এই দায়িত্বটা কে নেবে? যদি দায়িত্বশীলদের বলা হয়, তখন তারা বলে সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিএফআই দিয়ে চাপ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কাউকে না কাউকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই নীতিগত সংস্কারের কথা বলছি। একইসঙ্গে সাংবাদিকদের মধ্য থেকেও সেই রেজিস্ট্যান্স প্রয়োজন। আমরা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে সাংবাদিকদের মধ্যে সেটি দেখেছিলাম। কিন্তু এই আন্দোলনে সেটি দেখা যায়নি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। আমরা সামনের দিকে এগোতে চাই, যাতে তরুণরা এ পেশায় আসতে পারে। কিন্তু তরুণদের মধ্যে এই আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। একটা সময় এই পেশাকে মর্যাদার সঙ্গে দেখা হত। সেই জায়গাটা এখন কমে এসেছে। সেই জায়গার সমাধানে যাওয়ার চেষ্টা করবো।’
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকতাকে বলি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু এই স্তম্ভের খেয়াল তো আমরা করিনি। আমাদের বিচার বিভাগ, আমাদের প্রশাসন— এগুলোর দিকে মনযোগ ছিলো। কিন্তু আমরা এমন এক ট্রেন যে, সবার দিকে লাইট ফেলি কিন্তু নিজের দিকে আমাদের লাইটটা পড়ে না। আমরা নিজেরা নিজেদেরকে অন্ধকারে রেখেছিলাম। আমরা জনগণের কন্ঠস্বর, এগুলো আমরা বলি কিন্তু আমরা এর আগে নিজেদেরকে নিয়ে এভাবে কথা বলেছি?’
পিআইবি মহাপরিচালক সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ, আমরা সাংবাদিকরা এটা পাহারা দেওয়ার জন্য কী ভূমিকা পালন করব? আমাদের বিগ পাওয়ারহুড এবং বিগ মিডিয়া এটা আপনাকে ছোট করতেই হবে। একজন মালিকের একটার বেশি মিডিয়া থাকতে পারবে না। তারপর কালো টাকার মালিকদের মিডিয়াতে আসা কীভাবে বন্ধ করা যায়? আপনি মিডিয়া বন্ধ না করেন, যার কালো টাকা আছে তাকে ধরেন। তার যে অর্থনৈতিক অবদান সেখানে তাকে ধরেন। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ যেন না ওঠে।’
আইন সংস্কার হলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা হবে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকের থেকে সাংবাদিকদের বেতন কম। কারন গার্মেন্টস শ্রমিকরা রক্ত দিয়েছে। দিয়ে দিয়ে... তারা এখনো দিচ্ছে। আমাদের সব পেশার একটা সুরক্ষা আছে। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার কী সুরক্ষা আছে? আমাদের যে সাংবাদিক কল্যান ট্রাস্ট সেটাকে কী আরও শক্তিশালী করতে হবে? নাকি প্রেসক্লাবের দ্বায়িত্ব নেবে নাকি আমাদের সবচেয়ে বড় যে হোতা প্রেস কাউন্সিল সেটাকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী করা এবং তার মধ্যদিয়ে অনেকগুলো কাজ ঠিক করতে হবে। আমাদের যদি কম্পিটিশন বাড়ে তাহলে ভালো সাংবাদিকরা সামনে আসবে। আর আমাদের আইন যদি সংস্কার হয় তাহলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা হবে।’
এসময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, ‘উপদেষ্টা মহাদয় সংস্কার কমিশন নিয়ে কথা বলেছেন। আমাদের তরফ থেকে আমরা বলতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূস সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলেছেন মিডয়া ফ্রিডম, প্রেস ফ্রিডম নননিগোশিয়েবল। এই জায়গায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবো না। আপনারা দেখেছেন প্রায় দুই মাস এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে কোথাও কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়েছে কি না। আমি মনে করি স্বাধীনতার পরে গত দুইটা মাস ছিল গোল্ডেন পিরিয়ড।’
‘কিন্তু কথা হচ্ছে এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। আমরা ধরে রাখবো কীভাবে। এটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। আগের সরকারে আমরা যে সমস্যাগুলো ফেস করেছি পরবর্তীতে একটি রাজনৈতিক সরকার আসলে যেন সেই সমস্যা ফেস না করতে হয়। পরবর্তী যে রাজনৈতিক সরকার আসবে তারা হয়তো আরও ভালো করবেন। কিন্তু আমরা যে ভয়ের সময় কাটিয়েছি সেটা যে আবার পুনরাবৃত্তি হবে না সেটির কোনো গ্যারান্টি নেই। যতগুলো কালা আইন আছে সেগুলো নিয়ে আমাদের মিডিয়ার সংস্কার কমিশন কথা বলবে’ বলেন শফিকুল আলম।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিম খান, কাওসার মাহমুদ, খাজা মইনউদ্দিন, আহমেদ জুয়েল, অধ্যাপক আর আর রাজী, আসাদুল কিবরিয়া, আরিফুল সাজ্জাদ প্রমুখ।
(ঢাকাটাইমস/৭অক্টোবর/এমআই/এজে/এসআইএস)