ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে ভেষজ ওষুধ দারুচিনি

গরম মশলার অপরিহার্য পদ দারুচিনি। খাবারের সুগন্ধ বাড়াতেও দারুচিনির জুড়ি মেলা ভার। ভেষজ ওষুধ তৈরির উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই মসলা। প্রাচীনকালে বহু ভাইরাস ধ্বংস করে দেওয়ার নজির দেখিয়েছে এই দারুচিনিই। গবেষকরা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষতিকর ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কাজে আসতে পারে দারুচিনি। তাই সুগন্ধি এই পদকে শুধু খাবারে ব্যবহার করলেই চলবে না।
দারুচিনি লরেল পরিবারের একটি চিরসবুজ উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম সিনামোমাস জেইলানিকাম। একটি মসলা বৃক্ষের নাম। কাঠের ছাল শুকানোর প্রক্রিয়াতে প্রাপ্ত মশালাকে বোঝাতে একই শব্দ ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিক পরিবেশে এই বৃক্ষের উচ্চতা দশ থেকে পনের মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আদি নিবাস শ্রীলংকায়। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ ও চীন প্রভৃতি দেশে ও উৎপাদিত হচ্ছে। দেখতে কিছুটা তেজপাতা বৃক্ষের মতো এই বৃক্ষের চামড়াটা মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দারুচিনির সুগন্ধ যুক্ত তৈল ও পাওয়া যায়।
সাধারণত দুই ধরনের দারুচিনি পাওয়া যায়। সেইলন দারুচিনি ও চাইনিজ বা ক্যাশিয়া দারুচিনি। সেইলন দারুচিনি চাইনিজ দারুচিনির থেকে অনেক বেশি কার্যকরী। নাম শুনেই বোঝা যায়, সেইলন দারুচিনি শ্রীলঙ্কায় উদ্ভব, আর মূলত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
১ চামচ দারুচিনিতে সাধারণত যা যা পুষ্টিকর উপাদান থাকে সে গুলো হলো- ক্যালরি – ৬.৪২, কার্বোহাইড্রেট – ২.১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম – ২৬.১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম – ১.৫৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস – ১১.২ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম – ১১.২ মিলিগ্রাম।
বিভিন্ন ওষুধসম্বন্ধীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যেও দারচিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘সিনামালডিহাইড’ খাবারের গন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ক্ষেত্রে কার্যকরী হয়ে ওঠে। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে দারুচিনি। এছাড়াও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবেও দারুচিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। রক্তের গ্লুকোজ হ্রাস করতে পারে দারুচিনি। এ কারণেই এটি ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ডায়াবেটিস হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এজন্য ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
শুধুমাত্র ডায়াবেটিস রোগ নয়, বিভিন্ন পেটের সমস্যার ক্ষেত্রেও দারুচিনি গুরুত্বপূর্ণ। ডায়রিয়ার মোকাবিলা করার জন্যেও দারুচিনি নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। আয়ুর্বেদে, দারুচিনির ছাল অনেক সময়ে দাঁতের যন্ত্রণায় বা জয়েন্টের ব্যথার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
দারুচিনি শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আমাদের শারীরিক প্রতিরক্ষার জন্য প্রদাহ গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রদাহে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আর সেটার পরিমাণই মূলত কমিয়ে দিতে পারে দারুচিনি। এই দারুচিনির মধ্যেই রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট পলিফেনল ও প্রোঅ্যান্থোসায়ানাইডিন, যা কোনও ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। এছাড়াও দারুচিনি মেদ ঝরাতেও কাজে আসে। শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং হার্টের রোগ নির্মূল করতেও খুবই সহায়ক দারুচিনি। দারুচিনির অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রপার্টি বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
আয়ুর্বেদিক ওষুধপত্র বা চিকিৎসার ক্ষেত্রে দারুচিনি বহুকাল ধরেই রক্তে বাড়তি শর্করার মাত্রা কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। সম্প্রতিকালে দেখা গিয়েছে যে ৪০ দিন ধরে প্রতিদিন ৬ গ্রাম দারুচিনি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকতে পারে। এর সঙ্গে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর ক্ষেত্রেও দারুচিনি অত্যন্ত কার্যকর।
বেশি মাত্রায় দারুচিনি সেবন লিভারের ক্ষতি করতে পারে। কেউ যদি রক্ত তরল করার ওষুধ নিয়মিত খায়, বা কাউকে যদি ডায়াবেটিস মোকাবিলা করার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, তাহলে তাদের জন্য বেশি মাত্রায় দারুচিনি না খাওয়াই শ্রেয়। বাজারে দারুচিনির নামে অনেক ধরনের গাছের ছাল দারুচিনি বলে বিক্রি হয়ে থাকে। কেনার আগে গন্ধ এবং একটু ভেঙে মুখে দিয়ে দেখুন ঝাঁজালো স্বাদ কি না।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, স্প্যানিশ ফ্লু নির্মূল করার অন্যতম সেরা ওষুধ ছিল দারুচিনির গুঁড়া। কেউ কেউ আবার দুধে সামান্য পরিমাণ দারুচিনি তেল ব্যবহার করেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রিপোর্টে এ-ও বলা হয়েছে যে, এইচআইভি, অ্যাডিনোভাইরাস ও হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের বিরুদ্ধেও দারুচিনি ব্যাপক ভাবে কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
দারুচিনি আসলে শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। আমাদের শারীরিক প্রতিরক্ষার জন্য প্রদাহ গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রদাহে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। আর সেটার পরিমাণই মূলত কমিয়ে দিতে পারে দারুচিনি। এই দারুচিনির মধ্যেই রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট পলিফেনল ও প্রোঅ্যান্থোসায়ানাইডিন, যা কোনও ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। এছাড়াও দারুচিনি মেদ ঝরাতেও কাজে আসে। শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং হার্টের রোগ নির্মূল করতেও খুবই সহায়ক দারুচিনি। দারুচিনির অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল প্রপার্টি বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
দারুচিনির প্রোসায়ানাইডিন পলিমার এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদেরকে এইচআইভি কন্ট্রোলার্সে পরিণত করতে পারবে। গবেষকরা আসে দারুচিনিতে যে মলিকিউল পেয়েছেন তা এইচআইভি ভাইরাসকে দমিয়ে রেখে ডিফেন্স প্রোটিনকে সুরক্ষা দিতে পারে। এছাড়াও সেই গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে, দারুচিনির সিনামালডিহাইড শ্বাসতন্ত্রের রোগ অ্যাডিনোভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর।
জাপানের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সেলন দারুচিনির মধ্যে থাকা উপাদান সিনাজিলানিন বাকুলোভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাধা দিয়েছে। বাকুলোভাইরাস আদতে পোকামাকড়কে সংক্রমিত করে। এই উপাদান হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস-১ ও হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস-২ এর বিরুদ্ধে কার্যকরী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী হার্বাল মেডিসিনের অন্যতম অনুষঙ্গ হল দারুচিনি। বিশেষ করে বুকের যে কোনও ধরনের অসুস্থতায় দারুচিনি ব্যবহৃত হয়। ডাক্তারেরা বলছেন, নিয়মিত দারুচিনি খেলে নিউমোনিয়া, শ্বাসনালির ফুলে ওঠা, কাশি, গলার কর্কশতা ও শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধা কমাতে সাহায্য করে।
দারুচিনি খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি
দারুচিনিকে পানিতে সিদ্ধ করে অথবা গরম পানিতে দারুচিনির গুঁড়া মিশিয়ে পান করলে এর সঠিক উপকারিতা পাওয়া যায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দারুচিনির তেল ব্যবহার করা উচিত নয়। সিনামন অয়েল এত বেশি শক্তিশালী যে এক বা দুই ফোঁটার বেশি খেলে শরীরের ভেতর পুড়ে যেতে পারে। কোনও খাবারে ঠিক কতটা পরিমাণ সিনামন অয়েল মিশিয়ে খেলে শরীরের কোনও ক্ষতি হবে না, তা জানতে অতি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
(ঢাকাটাইমস/১৫ অক্টোবর/আরজেড)

মন্তব্য করুন