জেলা আ.লীগ নেতা সুরুজ্জামান
শ্রমিক ঠিকাদার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক
খাদ্য বিভাগের শ্রমিক ঠিকাদার থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ্জামান। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শ্রমিক ঠিকাদার সুরুজ্জামানকে তার ভক্ত, অনুসারী ও অনুরাগীরা ‘বস জামান’ আরও নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করতেন।
রাজনীতিতে সুরুজ্জামান পরস্পরের বিরুদ্ধে কুবুদ্ধি দেওয়ার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বোমা বানানো ও বিরোধী দলের ওপর তা প্রয়োগে দক্ষ কারিগর ছিলেন তিনি। তাই তাকে অনেকেই ‘বোমা জামান’ হিসেবে সম্বোধন করেন।
এভাবেই তিনি জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হয়ে ওঠেন একজন গডফাদার। রাজনৈতিক মহলে আলাপে এভাবেই চিত্রায়িত হন সুরুজ্জামান।
তার নিজের এলাকা বন্দেরবাড়ী, মুকন্দবাড়ি, দড়িপাড়া, মালগুদাম রোড, স্টেশন রোড ও গেইটাপাড়ে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিংহজানি খাদ্য গুদাম, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড, জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ তার এলাকার সব সরকারি অফিস এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
এলাকায় জমি দখল, রেলওয়ের জমি দখল, বালু ব্যবসা, বিভিন্ন কাজের পার্সেন্টেজ, জমির ব্যবসা, নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি ও বুয়া রাইস মিল দেখিয়ে ধান-চালের বরাদ্দ নিয়ে অবৈধভাবে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হন তিনি।
ছাত্রজীবনে জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) রাজনীতি করতেন সুরুজ্জামান। ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তারপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
জানা যায়, সেই সময় জামালপুর আওয়ামী লীগ দুই গ্রুপে বিভক্ত ছিল। একটি নিয়ন্ত্রণ করতেন মির্জা আজম, আরেকটি তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রায়ত আইনজীবী মতিউর রহমান তালুকদার। তখন মাঝেমধ্যেই শহরে দুই গ্রুপে তুমুল বন্দুকযুদ্ধ হয়। চার্জ করা হয়েছে ককটেল ও বোমা। সেই গ্রুপিং রাজনীতির সময় সুরুজ্জামান মির্জা আজমের অনুসারী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই সুরুজ্জামান বোমা তৈরিতে বেশ পারদর্শী ছিলেন। তখন জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। ১৯৯২ সালে তৎকালীন বিএনপির সরকারের আমলে উত্তাল আন্দোলনে বোমা জামান ছিল বিএনপি ও নিজদলের নেতা-কর্মীদের মাঝে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। ক্ষমতাসীন বিএনপিকে দমাতে ও মতিউর রহমান তালুকদারের গ্রুপকে প্রতিহত করতে তিনি মির্জা আজমের হয়ে ককটেল ও বোমা তৈরি করতেন। তখন থেকে বোমা জামান হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
সেই গ্রুপিং রাজনীতির পুরস্কার হিসেবে ১৯৯৬ সালে জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন সুরুজ্জামান। শক্ত অবস্থান তৈরি হয় আওয়ামী লীগে। পরে তিনি বাগিয়ে নেন জেলা যুবলীগের আহ্বায়কের পদ।
মির্জা আজমের আস্থাভাজন হিসেবে ২০০৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং ২০১৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তিনি।
২০০৮ সালে সিংহজানি মৌজার প্রায় ৪৫ শতাংশ জমি স্থানীয় কয়েকজন ভূমি ব্যবসায়ী কিনে প্লট তৈরি করতে গেলে বাধা দেন জামান। পরে সেখান থেকে সুরুজ্জামান ১৩ শতাংশ জমি দখল করে নেন। তিনি সেখানে আরও ১৪ শতাংশ জমি দখল করে ছাপড়া (এক চালা ঘর) ঘর তৈরি করেন বলে জানা যায়।
পৌর শহরের মালগুদাম রোডে জমি জবর দখলের অভিযোগ জানিয়ে বিএনপির নেতা মোহাম্মদ মোকছেদুর রহমান হারুন বলেন, ‘মালগুদাম রোডে প্রায় ৪৫ শতাংশ জমি কয়েকজনে মিলে কিনেছিলাম। জামান সেই জমিতে যেতে আমাদের বাধা দেয়। এ সময় তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ১৩ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করেন। ওই জমির কোনো কাগজপত্র তার নেই। এখন ওই জমির দাম দুই কোটি টাকার বেশি।’
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাকালীন রেলের জমি ইজারা নিয়ে ৪টি পুকুর, বিএডিসির প্রায় ২ একর জমিতে পুকুর ও ছোট গুদাম ঘর, মুরগি ও গরুর খামার করেছেন সুরুজ্জামান। নিয়ন্ত্রণ করতেন বিএডিসির বীজ কেন্দ্রের শ্রমিক ও বীজের সকল ব্যবসা। এখান থেকে তিনি পেতেন পার্সেন্টেজ।
সিংহজানী খাদ্যগুদামের মাল লোড-আনলোডের শ্রমিক ও সব ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল জামানের। রাইস মিলের মালিক না হয়েও ভুয়া মালিক সেজে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে ধান চাল বরাদ্দ নিতেন এবং অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার কারণে বিএডিসির অনেক পুরনো ব্যবসায়ী সরে যেতে বাধ্য হন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন সুরুজ্জামান। প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেও তিনি নিজেকে অধ্যাপক পরিচয় দিতেন। এখানেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। কলেজের পুরো নিয়ন্ত্রণ তার কব্জায় নিতে শুরু করেন একের পর এক ষড়যন্ত্র। কলেজের বিরুদ্ধে করেন মামলা। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয় তৎকালীন অধ্যক্ষকে। পরে ২০১৯ সালে কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন সুরুজ্জামান।
কলেজের পদ হারিয়ে আস্তানা গাড়েন প্রেসক্লাবে এবং স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে। সেই পত্রিকার সম্পাদকের পরামর্শে নিজের সব অপর্কম ঢাকতে একটি দৈনিক পত্রিকার অনুমোদন নেন তিনি। সেই পত্রিকার নামেই তার প্রেসক্লাবে আগমন। তার ষড়যন্ত্রে জেলার প্রথম সারি বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ক্লাব থেকে বহিষ্কার হতে হয়। এরপর ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। অবৈধভাবে একটি প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবেও। ওই ক্লাবটিকে তিনি তার নিজস্ব বা দলীয় কার্যালয়ের মতো ব্যবহার করতেন।
প্রেসক্লাব জামালপুরের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রেসক্লাব ছিল জামানের নিজস্ব অফিস। সকালে এসে বসতেন দুপুরে যেতেন। আবার সন্ধ্যায় আসতেন গভীর রাতে যেতেন। এ সময় তিনি ক্লাবে বসে তার দলীয় লোকজন নিয়ে রাজনৈতিক, ঠিকাদারি, দখলদারি, সরকারি খাদ্যগুদাম ও বিএডিসি অফিস নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্ম করতেন। তার কারণে ক্লাবের কয়েকজন সাংবাদিককে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়।
এভাবে নানা অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে শ্বশুরবাড়ি দড়িপাড়া টাইঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গড়েন বিলাসবহুল পাঁচতলা বাড়ি। ওই বাসস্ট্যান্ডে তার আরও বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেই ফ্ল্যাটে তার মেয়ে থাকেন বলে জানা যায়। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকাতে রয়েছে নামে বেনামে জমি।
বন্দেরপাড়া গ্রামের সুজন বলেন, ‘গত ১৬ বছর এলাকার মানুষ জামানের ভয়ে টু শব্দ করতে পারেনি। তার ভয়ে মসজিদেও কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। তিনি খাদ্য ও বিএডিসি অফিস এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাকে কমিশন দিতে হতো। তিনি রেলের ও বিএডিসির জমি দখল করে পুকুর, গোডাউন ও খামার দিয়েছেন।’
জামালপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তারিক মালেক সিজার বলেন, ‘জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ করতেন। তখন তিনি ককটেল বানাতে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। লেখাপড়া শেষে জামালপুর এসেও তিনি ৯০ সালের দিকে জাসদের মিছিল করেন। আমরা দেখেছি। সেই সময় জামালপুর শহরের কোনো মারামারিতে বোমা বা ককটেলের প্রয়োজন হলে তাকে ডাকা হতো। তিনি সবসময় ককটেল সাপ্লাই দিতেন। এভাবেই তার নাম হয়ে উঠে বোমা জামান।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, যারা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে সম্পদ অর্জন করেছে তাদের সম্পদ জব্দ করাসহ অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের পর শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালালে আওয়ামী লীগের এই নেতা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
(ঢাকাটাইমস/০২নভেম্বর/মোআ)
মন্তব্য করুন