নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে ও আইন ভেঙে মুনাফা লুটছে ইউনাইটেড পাওয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ২২:০৫| আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩২
অ- অ+

বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ইউপিজিডি) নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎখাতে লুটপাট চালাচ্ছে। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আপত্তি ও আদালতে আবেদন নাকচ হওয়ার পরও বিশেষ সুবিধায় কম দামে গ্যাস কেনা এবং বেআইনিভাবে ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় বিদ্যুৎ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিভিন্ন নথিপত্র আর নিয়ন্ত্রক কমিশনের বক্তব্য থেকে এমনই অনিয়মের অভিযোগ বেরিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করে বলে জানা যায়।

নথিপত্র ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অসম্মতি আর আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কম মূল্যে গ্যাস কেনার সুযোগ করে দেয় ইউনাইটেড পাওয়ারকে। সেই সুবিধা এখনো পেয়ে যাচ্ছে হঠাৎ বিদ্যুতের মাফিয়া হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে সরকারের; আর দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে গ্রাহকের পকেট কেটে যাচ্ছে কোম্পানিটি।

ঢাকার ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৭২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে ইউনাইটেড। আইন না মানার পাশাপাশি হুমকি, উৎকোচ, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তোলা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। এ প্রক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সরাসরি জড়িত ছিল এবং শেখ হাসিনা সরকার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দেয়।

এই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে ইতিমধ্যে হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটেছে ইউনাইটেড পাওয়ার। তারা প্রতি ঘনমিটারে গ্যাস কিনছে ১৬.৭৫ টাকা দরে, কিন্তু একই গ্যাস অন্যান্য বিদ্যুৎ কোম্পানির কিনতে হচ্ছে ৩০.৭৫ টাকায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য বলছে, গ্যাস দিয়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৪.১৭ টাকা, সেই বিদ্যুৎ ইউনাইটেড ১০.৮৮ টাকা দরে বিক্রি করছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে।

আইনে যা আছে

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দেশের আইনে ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) ও ক্যাপটিভ ক্যাটাগরির কথা উল্লেখ রয়েছে। আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করে তা সরকারকে দেবে। তবে তারা বাইরে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে না। কমার্শিয়াল ক্যাটাগরির ক্যাপটিভের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজস্ব কারখানায় ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অংশ শর্তসাপেক্ষে বিক্রি করার সীমিত সুযোগ আছে। তবে তার দাম নির্ধারণ করবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইনে পাঁচ ধরনের লাইসেন্সের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- বিদ্যুৎ উৎপাদন, এনার্জি সঞ্চালন, এনার্জি বিপণন ও বিতরণ, এনার্জি সরবরাহ এবং এনার্জি মজুদকরণ। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি, আরইবি, ডিপিডিসি, ডেসকো, নেসকো, ওজোপাডিকো ছাড়া কাউকে বিদ্যুৎ বিতরণে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।

কম দামে গ্যাস কিনতে ক্ষমতা দেখায় ইউনাইটেড

ইউনাইটেড পাওয়ার সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে না, তাই ক্যাপটিভ বিবেচনায় তাদের জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা নির্ধারণ করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু ইউনাইটেড পাওয়ার আইপিপি ক্যাটাগরির দরে (১৬ টাকা) গ্যাস পেতে তদবির ও ক্ষমতা ব্যবহার করে।

জানা যায়, বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল তাদের চাপের মুখেও জানিয়ে দেন, আইনে কোনোভাবেই আইপিপি হিসেবে কাভার করে না ইউনাইটেড। তাই ক্যাপটিভের দরেই তাদের গ্যাসের দাম দিতে হবে।

আরও পড়ুন:- ইউনাইটেড গ্রুপের রাজা-পুত্রসহ হত্যা মামলার আসামি, কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে?

বিইআরসির আদেশ থোড়াই কেয়ার করে ইউনাইটেড পাওয়ার। তারা ক্যাপটিভ হয়েও আইপিপির দর ভাগিয়ে নেয় নানা অনিয়ম আর কৌশলে। সেটা কীভাবে?

তৎকালীন বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী শনিবার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কীভাবে ইউনাইটেড আইপিপির দর পেল বুঝতে পারি না। তারা আমাদের কাছে আবেদন নিয়ে এলে আমরা তা নাকচ করে দেই। পরে রিভিউয়ের আবেদন করলে সেটাও নাকচ হয়ে যায়। এরপর উচ্চ আদালতে গেলে সেখানেও তাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়।’

মকবুল ই-এলাহী বলেন, ‘তাদের (ইউনেইটেড) প্রকল্পের হয়ে একজন লোক আমাদের কাছে তদবির নিয়ে এসেছিল। আমরা জানিয়ে দিই ভবিষ্যতে যেন তিনি এসব বিষয় নিয়ে আর না আসেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তখন বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিতে প্রায়ই কমিশনে আসতেন ইউনাইটেড পাওয়ারের বর্তমান চেয়ারম্যান সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল মুবীন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা থাকতেন। তারা কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিতেন। কিন্তু তাদের চোখরাঙানি আর বন্দুকের নল উপেক্ষা করে কমিশন। এরপরও ইউনাইটেড পাওয়ার কীভাবে নিয়মবহির্ভূত সুবিধার অনুমতি পেল সেটা বর্তমান সরকারের বের করা উচিত।’

বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, ‘আইনগতভাবে ইউনাইটেডের ১৬ টাকায় গ্যাস পাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরেও তারা কম মূল্যে গ্যাস নিচ্ছে, এটা বিস্ময়কর।’

জানা যায়, বিইআরসি ও আদালতে ব্যর্থ হয়ে ইউনাইটেড সুবিধাভোগী গোষ্ঠী নিয়ে হাজির হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখান থেকে আইপিপি সুবিধার লাইসেন্স পেতে অনুমোদনের চিঠি বের করে নেয় তারা।

প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের নিয়মবহির্ভূত প্রকল্পের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ারভুক্ত কেউ কি না প্রশ্ন তোলেন ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম। তার ওপর ইউনাইটেডের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্যাপটিভ শ্রেণির, তাই তাদের আইপিপির ১৬ টাকা রেটে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ নেই। বলেন এই জ্বালানি উপদেষ্টা।

ড. শামসুল আলম বলেন, ‘তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইনের ঊর্ধ্বে নন। আর অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার তো তার ছিল না। ইউনাইটেডের পক্ষে এই অনুমোদন রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

বিশেষ সুবিধার চিঠিতে যা ছিল

এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও আদালতে হারার পর ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈনুদ্দীন হাসান রশীদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে যে চিঠি বের করে আনেন, তাতে সহায়তা করে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। ইউনাইটেড পাওয়ারের ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি হিসেবে লাইসেন্স দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয় চিঠিতে।

বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব সাইফুল আজাদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ অনুমোদনের প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি-২০২৩ মাস হতে ক্যাপটিভ শ্রেণিতে ৩০ টাকা (ঘনমিটার) হিসেবে গ্যাস ক্রয় করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইউনাইটেড পাওয়ার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই চলতি মাস (ফেব্রুয়ারি) থেকে ইউনাইটেড পাওয়ারের ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে স্থাপিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি হিসেবে লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

ইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানতে ইউনাইটেড গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার (ব্র্যান্ড) শীষ স্বপ্নিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকাটাইমস। তিনি এ বিষয়ে লিখিত প্রশ্ন চান। বেলা তিনটা চার মিনিটে তাদের পিআর শাখায় এবং সন্ধ্যা সাতটা ৪২ মিনিটে শীষ স্বপ্নিককে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের তরফ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

(ঢাকাটাইমস/০২নভেম্বর/এসএস/মোআ)

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যশোরে ট্রাকচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল জেলা ৩১৫ বি ৩ আয়োজিত কুমিল্লা এবং চাঁদপুর জেলার ত্রাণ বিতরণ
আজ দেশে ফিরছেন মির্জা ফখরুল, বিকালে যোগ দেবেন যৌথসভায়
ওজন কমানো থেকে ক্যানসার-ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, সবেতেই ওস্তাদ বাঁধাকপি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা