মামলা-বাণিজ্য, করিমগঞ্জে ‘আওয়ামী’ আইনজীবী খোকনের বিরুদ্ধে ফুঁসছে জনতা

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় বিএনপি ও সাধারণ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা করানোর অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় একজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য শওকত কবীর খোকন নামের এই আইনজীবীর মামলা-বাণিজ্যে অতিষ্ঠ বিএনপির নেতাকর্মী ও এলাকার নিরীহ মানুষ ফুঁসে উঠেছেন। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ কর্মসূচি ও বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। রবিবার (৫ জানুয়ারি) দুপুরে উপজেলার নানশ্রী ফিশারি মোড়ে এলাকাবাসী একাট্টা হয়ে মানববন্ধন করে। এ সময় ‘মামলা-বাণিজ্যের কারিগর’ খোকনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেন তারা। তা না হলে পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে বলে মানববন্ধনে হুঁশিয়ারি দেন বক্তারা।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন করিমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক কবির হোসেন, রকি ভূইয়া, জয়কা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর, সাধারণ সম্পাদক রবিউল আওয়াল রবি, প্রচার সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, শ্রমিক দলের সভাপতি মাহফুজুর রহমান ফকির, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ফজলুর রহমান, শ্রমিক দলের সভাপতি সুমন মিয়া, করিমগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মেসবাহ উদ্দিন সুমন প্রমুখ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, শওকত কবীর খোকন তার এক নিকটাত্মীয়ের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর বার কাউন্সিল পরীক্ষা দিয়ে আইনজীবী সনদ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন খোকন। সঙ্গে তার তিন ভাইও। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর তারা মিথ্যা মামলায় মেতে উঠেছেন।
অভিযোগ আছে, খোকনের ভাই মাহবুবুর রহমান রিপন করিমগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে এলাকার মানুষের জমি ও দোকানপাট দখল করতেন তিনি। এলাকায় চাঁদা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও তার নাম আসছে। সাধারণ মানুষের জায়গা-জমির কাগজপত্রের কোনো সমস্যা থাকলে আইনজীবী ভাইকে (খোকন) দিয়ে দেন-দরবার করিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, সরকার পতনের পর শওকত কবীর খোকন নিজেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার মামলা পরিচালনাকারী বলে পরিচয় দেন। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সময় হওয়া মামলায় খোকন নিজেকে সমন্বয়কদের আইনজীবী পরিচয় দিতেন। এসব দাবি করে মামলা-বাণিজ্য করে আসছেন খোকন। তার মামলা-বাণিজ্যের শিকার হয়ে আসামি তালিকায় নাম ওঠে অনেক সাধারণ মানুষের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন খোকন। তাকে ভোট না দেওয়ায় মারধরের শিকার হন অনেক ভোটার। তার কারণে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয় স্থানীয় বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে। যারা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। আগেও নির্যাতনের শিকার গ্রামবাসী তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও আইন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেয়।
আইনজীবী খোকনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি অবহিত হওয়ায় গত বছরের ২৭ আগস্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা তাকে বহিষ্কার করে। ২০০২ সালে করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদের কাছে ইউনিয়নের গরিব-দুস্থ মানুষের জন্য বরাদ্দ সরকারি অনুদান, কাবিখা, কাবিটার ওপর পার্সেন্টেজ দাবি করেন তিনি। হারুন অর রশীদ তা দিতে অস্বীকার করলে খোকন তাকে মারধর করেন। এই ঘটনায় খোকনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই মামলায় কয়েক মাস কারাগারে ছিলেন খোকন। ২০০৩ সালেও তিনি কারাগারে যান।
২০০৩ সালে করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন খোকন। সেই নির্বাচনে তিনি হেরে যান। তাকে ভোট না দেওয়ার অপরাধে জয়কা ইউনিয়ন বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিমসহ অনেককে মারধর করেন। ২০০৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন তিনি। তবে একবারও জয়ী হতে পারেননি।
২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের দিন দক্ষিণ নানশ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র জোরপূর্বক দখল করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন খোকন ও তার ভাই ডিউটিরত পুলিশ সদস্যকে মারধর করেন। এই ঘটনায় একাধিক মামলা হলে খোকন ও তার ভাই রিপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের গ্রেপ্তারের খবরে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
খোকনের শ্বশুরবাড়ি মিটামইন উপজেলায় হওয়ায় তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের আত্মীয় পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলেন তিনি। কিশোরগঞ্জে অনেক ভুয়া মামলার নেপথ্যের কারিগর এই আইনজীবী। এসব মামলায় জমিজমা নিয়ে বিরোধ থাকা সাধারণ মানুষ ও প্রবাসীদের টার্গেট করে মামলা করা হয়। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে খোকনের বিরুদ্ধে।
জয়কা ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন বিএনপির নেতাকর্মী ও এলাকার নিরীহ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আজ বিক্ষুব্ধ হাজার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধন করেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আশরাফ আলী সোহান বলেন, ‘কিছু অসাধু লোক আমাদের বৈধ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।’
অভিযোগের বিষয়ে শওকত কবীর খোকনের সঙ্গে মোবাইলে ও সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
(ঢাকাটাইমস/৫জানুয়ারি/মোআ)
মন্তব্য করুন