হালুয়াঘাটে বাদামি পোকার আক্রমণ: আধাপাকা ধান কাটছে কৃষক

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাটের প্রান্তিক কৃষক জুয়েল মিয়া। ১৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছিল। সবে মাত্র ধান পাকা শুরু হয়েছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে তার আবাদ করা খেতে গিয়ে দেখেন বেশিরভাগ খেতে বাদামি (কারেন্ট) পোকা আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলেছে। ধান খেত দেখিয়ে তিনি বলেন, “বন্যায় আমান ধান খাইয়া গেল, বহু কষ্টে ধারদেনা কইরা ১৫ কাডা জমিতে হাইব্রিড ও ২৯ জাতের বোরো ধান লাগাইছিলাম। মাত্র দুইদিনের ব্যবধানে আমার খেত খাইয়া শেষ কইরা ফালাইলো কারেন্ট পোহা। শেষ সময়েই আইসা স্বপ্নডা ভাইংগা যাইবো ভাববার পারি নাই। আমার খোরাকীর ধানও তো পাইতাম না। আমরার কৃষকের মরণ ছাড়া উপায় কী?”
বর্গাচাষী জুয়েলের বাড়ি উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের গোরকপুর গ্রামে। এমন আক্ষেপ শুধু জুয়েল মিয়ার একার নয়, বাদামী পোকার আক্রমণে এমন বিপাকে পড়েছেন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষকরা।
বৃহস্পতিবার ও আজ শুক্রবার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা সদর, জুগলী, ধারা, ধুরাইল, কৈচাপুর, নড়াইল, আমতৈল, বিলডোরা, শাকুয়াই স্বদেশী ইউনিয়নে আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হলেও হাইব্রিড ব্রি জাতের ধান ও ২৯ জাতের ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকরা। তারা জানান, এই জাতের ধানে বাদামি বা কারেন্ট পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এক খেতে আক্রমণ হলে পরের দিন পাশের খেতে হানা দেয় লাখ লাখ বাদামি পোকা। এক রাতের মধ্যে ধান গাছ খেয়ে সাবার করে ফেলে। এতে ধানের মাজা মরে গিয়ে শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে যায়। কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো উন্নতী দেখতে না পেয়ে কৃষকরা হতাশ হয়ে ভয়ে আধাপাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে শ্রমিকের মজুরি বেশি ও ধানের দাম কম হওয়ায় তারা বোরো ধান নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। কৃষকরা অভিযোগ করেন, সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ কৃষি বিভাগ থেকে তারা পাচ্ছেন না।
ধুরাইল ইউনিয়নের বাসিন্দা নূর হক ও শরাফ মিয়া অভিযোগ করেন, ধানের চারা লাগানো থেকে আজ অব্দি কৃষি অফিসের কোনো কর্মকর্তাকে তারা চোখেও দেখেন নাই।
আজ সকালে উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের গোরকপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাদামী পোকার আক্রমণে নষ্ট হওয়া আধাপাকা ধান কাটছেন কৃষক হিরা মিয়া ও শরাফ মিয়া। এসময় শরাফ মিয়া বলেন, “বন্যায় ধান খাইয়া যাওয়ার পর ভাবলাম বোরো ধান দিয়া কিছুটা হলেও ক্ষতি পুশিয়ে নিবো। সে ভাগ্য আর অইলো না। পোকায় খাইয়া নষ্ট করার চাইয়া আধাপাকা ধান কাইট্টা ঘরে তুলন ভালা আছে।”
কৈচাপুর ইউনিয়নের কৃষক নজরুল ইসলাম নিজের জমিতে নিজেই ধান কাটছেন। এসময় তিনি বলেন, “এক কাঠা জমিতে ভালো ধান অইলে পাওয়া যায় ৩-৪ মণ। এইবার অতিরিক্ত খরচে বোরো আবাদ করেও আশা রাখছিলাম ভালো ফলন হবে। এরই মধ্যে শিল পইরা নষ্ট অইয়া গেল অর্ধেক ধান। এখন আবার বাদামি পোকার আক্রমণে অর্ধেক খেত নষ্ট করে ফেলছে। জনপ্রতি ১ হাজার টাকা মজুরি দিয়া এই ধান কাটলে শ্রমিকের মজুরী মিলবে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই কাটতেছি।”
ধারা ইউনিয়নের কুতুরা গ্রামের মেজবা উদ্দিন, ১৫ শতক জমিতে ২৯ জাতের ধান চাষ করেছিলেন। তিনি বলেন, “ভাই কৃষকের মরণ ছাড়া উপায় নাই। দেশে যে কি পোহা আইলো খেতে নামলেই খেত শেষ। আমার ১৫ শতক ২৯ ধান খাইয়া শেষ কইরা দিছে। এহন উপায় কি সংসারের খুরাকী কি দিয়া চালাইমু?”
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় ২২ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। ইতোমধ্যে আগাম জাতের ধান ২৪% কর্তন করা হয়েছে। এসব জমিতে কৃষকেরা উচ্চ ফলনশীল ব্রি-৩৬, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৭৪, ব্রি-৮১, স্থানীয় জাতের ধানের আবাদ করেছেন। তবে কিছু এলাকায় আগাম জাতের ব্রি ২৮ ও ৮১ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। কিন্তু শেষ সময়ে শিলাবৃষ্টি ও রোগবালাইয়ের কারণে কৃষকেরা কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সেই ক্ষতি পূরণ করতে এখন চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ।
কৃষকরা ভয়ে আধাপাকা ধান কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বোরো খেতে যদি ৮০% ধান পেকে যায় তবে সে খেতের ধান কাটার উপযুক্ত হয়ে যায়। কৃষকদের ভয়ের কিছু নেই ৮০% ধান পেকে গেলে ধান কেটে ফেললেও তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।”
(ঢাকাটাইমস/০২মে/এফএ)

মন্তব্য করুন