ডাক্তারদের দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন কার স্বার্থে
নৌশিন লায়লার চিঠিটা আমাকে পুরনো একটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। নৌশিন লায়লাকে আমি চিনি না। তবে তার চিঠির বিষয়বস্তু আমার খুবই চেনা। কেবল আমিই নই, দেশের অনেক মানুষই এমন ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছেন, অনেকে বিপদেও পড়েছেন। অনেকের মনের কথাই যেন ছোট্ট একটি চিঠিতে প্রকাশ করে দিলেন মাইজদী নোয়াখালীর নৌশিন লায়লা।
সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ এর ৬ নভেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে নৌশিন লায়লার চিঠিটি। এর বিষয়বস্তু ছিল ডাক্তারদের দুর্বোধ্য হাতে লেখা ব্যবস্থাপত্র। রোগী দেখে ডাক্তাররা যে প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকে, সেটা প্রায়ই তারা হাতে লিখে দিয়ে। তাদের হাতের লেখা থাকে অনেক সময়ই দুর্বোধ্য, গ্রামের ফার্মেসিতে থাকা ওষুধ-বিক্রেতারা অনেক সময় সেই প্রেসক্রিপশনের লেখা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। ফলে তারা একটা ধারণা থেকে আন্দাজে ওষুধ দেয়। আর সেই ভুল ওষুধ খাওয়ার কারণে অনেক সময় রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়।
এবার আমার ঘটনাটি বলি। সেটি বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমার পরিবারের একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তেমন কোনো জটিল অসুখ নয়, সামান্য গা-ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব। তখন আমি দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার। ওখানে আমি স্বাস্থ্য বিট নিয়ে কাজ করতাম। ফলে অনেক বড় বড় ডাক্তারের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল। তেমনই একজন বড় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তিনি একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ কিনতে গিয়েই যত বিপত্তি। প্রেসক্রিপশনে দুটো কি তিনটি ওষুধ লেখা ছিল। আমার আপত্তি ছিল একটা ওষুধ নিয়ে। ওষুধ দোকানের লোকটি আমাকে Secnidal ট্যাবলেট দিল। বললাম, ডাক্তার সম্ভবত এই ওষুধটি লিখেনি। আপনি আবার দেখুন। দোকানি আবার দেখলেন, আমাকেও দেখালেন। টানা হাতে প্যাঁচানো এবং দুর্বোধ্য লেখা। তবে প্রথম অক্ষরটি ‘এস’ বোঝা যাচ্ছে, শেষ অক্ষরটি যে ‘এল’ তাও স্পষ্ট। এল এর আগের অক্ষরটিকে ‘এ’ এর মতোই মনে হচ্ছে। আর তারও আগের অক্ষরটি যে ‘ডি’ তা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই, আর এর আগের অক্ষরটির ওপর একটি ফোটা দেখা দেখে মনে হয় ওটা ‘আই’ ই হবে। সবই তো সেকনিডালের সঙ্গে মিলে যায়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
আসলে সমস্যা ছিল আমার মধ্যে। এই সেকনিডাল ওষুধটি আমি আগে থেকেই চিনতাম। এই ওষুধটি যখন বাংলাদেশে মার্কেটিং করা হয়, এভেন্টিসের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম। অনেক বড় বড় ডাক্তার সেখানে ছিলেন, আমি গিয়েছিলাম সাংবাদিক হিসেবে। সায়েন্টিফিক অনেক কথাবার্তার মধ্যে আমি যতটুকু বুঝেছিলাম তা হচ্ছে, এই ওষুধটিকে আমাশয় নিরাময়ে ব্যবহার করা যাবে। আর এটির সবচেয়ে সুবিধাজনক দিক হচ্ছে, এটি সিঙ্গেল ডোজের ওষুধ, একদিন খেলেই হবে। আমার রোগীর তো আমাশয় বা পেটের কোনো সমস্যা নেই। আর ডাক্তার যদি সেকনিডালই দিয়ে থাকবেন, তাহলে ১২টি ট্যাবলেট কেন দেবেন? তিন বেলা করে চারদিন কেন খেতে বলবেন?
দোকানিকে বললাম, ভাই আপনি ভুল ওষুধ দিয়েছেন। জবাবে তিনি বললেন, হতে পারে। ডাক্তার সাহেবের লেখা তো বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে আপনিই বলুন, ওখানে কি লেখা রয়েছে? আমি বার কয়েক চেষ্টা করলাম, নিশ্চিত করে বুঝতে পারলাম না, তবে প্রতিবারই শব্দটিকে ‘সেকনিডাল’ই মনে হলো। বললাম, প্রেসক্রিপশনটা একটু অন্য কাউকে দেখান। আমার কথায় তার বিরক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি তা হলেন না। কারণ ততক্ষণে তাকে আমি বুঝিয়ে বলেছি, আমাশয় জাতীয় কোনো রোগের সমস্য আমার রোগীর নেই। এরই মধ্যে দোকানেই থাকা বয়স্ক একজন লোক এলেন, সব দেখে শুনে তিনি বললেন, এটা তাহলে Seridol (সেরিডল) হবে।
এটা কি ওষুধ? জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন, এটা প্যারাসিটামল। সোনেয়ার কোম্পানির। তেমন একটা চালু ব্রান্ড নয়। তাই অনেকে ঠিক চেনে না, বেশি দোকানে পাবেন না। আমার এখানেও নেই। এর পরিবর্তে আপনাকে অন্য কোম্পানির প্যারাসিটামল দিতে পারি।
না, আমি অন্য কোম্পানির প্যারাসিটামল নিলাম না। সোনেয়ার কোম্পানির সেরিডলই খুঁজতে লাগলাম। কারণ ওষুধটি আমার দেখতে ইচ্ছা করছিল। ওটির বানানটি ঠিক কেমন তা জানতে ইচ্ছা করছিল। শেষ পর্যন্ত মিটফোর্ড এলাকা থেকে ওষুধটি পেয়েছিলাম। বানানটি দেখলাম। বুঝতে পারলাম ওষুধ দোকানের ভদ্রলোক যে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, সেটা এমনি এমনি নয়। ইংরেজি টানা হাতে লিখলে সেরিডলকে অনেকটা সেকনিডালের মতোই লাগে।
এবার আসলেই আমাকে আতঙ্ক পেয়ে বসল। আমি না হয় এভেন্টিস কোম্পানির ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, ফলে কাকতালীয়ভাবে পরিচিত হয়েছিলাম সেকনিডালের সঙ্গে। না হলে কি হতো? দোকানি তো আমাকে ১২টি সেকনিডালই দিয়েছিলেন। সেগুলো এনে যদি রোগীকে খাওয়ানো হতো? এই একই প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওই ডাক্তার সাহেবকে। শুনে তিনিও আতঙ্কিত হয়েছিলেন। নিজের হাতের লেখা নিয়ে তিনি কিছুটা লজ্জিতও হয়েছিলেন। তারপর একটু অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ওষুধ দোকানগুলোতে তো পাস করা ফার্মাসিস্ট নেই বললেই চলে, আনাড়ি অশিক্ষিতদের এনে বসিয়ে রাখে। আর ওষুধ কোম্পানিগুলোও জেনেরিকের পরিবর্তে ব্র্যান্ড নামে ওষুধ বাজারজাত করায় কত হাজার হাজার নাম যে আসছে প্রতিনিয়ত, কয়টা নাম আর মনে রাখা যায়?
স্বাস্থ্য বিটে কাজ করার কারণে ডাক্তার সাহেবের অসহায়ত্ব ও বিরক্তির বিষয়টা আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু আমার উপলব্ধিতে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সমাধানের জন্য কেউ কিছু করেছে বলেও তো দেখছি না। এই যে ঘটনাটি বললাম, এটি আজ থেকে কমপক্ষে তের-চৌদ্দ বছর আগের কথা। এর মধ্যে পরিস্থিতির কোনোই উন্নতি হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে। খারাপ কেন বলছি? এজন্য বলছি যে, এর মধ্যে আরও অনেক নতুন নতুন ওষুধ এসেছে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ব্র্যান্ড নাম। এক প্যারাসিটামলেরই রয়েছে শতাধিক ব্র্যান্ড নাম। এইস, এসেপ, এসেটা, এসেটো, এসেটোপেন, এক্ট, একটল, এনালপেন, আরচি, এসমল, এসটা, এটোপেন, এটিপি, সেন্টামল, সেটাডল, সেটাল, সেটাম, সিপিমল, ডি-সিটামল, ডেপল, ডেপাইরিন, ডোলা, এনাইল, ফ্যাপ, ফাস্ট, ফিয়া, ফেভা, ফিবি, ফেবাক, হেপা, লংপারা, নাপা, নিপাÑ এসবই এক প্যারাসিটামলের ব্র্যান্ড নাম। এক এক কোম্পানির এক এক নাম। এখানে আসলে সব বলা হয়নি, আরও আছে। এখন এসব থেকে ডাক্তার মনে রাখবেন কয়টি? আর এসব নামের তো কোনো অর্থ হয় না, কোম্পানিগুলো যার যা মনে হয় রেখে দেয়। ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ওষুধের নাম প্রায় সমোচ্চারিত হয়ে যায়। বানানও প্রায় কাছাকাছি হয়। এর সঙ্গে যদি যোগ হয় প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার সাহেবের দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর, আর সেটা গিয়ে যদি পড়ে কোনো অর্ধশিক্ষিত দোকানির কাছে, তখন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকেই যায়। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার কিন্তু ওই ডাক্তার কিংবা ওষুধ দোকানির হতে হচ্ছে না, জীবন দিয়ে দায় নিতে হচ্ছে নিরপরাধ রোগীকে। রোগী টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখালেন, ডাক্তার হয়ত যথাযথ ওষুধটিও লিখলেন, কিন্তু তার লেখার অস্পষ্টতার কারণে রোগীকে অর্থ ব্যয় করে খেতে হলো ভুল ওষুধ। জীবন হয়ে পড়ল তার বিপন্ন।
ডাক্তারের হাতের লেখা অস্পষ্ট হবে, দুর্বোধ্য হবে’ এটা নাকি সমাজের অলিখিত একটা নিয়মেই পরিণত হয়েছে। ডাক্তার যত বড়, হাতের লেখা নাকি ততবেশি দুর্বোধ্য! একবার বন্ধুস্থানীয় এক ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম’ প্রেসক্রিপশনে আপনারা ওষুধের কি নাম লেখেন, আমি প্রায়ই বুঝতে পারি না। তিনি হেসে জবাব দিলেন, আপনার বোঝার তো দরকার নেই। ওষুধ দোকানের ফার্মাসিস্ট ঠিকই বুঝবেন।
আমার বাসার পাশে একটা ওষুধের দোকান আছে। ওষুধপত্র ওখান থেকে নিয়মিত কিনতে কিনতে ওদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। একদিন বিষয়টা তুললাম। বললাম, এই যে ডাক্তারদের অস্পষ্ট লেখা, আপনারা কি সব বোঝেন? তাহলে আমরা কেন বুঝি না? তিনি বললেন, আমরাও সব বুঝি না, আইডিয়া করে নিই। নামের শুরুর অক্ষরটা দেখি, মাঝের দু-একটা অক্ষর দেখি, ধারণা করে নিই। তাছাড়া ওষুধ বিক্রি করতে করতে আমাদের একটা ধারণা হয়ে গেছে, কোন ওষুধের সঙ্গে কোনটা দিতে পারে, তা থেকে বুঝে নিই। বুঝলাম, এই রকম ধারণার উপরেই আসলে চলছে আমাদের চিকিৎসা। আইডিয়া করেই আমাকে তারা সেরিডলের জায়গায় সেকনিডাল দিয়েছিল। তাদের সেই ধারণার ওপর বিশ্বাস রাখলে সেবার হয়ত আমাদের পুরো পরিবারকেই বড় কোনো ঝামেলায় পড়তে হতো।
বাসার পাশের সেই দোকানির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সব ডাক্তারই কি হাতে লেখে প্রেসক্রিপশন করে? জানালেন তিনি, স্কয়ার হাসপাতাল এবং এরকম দু-একটা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে যে সব ডাক্তার বসেন, তারা নাকি হাতে হাতে লিখে প্রেসক্রিপশন দেন না। তাদের ব্যবস্থাপত্র আসে প্রিন্টেড। ওষুধের নাম, কিভাবে সেটা খেতে হবেÑ এই সবই থাকে কম্পিউটার কম্পোজ করা অবস্থায়। এমনকি অনেক ডাক্তার নাকি ইদানীং তাদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ব্র্যান্ড নামও লেখেন না, লেখেন জেনেরিক নাম। নাপা বা এইস না লিখে ‘প্যারাসিটামল’ লিখেন। শুনে ভালো লাগল। জানতে চাইলাম, এদের সংখ্যা কেমন? মানে প্রতিদিন এরকম কতগুলো প্রেসক্রিপশন পান?
প্রতিদিন? একটু অবাক হয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি। তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, এই ধরেন গত সপ্তাহে এরকম একটা পেয়েছিলাম। এর আগের সপ্তাহে অবশ্য দুটো।
বুঝতে পারলাম, সংখ্যাটা এখনো খুবই নগণ্য। অর্থাৎ মানুষের চিকিৎসা চলছে এখনো সেই অনুমান আর ঝুঁকির ওপর নির্ভর করেই।
আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। আমি বুঝতে পারি না, সমাজের মেধাবী মানুষজনই সাধারণত ডাক্তারি পেশায় যায়। যারা ভালো ছাত্র, তাদের হাতের লেখা কি দুর্বোধ্য হয়? তাহলে তারা পরীক্ষায় বেশি নাম্বার কি করে পায়? স্কুল-কলেজে মেধাবী সহপাঠী হিসেবে যাদেরকে পেয়েছি, যাদের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন পরে ডাক্তার হয়েছেন, তাদের হাতের লেখা মন্দ ছিল বলে কিন্তু মনে করতে পারছি না। আচ্ছা, ডাক্তার হওয়ার পর তাদের হাতের লেখা কি পচা হয়ে গিয়েছিল? না, এটা আর পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
বাসার পাশের দোকানির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন বেশিরভাগ ডাক্তারের হাতের লেখা দুর্বোধ্য হয়। তার কি মত? তিনি যে উত্তরটা দিলেন, সেটা শুনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ডাক্তাররা আসলে ইচ্ছা করেই এভাবে লেখেন। পরিষ্কার করে তারা লিখতে পারেন, কিন্তু লেখেন না। এরপর তিনি তার এই মতামতের পক্ষে কিছু যুক্তিও দিলেন।
সে সব অন্য প্রসঙ্গ, আরও ভয়াবহ, আরও অনৈতিক। বলব না হয় আর একদিন।
মাসুদ কামাল : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক