কুমিল্লায় সীমার বাধা ‘কোন্দল’, সাক্কুর ‘ধানের শীষ’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে দুই আলোচিত প্রার্থী আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমা এবং বিএনপির মনিরুল হক সাক্কুর দুশ্চিন্তা দুটি ভিন্ন বিষয়ে। আওয়ামী লীগে ওই এলাকার সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এবং সীমার বাবা আফজল খানের মধ্যে পুরনো দ্বন্দ্বের অবসান হবে কি না-সেটি এখনও বড় প্রশ্ন। তেমনি এবার সাক্কুর প্রতীক ধানের শীষ হওয়ায় তিনি আর গত নির্বাচনের মতো (তখন সাক্কু ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী) আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সমর্থন পাবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
২০১২ সালের কুমিল্লা সিটির প্রথম নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। সাক্কু তখন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নাগরিক কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আফজল খানকে হারিয়ে দেন। ধারণা করা হয়, আওয়ামী লীগের আফজলবিরোধী অংশ ওই নির্বাচনে সাক্কুর পক্ষে ছিল। তাদের ভোট পাওয়ার কারণেই ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীকে সহজেই হারাতে পেরেছিলেন তিনি।
এবারের নির্বাচনে সাক্কুকে ব্যক্তিগত ও দলীয় জনপ্রিয়তা ভাবমূর্তি, গত পাঁচ বছরে তিনি কী উন্নয়ন করেছেন-তার হিসাব ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
বিএনপি সমর্থিত সকল সিটি মেয়ররা বর্তমান সরকারের আমলে নানা এলাকায় দায়িত্ব পালনে বাধার মুখে পড়লেও কুমিল্লায় সাক্কু দায়িত্ব পালন করেছেন নির্বিঘ্নে কাজ করে গেছেন। সদর আসনের সাংসদ বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে তার সখ্যতার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে বলে নগরজুড়ে এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি বড় ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর কুমিল্লার এই ভোট দলটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা একেবারেই নেই-দলটির নেতারা এমন দাবি করে আসলেও নারায়ণগঞ্জে বিশাল পরাজয় এই দাবিতে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এখন কুমিল্লায় জয় না পেলে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা আশাহত হয়ে পড়তে পারে বলে দলে আশঙ্কা আছে। এ কারণে কুমিল্লার নির্বাচনে জিততে আঁটঘাঁট বেঁধেই নেমেছে দলটি। প্রতিদিনই কুমিল্লা যাচ্ছেন কেন্দীয় নেতারা।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রমাণ দেয়া। গত ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং সদ্য সমাপ্ত ১১ উপজেলার আটটিতে জিতে ফুরফুরে মেজাজে আছে ক্ষমতাসীন দল। ৩০ মার্চের ভোটে আরেকটি জয় আগামী জাতীয় নির্বাচনের টনিক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করছে তারা। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও নিয়ম করে এলাকায় যাচ্ছেন প্রতিদিন। দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জয়ী হলে এলাকায় উন্নয়ন হবে।
জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী দুই প্রার্থীই
আগামী ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটির ভোট নেয়া হবে। চার মেয়র ও ১১৪ সাধারণ কাউন্সিলর এবং ৪০ জন সংরক্ষিত প্রার্থী এখন প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা এর আগে কুমিল্লা পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর হিসেবে একাধিকবার জিতেছেন। এবার মেয়র পদেও তিনি জয়ের আশায় আছেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমি সব জায়গা থেকে ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি। কেউ আমাকে এখন পর্যন্ত নিরাশ করেননি। দলের কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকা প্রতীক বিজয়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাতে আমি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য শতভাগ আশাবাদী।’
তবে বিএনপির প্রার্থী সাক্কু মনে করেন, ২০১২ সালের মতো ভোটাররা আবার তার পক্ষেই রায় দেবে। কেন আপনাকে ভোট দেবে-জানতে চাইলে ধানের শীষের প্রার্থী সাক্কু বলেন, ‘গত পাঁচ বছর কুমিল্লা শহরে যে উন্নয়ন হয়েছে তাতে আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’
সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা সভাপতি আলী আকবর মাসুম ঢাকাটাইমসকে বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও ভোটাররা যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে। নগরের যে বেশি উন্নয়ন করতে পারবে, শিক্ষাদীক্ষায় যিনি বেশি তাকেই সমর্থন দেবে।
নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ সাত হাজার ৩৮৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ দুই হাজার ৩২৯ আর নারী ভোটার এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৫ জন।
আওয়ামী লীগের ভাবনায় কোন্দল
২০১২ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রার্থী আঞ্জুম সলতানা সীমার বাবা আফজাল খানের হারের পেছনে কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে তার দীর্ঘ কোন্দলকে দায়ী করা হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে এ দুইজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনেও এই দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে কি না, সে বিষয়ে আশে নানা শঙ্কা।
বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রও। দুই নেতার মধ্যে কোন্দল মেটাতে নিয়মিত কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে পাঠানো হচ্ছে এলাকায়। বাহাউদ্দিন বাহারকে গণভবনে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে কড়া বার্তা দিয়েছেন বলেও এলাকায় প্রচার আছে। ইতিমধ্যে তার সমর্থকরা সীমার জন্য প্রকাশ্যে ভোট চাইছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সীমার প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক নুর-উর-রহমান মাহমুদ তানিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচন সামনে আসলেই কুমিল্লায় নেতৃত্বপর্যায়ের দ্বন্দ্বের কথা উঠে আসে। তবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। নেতৃত্ব পর্যায়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও তৃণমূলে এর প্রভাব পড়বে না।’ তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মডেলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করতে চায় সরকার। দলীয় প্রধান এবং সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে আমাদের এমন বার্তাই দেওয়া হয়েছে।
‘ধানের শীষ না হলে ভালো হতো সাক্কুর’
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময়ই রাজনীতিতে হাতেখড়ি সাক্কুর। নিজ দল বিএনপির বাইরেও তার একটি গ্রহণযোগ্যতা সব সময় ছিল বলে প্রচার চালান তার সমর্থকরা। আর এই জনপ্রিয়তা ব্যবহার করেই তিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে তিনি সহজ জয় পান বলে প্রচার আছে কুমিল্লায়।
ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। পরে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে ভোট দাঁড়ান সাক্কু। তখন ওই নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে নাগরিক কমিটি নামে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। ফলে বিএনপির বাইরেও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে যারা আফজল খানের বিরোধী, তাদের ভোটও তিনি পেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এবার দলীয় প্রতীক থাকায় এই ভোটগুলো আর সাক্কুর বাক্সে নাও পড়তে পারে।
সাক্কুর নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্বে থাকা একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সত্যি কথা কি, ধানের শীষ প্রতীক না থাকলে ভাইয়ের নির্বাচনে জেতা সহজ হতো। তিনি আগের মতই সব দলের সমর্থকদের ভোট পেতেন। এবার বিএনপি ও জোটের শরিকদের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হবে তাকে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাক্কু অবশ্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, দলীয় প্রতীক তার বোঝা হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে প্রথম নির্বাচনে দলের বাইরে গিয়ে জনগণের স্বার্থে আমি নির্বাচন করেছি। এবার আমি দলীয় প্রতীক পেয়েছি, এটা আমার আমার প্লাস পয়েন্ট।’
সুনির্দিষ্ট ও বড় অভিযোগ নেই প্রার্থীদের
আলোচিত এই নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত বলার মত কোনো অভিযোগ না উঠলেও সাক্কুর কিছু অভিযোগ আছে। তার দাবি, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙছেন। এ কারণে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে।
সাক্কু বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কঠোর অবস্থান না নিলে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুন্দর হবে না। আমরা চাই ভোটাররা প্রত্যেকেই অবাধে, নির্ভয়ে, সুষ্ঠু পরিবেশে স্বতঃস্ফুর্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাক।’
সাক্কুর প্রধান নির্বাচনী সম্বয়ক কাইমুল হক রিংকু বলেন, ‘প্রশাসন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তার এ রকম আচরণ চলতে থাকলে নির্বাচন কমিশনের নতুন ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা বিফলে যা্বে।’ তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ডিবি পরিচয়ে আমাদের কর্মী সমর্থকদের নির্বাচনে প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনসভা করলেও আমাদেরকে উঠান বৈঠকও করতে দিচ্ছে না প্রশাসন। ডিবি পরিচয়ে সেখানে যেতে নেতা-কর্মীদের বাধা দেয়া হচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সন্ধ্যা হয়ে গেছে যার যার মতো বাসায় ফিরে যান।’
অবশ্য ভোট নিয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিক এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে একটিই এবং এরপর ব্যবস্থাও নিয়েছে প্রশাসন। সাক্কুর জামিনে থাকা এক কর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে- এমন অভিযোগের পর কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা মনে করেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে সুষ্ঠ পরিবেশে ভোট হয়েছে। এই ভোটও সুষ্ঠু হবে।’
জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মণ্ডল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন বদ্ধপরিকর। নির্বাচনী পরিবেশ এখনো পর্যন্ত ভালো আছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কর্মকর্তারা ম্যাজিস্ট্রেটসহ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যাচ্ছেন। কোথাও কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘণের ঘটনা ঘটলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা নিচ্ছি। ভোটাররা যাতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ভোট দিতে পারে আমরা সেই বিষয়ে সচেষ্ট আছি। কোনো রকম অনিয়ম বরদাশ্ত করা হবে না।’
(ঢাকাটাইমস/২১মার্চ/এমএবি/ডব্লিউবি)
মন্তব্য করুন