উন্নয়ন শুধু নয়, চাই মনোজগতের বিকাশ
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক গেল না। সরকারের দাবি অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু এর বিশাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে প্রধান দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকসহ আরো অনেকেই। যেসব উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বাকি সব সূচকই গত অর্থবছরের তুলনায় নি¤œগামী। বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সও কমছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে থাকবে। তবে এই ৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও একেবারে কম নয়। তবে বিশ্বব্যাংক দাবি করছে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। ওই বছর প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও সরকার আলোচ্য বছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। চলতি বছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ব্যবধান হচ্ছে দশমিক ৪ শতাংশ। একইভাবে গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিল বিশ্বব্যাংক।
উন্নয়ন আমাদের হচ্ছে এ কথা সত্য এবং তা লক্ষণীয়। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, দেশে বেশ ভালোভাবেই কমছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। জিডিপির ওপর বড় প্রভাব ফেলে সেই রেমিট্যান্স আয়ও নেতিবাচক। এ সবই চলতি অর্থবছরের জন্য চ্যালেঞ্জ। ফলে দাবি করা প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
উন্নয়ন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, গবেষণা চলছে এবং চলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় উন্নয়ন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি হিসেবে মানুষের এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজের উন্নয়ন কতটা নিশ্চিত করছে। সরকার আসে, সরকার যায়। থাকার সময় উন্নয়নের দাবি বারবার উচ্চারিত হতে থাকে। কিন্তু তবুও আমরা দেখি এত কিছুর পরও দেশের শহর, বন্দর, গ্রাম নানাভাবে অনুন্নয়নের শিকার।
মানুষ সমাজে বাস করে। তাই সমাজ নিরপেক্ষভাবে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটতে পারে না। সব দিক থেকে বদ্ধ সমাজকে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসতে গেলে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষকে সামনে রেখে পুরো সামাজিক ব্যবস্থায় আঘাত করতে হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে কোথায় চলছি আমরা? সমাজ কোথায় আছে, কতটা অন্ধকারে নিপতিত তার কিছুটা নমুনা দেখা গেল সর্বোচ্চ আদালতের সামনে স্থাপিত ন্যায় বিচারের প্রতীক জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য নিয়ে। মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের চাপে এটি স্থানান্তরিত হলো অন্য জায়গায়। সামাজিক অন্ধকার এভাবে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে থাকলে বিদু্যুতের আলো দিয়ে কতটা অন্ধকার দূর করা যাবে?উন্নয়ন যদি মানুষের জন্যই হয়, তাহলে মানুষকে অনুন্নয়নের কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপ হলো আলোর পথে যাত্রা। ধর্মান্ধতা, পশ্চাতগামিতা ছেড়ে এগিয়ে চলা। অন্যথায় শুধু প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন সব কিছু মাঝপথে গুলিয়ে দিতে পারে। মানুষের সততা, মানবিকতা বোধ, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এই সব কিছু লোপ করে যে উন্নয়ন হয়, তা দেশকে এগিয়ে নেয় না।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেক কিছু হয়েছে। উন্নয়ন কিছু হয়নি এটা বলা যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন দেশজুড়ে প্রত্যন্ত প্রান্তেও দৃশ্যমান। বহু ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভোগ্যদ্রব্যের বাজার গ্রামের হাটেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দেখছি মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত তাদেরও ব্যয় সক্ষমতা বেড়েছে। এবং সত্যি বলতে কি একটা ভোগ পাগলামি চলছে দেশজুড়ে। রমজান মাসে তা আরো বাড়ে প্রতি বছর। আমাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকা মানুষ অনেক কমে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সেবামূলক উদ্যোগ সরকারের দিক থেকেও লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। স্কুল বেড়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও প্রচুর উন্নতি হয়েছে, এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ এখন দূর মফস্বলে বসেও পাওয়া সম্ভব। রাস্তাঘাট বাড়তে বাড়তে ঘরের দরজায় শহর ঢুকে পড়েছে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীও বেড়েছে।
কিন্তু যে বাড়বাড়ন্ত সমাজকে পেছনে ঠেলছে, তা হলো মৌলবাদ। মৌলবাদী ইসলামের তীব্র হিংসাবহ্নি ছারখার করছে আমাদের জনজীবনকে। এমন এক গোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ধর্মীয় অন্ধতার পিচ্ছিল কালিপথে দেশকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। ধর্মান্ধ অন্ধকার গোষ্ঠীর সঙ্গে সখ্য গড়া এই তথাকথিত লেখাপড়া জানা গোষ্ঠীটি ভয়ংকরভাবে রক্ষণশীল ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে জনজীবন নিষ্পেষণ করছে। কিন্তু এদের প্রতিহত করার কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেই। চিহ্নিত মৌলবাদীদের চেয়ে এরা বেশি জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে সমাজের সর্বত্র।
আরও বাড়ছে দুর্নীতি। লাগামহীন দুর্নীতি। যদি কমে যাওয়ার কথা বলি, তাহলে বলব কমছে মূল্যবোধ। মূল্যবোধ কমছে বলে দুর্র্নীতিবাজদেরই কদর সর্বত্র। এরা সব গিলে খাচ্ছে। শহর, বন্দরের জলা, জমি সব এরা দখলে নিচ্ছে অবৈধভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের জোরে। বৃহৎ শিল্প বাড়েনি, বাড়েনি মাঝারি বা ছোট শিল্পও। স্কুল-কলেজের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কমছে শিক্ষার মান। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রই এখন শিক্ষার্থীদের ভরসা। স্বাস্থ্য অবকাঠামো বেড়েছে, কিন্তু সুস্থ চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
উন্নয়ন মানেই আমরা মনে করছি মানুষের বেশি বেশি আয়। রোজগারই আসলে জীবনকুশলতা নয়। যদি উন্নয়নকে একটু বড় করে দেখতে চাই, তাহলে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি নিয়ে ভাবতে হবে। সেখানে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে। প্রশাসন যদি সৎ হয়, রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থা যদি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হয়ে প্রগতিশীল হয়, তবেই উন্নয়নকে বড় অর্থে দেখার অভ্যাস হবে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি