জাহাঙ্গীরনগরে নতুন বাস্তবতা, সম্ভাবনা ও সমস্যার ব্যবচ্ছেদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো টিম পেয়ে গেল? এর উত্তর ভালো দিতে পারবেন মুরুব্বীরা। কিন্তু আমার পাঁচ-বছর বয়সী জাবি জীবন বলছে, অন্যতম সেরা তো অবশ্যই। গত তিন বছর শান্তিতে পার করার পর, আকস্মিক তৈরি হওয়া চলমান একটা সংকট ক্যাম্পাসে কিছুটা অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করলেও, নতুন করে নিয়োগ হওয়ায় জাহাঙ্গীরনগরে এখন উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক চূড়ায় আছেন দুইজন উপ-উপাচার্য এবং একজন ট্রেজারার। চারজন সম্মিলিতভাবে পূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোয় অধিকতর স্থিতিশীল ও অগ্রসরমান ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। যারা জাহাঙ্গীরনগরে সদ্য শিক্ষক হিসেবে বা শিক্ষার্থী হিসেবে আগমন করেছেন, তারা হয়ত এই নতুন পরিস্থিতির তাৎপর্য পুরনোদের মতো করে চট করে বুঝে উঠতে পারবেন না।
ব্যক্তির প্রশস্তি করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং সম্ভাবনার উর্বর জমিনে নানা সমস্যার সমাধানের বীজ বোনাই এ লেখার উদ্দেশ্য। তিন বছর স্থিতিশীল পথ পাড়ি দেয়ার পরে মহাসড়কে দুজন ছাত্রের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে চলমানসহ নানাবিধ সমস্যার সমাধান তালাশ করাই হবে প্রতিটি মহৎপ্রাণের দায়িত্ব। পানি ঘোলা করে যারা মৎস্য শিকারের ব্যবস্থা করতে চান তাদের বিষয়ে সতর্ক থেকেই এই তালাশ জারি রাখতে হবে। শুধু প্রশাসন নয়, ছাত্র-ছাত্রীসহ নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সকলকেও এখানে সমান চেতন ও দায়িত্ব নিয়ে সক্রিয় থাকতে হবে।
ঢাকায় অনেকে মজা করে বলেন, পাকিস্তান, ভারতের ক্রিকেট কোচ আর জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্যের চেয়ারের কোনো ভরসা নেই। কথা একেবারে ফেলে দেয়া যায়না। গত পাঁচ বছরে তিনজন উপাচার্যের দেখা পেয়েছে জাহাঙ্গীরনগর। যে কারণেই হোক, এমনটা ঘটেছে। সর্বশেষ, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম প্রত্যাশিতভাবেই ক্যাম্পাসে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে লাগাতার বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। রাস্তায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুই ছাত্রের মৃত্যু থেকে সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহ অর্জিত স্থিতিশীলতাকে সাময়িক ব্যহত করেছে। রাস্তার সমস্যা থেকে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাড়িতে আক্রমণ এর ঘটনা ঘটেছে। বাড়ির সিংহদ্বার, ক্যামেরা, জানালা, দরজা, ভাংচুর করা হয়েছে। শিক্ষকদের সাথে নজিরবিহীন বেয়াদবি করা হয়েছে। নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে মামলা দায়ের করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আজ মামলার আসামী। এ নিয়েই এখন ক্যাম্পাসে একটা অস্বস্তি বিরাজমান। আসামীরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র-ছাত্রী, মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আদালত প্রাঙ্গণ, শাহবাগ ও ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করছে।
কিন্তু বাস্তবতা হল, আদালতের কার্যক্রমে এই মানববন্ধন বা মিছিলের কোনো আছর পড়বে বলে মনে হয়না। বরং মামলা সংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে সাবধান না থাকলে নতুন কোনো ভুলে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হওয়া লাগার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। তাই আন্দোলনকারীদেরও সাবধান হতে হবে। আদালতের বিচারাধীন একটা মামলার স্পর্শকাতরতা নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। নতুন করে আর কোনো ভুল করা যাবেনা। এক বা একাধিক ভুল থেকে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হোক, সেটা আমরা কেউই চাইনা। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সর্বগ্রহণযোগ্য কোনো পথ আছে এখনো খোলা আছে কি? নাকি নেই? মুরুব্বীরা একটু ভাববেন? ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে কারো কথায় বা পরামর্শে উত্তেজিত হয়ে কিংবা নিজেরাও বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে আর এমন কিছু করা যাবেনা যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ মানসিক যাতনা আর বিড়ম্বনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কারণ ছাত্রজীবনে মামলা মোকাবেলা করা ভালো কিছু নয়।
যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত অগ্রগতি ছাড়া, যেনতেন ভাবে মামলা প্রত্যাহার করার দাবিতে এখন মানববন্ধন, মিছিল, ফেসবুকে প্রচারণা চালালে প্রকৃত অর্থে কী ফায়দা হবে সেটি সবাইকে এখন ভাবতে হবে। মাঠ গরম করা যাবে নানা কিছু করে; কিন্তু সবার জন্য মঙ্গলময় আদৌ কিছু করা যাবে কি না, সেটি শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই একটু ভেবে দেখবেন। আদালতের বিষয় আদালতের প্রক্রিয়া মেনেই করতে হবে। মামলার বাদী কে, এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাহাঙ্গীরনগর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরেই পরিচালিত একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের নজর সবখানে আছে, কে কী করে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে করে রাষ্ট্র সব খবর রাখে। যৌক্তিক এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে এখন এগুতে হবে। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ভিসি অফিসের সামনে মানববন্ধন করে মিডিয়ার নিউজ হওয়া যাবে, কিন্তু কাজের কাজ হবে বলে আমার মনে হয়না। রাষ্ট্রব্যবস্থার শক্তিমত্তা কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের থেকে অনেক বেশী, এটা অনুধাবন করতে হবে। তাছাড়া মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন এবং মিছিলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুব একটা আছে বলে মনে হলনা।
দীর্ঘ ৪৪ দিন পর ক্লাস, পরীক্ষা শুরু হয়েছে। নতুন করে ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা সৃষ্টি হোক, সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাইছেনা বলে প্রতীয়মান। ফলে জেদের বশে বাস্তবতাকে কেউ অস্বীকার করবেনা, এই আশা রইল। এই যখন পরিস্থিতি, তখন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মো. আমির হোসেন দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে থাকা উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) পদে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় বাস্তবতায় অধ্যাপক মো. আমির হোসেন এর একটা সম্মানিত পদে আসীন হওয়া যে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বহন করে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ছায়াতলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বিশাল অংশকে দীর্ঘদিন ধরে একতাবদ্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে অধ্যাপক আমির হোসেনের অবদান কৃতজ্ঞরা আজীবন স্মরণ রাখবে বলে মনে করি। ট্রেজারার পদে অনেককে চমকে দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মনজুরুল হক। পেশায় একজন ভূগোল এবং পরিবেশবিজ্ঞানী হলেও অধ্যাপক মনজুরুল হক এর সুনাম আছে সাহিত্য, শিল্পকলা, চিত্র ও নাট্যকলার একজন সমঝদার ব্যক্তিত্ব হিসেবে। নতুন উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার সফলভাবে দায়িত্বপালনরত উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম এবং আরেকজন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আবুল হোসেন, সবাই মিলে ক্যাম্পাসের অসীম সম্ভাবনার জমিনে দাঁড়িয়ে নানা সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার চাইতে ছাত্র-ছাত্রীদের নানা সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে কথা বলা বেশী প্রয়োজন বলে মনে করি। বর্তমান প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ক্যাম্পাসে নবীন শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। পরিবহন ব্যবস্থা জাহাঙ্গীরনগরের ইতিহাসের সবেচেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন বলে মুরুব্বী সহকর্মীদের মুখে প্রায়শ শুনছি। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আরও ভালো পরিবহন সুবিধার এন্তেজাম করতে পারলে শিক্ষক হিসেবে আমাদের ভালো লাগবে। অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারলে, সব কিছুই সম্ভব। প্রশাসনের এক শীর্ষব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বহুল আকাঙ্ক্ষিত গ্রন্থাগার বর্ধিতকরণের প্রকল্পটি নাকি পরিকল্পনা বিভাগে জমা আছে, শীঘ্রই একনেকে উঠবে। রিপোর্টাররা খোঁজ নিয়ে রিপোর্ট করতে পারে। গ্রন্থাগারে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছে প্রশাসন। এর সাথে যদি জায়গা বাড়ানো যায়, তাহলে সেটি হবে সাম্প্রতিককালে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল নির্মাণে অনেক সময় নেয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো দেয়া হয়নি। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। তবে একমাসের মধ্যে ছাত্র উঠানো সম্ভব হবে বলে জানা গেল। তবে ক্যাম্পাসে নতুন নতুন হল পেয়ে মেয়েরা বেশ সুখে আছে বলে বোঝা যায়।
কামালউদ্দিন হলের সামনের রাস্তা দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে অনেক কথা বলে আসছে। কিন্তু এস্টেট অফিস থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে এক/দুদিনের ভেতরে রাস্তা মেরামত হয়ে যাওয়ার কথা। নবনিযুক্ত প্রভোস্ট মহোদয় এ বিষয়ে খুব সিরিয়াস। সবাই ক্যাম্পাসে নানা কাজের জন্য বেতন নেয়, সবার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। অথচ সবকিছুর জন্য ক্যাম্পাসের উপাচার্যদের দোষারোপ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এক দুজন শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তার স্বার্থান্বেষী তৎপরতার জন্য পুরো সম্প্রদায়কে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করার প্রবণতা থেকেও সকলকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সকালের বাস মিস করে শুভযাত্রায় ক্যাম্পাসে আসার পথে সকালে দেখলাম, নবনির্মিত স্পিডব্রেকারের পাশে এমএইচ হলের গেইটে সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে, ‘ক্যামেরা দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিয়ন্ত্রিত’। ক্যামেরার কাজ মনিটর করা এবং স্মৃতি ধরে রাখা। নিয়ন্ত্রণ করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুন্দর সবুজ সাইনবোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো আছে, কিন্তু ক্যামেরার কোনো ছবি নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্রতিটি গেইটে ক্যামেরা লাগানোর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ফেসবুকে একজন বলল, প্রান্তিক গেইটে নাকি একটা ক্যামেরা রাস্তার দিকে তাক করে ইতোমধ্যেই কাজ করছে। তবে গেইট থেকে একটু দূরের বা রাস্তার আরেক পাশের ফুটেজ এই ক্যামেরায় কতখানি স্পষ্টতা নিয়ে ঠাই পাবে, সেটি প্রশাসন নিশ্চয় পরীক্ষা করে দেখেছেন বলে মনে করি। গত তিন বছরে নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের কারো কারো সাথে ‘র্যাগ’ প্রদানের প্রবণতা ক্যাম্পাসে পাল্লা দিয়ে কমেছে, এ কথা চরম নিন্দুকেরাও স্বীকার করবেন। কিন্তু এক/দুটি হলের অভ্যন্তরে নতুন ছাত্ররা খুব অমানবিক অবস্থায় থাকে। এর বর্ণনা এখানে দিব না, আরেকদিন দিব। হলের অভ্যন্তরে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য হল প্রভোস্টের নেতৃত্বে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাহিনী রয়েছে। কোনো কোনো প্রভোস্ট ২০০ ভাগ আন্তরিক, কেউ কেউ হয়ত ৫০ ভাগও আন্তরিক না। একেক হলে একেক পরিস্থিতি। সবাই সমান আন্তরিক হলে জাহাঙ্গীরনগর হয়ে উঠত পৃথিবীর বেহেস্ত।
কোনো কোনো বিভাগে শিক্ষক সংকট থাকায়, রানা প্লাজার দুর্ঘটনা, আগের উপাচার্যের আমলে মাসের পর মাসের ক্যাম্পাস অচল থাকায় জাহাঙ্গীরনগরে সেশন জটের সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসন সাধ্যমত চেষ্টা করার পরও বাস্তব সত্য হল, প্রায় প্রতিটি বিভাগেই কম-বেশী সেশনজট আছে। প্রশাসন, বিভাগ, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই যদি কঠোর পরিশ্রম করে তাহলে সেশনজট দূর করা সম্ভব হবে। ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রশাসনিক টিম পেয়ে উপাচার্যের নেতৃত্বে নিশ্চয় জাহাঙ্গীরনগর আসছে দিনগুলোতে দারুণ সব অগ্রগতি অর্জন করবে, এই আশা এখন সকল মহৎপ্রাণের মনে।
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক