চাইব একটি শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন

সৈয়দ আবুল মকসুদ
| আপডেট : ৩১ জুলাই ২০১৭, ১৭:১২ | প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০১৭, ১৩:০৮

আপনার ২৩ জুলাই তারিখের আমন্ত্রণপত্র পেয়ে অত্যন্ত সন্মানিতবোধ করছি। ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ সালের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে দৃঢ়তার সঙ্গে এবং সুচিন্তিত পন্থায় এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে সুশীল সমাজের অনেকের মতামত গ্রহণে আপনাদের সদিচ্ছা প্রশংসার যোগ্য।

পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের ৬০ জন খ্যাতিমান ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েন তাদের মতামত জানানোর জন্য প্রত্যেকে পাঁচ মিনিট করে তার বক্তব্য রাখলে পাঁচ ঘণ্টার প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন দিকেরও বক্তব্য থাকবে। সবমিলে ঘণ্টা ছয়েক প্রয়োজন। সময়ের কথা বিবেচনা করে অনেকের বক্তব্য দেয়া সম্ভব হবে না। তার ফলে ভালো উদ্যোগটি অর্থবহ হবে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের দেশে এ জাতীয় বৈঠকে গঠনমূলক আলোচনা এবং পরামর্শ খুব কমই হয়। অনেকেই তার নিজের ক্ষেত্রে যোগ্য কিন্তু বাস্তবসম্মত যুক্তিশীল পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। তাতে অপ্রয়োজনীয় কথায় সময় নষ্ট হয়।

সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়গুলো দূর করাই কমিশনের প্রধান করণীয়। সেই অন্তরায় অতিক্রম করে নিজেদের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের উপরই নির্ভর করে বর্তমান কমিশনের সার্থকতা ও সুনাম।

একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই একটি দক্ষ সরকার এবং সুশাসনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তবু সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। খারাপ ও কারচুপির নির্বাচনে গঠিত একটি ভালো সরকারও গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি খারাপ সরকারও গঠিত হয় তা মেনে নেয়া সবার সাংবিধানিক কর্তব্য। এবং তা মেনে নিয়েই সে সরকারকে সরাতে গণতন্ত্রকামী মানুষের জনমত গঠন করা দায়িত্ব। অসংবিধানিক উপায়ে তাকে হটানো নয়।

আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানেন কীভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়। সুতরাং তাদের আর নতুন করে পরামর্শ দেয়া বা জ্ঞান দান করা অর্থহীন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে কী কী সমস্যা হতে পার বলে আপনারা মনে করেন তা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার। তখন সেসব সমস্যা দূর করতে কী করণীয় সে ব্যাপারে পেশাজীবী ও নাগরিকদের পরামর্শ প্রয়োজন।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত সরকারের সঙ্গে আগে সমঝোতায় আসা। বাধাগুলো যেন সরকারের দিক থেকে, সরকারি দলের দিক থেকে না আসে। সেটা সিভিল সোসাইটি নিশ্চিত করতে পারবে না। বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির সে শক্তি নাই। তাছাড়া সিভিল সোসাইটি বিভক্ত। তারা সরকার সমর্থক বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং বিরোধীদল সমর্থক বা বিএনপিপন্থী। দলীয় মতামতের বাইরে তারা যে স্বাধীনভাবে কিছু বলবেন সে শক্তি তাদের নেই। অথবা এমন কোনো সিদ্ধান্ত কোনো পক্ষের নেতারা মেনে নেবেন না যা তাদের দলের স্বার্থের পরিপন্থী। সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি হলো তাই যা যে কোনো উপায়ে পছন্দের দলকে বিজয়ী করা এবং অপছন্দের দলের বিজয়কে মেনে না নেয়া। অর্থাৎ জনসমর্থিত অপছন্দের দলকে ক্ষমতায় আসতে না দেয়া।

যে সাংবিধানিক অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা অতীতে অন্যান্য নির্বাচন থেকে আলাদা। বর্তমান সরকারের নিজেদের সংশোধিত সংবিধান অনুসারে দশম সংসদ বলবৎ থাকবে, সংসদ সদস্যরা বহাল তবিয়তে থাকবেন। একজন এমপির সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অস্বাভাবিক ব্যাপার। একজন সাধারণ ভোটার হিসেবে সেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তা একেবারেই অসম্ভব। এমপি মহোদয়গন ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা হবেন এবং তারা ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিরপেক্ষ সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন, তা ভাবতে আমার মন সাড়া দেয় না। তাই নাগরিক সমাজের আগে প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত ছিল। তাদের সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। নেতাসর্বস্ব জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে সময়ের অপচয় না করাই বাঞ্ছনীয়।

১৯৭০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশনের নাগরিক সমাজের কারো পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। ওই সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলোর সেই আত্মবিশ্বাস ছিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সক্ষমতা ছিল এবং তার উপর মানুষের আস্থাও ছিল। বর্তমান নির্বাচন সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় সংকট আস্থার অভাব। নির্বাচন কমিশন সেই আস্থা কীভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারে তার জন্য আপনাদের এখনই কাজ শুরু করা দরকার বলে মনে করি। ধারণা করি, সেজন্য এ বৈঠকের আয়োজন।

ষোল আনা স্বদিচ্ছা থাকা শর্তেও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। প্রশাসন ও পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া স্বাধীন নির্বাচন কমিশন একা সব কাজ করতে পারবে না। সেজন্য নাগরিক সমাজকে নিয়ে বসার আগে সংশ্লিষ্ট সেসব সংস্থার সঙ্গে বোঝাপড়া করা আবশ্যক ছিল।

নির্বাচন কমিশনের চেয়ে নির্বাচনকালীন সরকার কম শক্তিশালী তা দেখতে চায় না জনগণ। নির্বাচনের সময় কী রকম সরকার বা প্রশাসন দেশে থাকে সেটার উপরও কমিশনের স্বাধীন দায়িত্ব পালন অনেকটা নির্ভর করছে। আমরা এখনও জানি না ওই সময়ের সরকারটি কেমন হবে। যারা সরকারে থাকবেন তারাই যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া অসম্ভব।

নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। কমিশন ইচ্ছা করলে জেলা প্রশাসনের বাইরে কোনো কর্মকর্তাকেও রিটার্নিং অফিসার নিযুক্ত করতে পারেন।

সুষ্ঠু নির্বাচনে পর্যবেক্ষদের কোনো ভূমিকা নেই। তবে নির্বাচনটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হলো কি-না তা দেখার জন্য পর্যবেক্ষদের অভিমতের মূল্য রয়েছে। দেশে ও বিদেশে এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি তা লক্ষ্য করেছি। নির্বাচনের সময় দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগের কী নীতিমালা গ্রহণ করা হবে তা এখনই পরিষ্কার করা প্রয়োজন। নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করা আবশ্যক। সরকার এবং সরকারি দলপন্থী পর্যবেক্ষক এবং বিরোধীদলপন্থী পর্যবেক্ষক থেকে সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই পর্যবেক্ষদের দলীয় আনুগত্য যাই হোক তাদের অর্থের উৎস দেশবাসীকে জানতে হবে। সেদিকে নির্বাচন কমিশনকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে তাদের পরামর্শ নেয়া একান্ত জরুরি। দায়িত্ব পালনের সময় তাদের বিপদ সম্পর্কে শুধু তারাই সচেতন। ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনী শুধু নয়, সব বড় দলের ক্যাডারাও বিপজ্জনক। ক্যাডারদের দমনের পূর্ণ ক্ষমতা যদি নির্বাচন কমিশনের না থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। নির্বাচন অবাধ অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ করতে কমিশন কতটা শক্ত হতে পারে তা দেখতে চায় জনগণ। সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগে কতটা স্বাধীন ও সক্ষম তা কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, সভা ও বৈঠক করে নয়।

সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা চাইব একটি শক্তিশালী অর্থাৎ শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন। সে নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের পেশীশক্তিধরদের অন্যায্য আবদার ও অবৈধ কার্যকলাপের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে।

বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যদি শুধু তাদের উপর অর্পিত লিখিত দায়িত্ব পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে জাতি যে গভীর সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে তা থেকে মুক্তি পাবে না। বরং আরও ঘনীভূত হবে সংকট। কমিশনের Proactive হওয়া সময়ের দাবি।

আমার ধারণা এভাবে বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে নিয়ে বৈঠক হবে একটি ঘটনা বটে, কাজের কাজ কিছু হবে, সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আট-দশ জন করে ডেকে মতামত নিলে এবং তা তাদের থেকে লিখিতভাবে নিলে আপনাদের পক্ষে সেসব Collade বা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসা সহজ হতো।

দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আপনারা যখন ডাকবেন তখনই আমার মত স্বাধীন নাগরিককে পাবেন। লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এখানে যদি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয় তাহলে একে আর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলা যাবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :