আমরা যারা ফটো জার্নালিজমকে জীবন দিয়ে ভালোবেসেছিলাম (পর্ব-২)

পাভেল রহমান
 | প্রকাশিত : ০৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:০৯
ছবি: আবু তাহের

ওকে আমরা জামিল নামেই ডাকতাম। আমি যখন ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে কাজ শুরু করলাম জামিল তখন স্পোর্টস সেকশনে। জুনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার। জামিল আকস্মিক স্পোর্টস সেকশন ছেড়ে দিল এবং ফটো সেকশনে জয়েন করলো।

জামিলের সাথে আমার পরিচয় তখনই। সেই সময় জামিলের গোপীবাগের বাসায় এক সকালে তানপুরা সমেত ভোরে রেওয়াজ করতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। গানের মানুষ হতেই পারেন কিন্তু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মানুষ ফটোজার্নালিজমে আসবেন তাতে বিস্মিত হয়েছি। বিশেষ করে হার্ড নিউজ নিয়ে যারা কাজ করেন। অবশ্য আমাদের পত্রিকাগুলিতে নিউজে কাজ করতে গিয়ে শুধু মারপিট গণ্ডগোলই কাভার করবেন তা তো নয়। সব সেকশনেই কাজ করতে হত। সাধারনত প্রেস ফটোগ্রাফিতে যারা পারদর্শী তাঁরা বেশি চটপট স্বভাবের হয়ে থাকেন। আমরা যারা ‘মুহূর্ত’ নিয়ে কাজ করি তাঁরা সেই মুহূর্তের জন্য সদা প্রস্তুত থাকেন কিনা সেটাও খুব জরুরি। ঘটনার সাথে নিজেকে সিঙ্ক্রনাইজ করে এগিয়ে যাওয়া একজন হার্ড নিউজ ফটোগ্রাফারের জন্য অতি অবশ্যক। তা না হলে অন্যের কাছে ‘হারতে’ হবে। জামিলের শখ ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। রাগ রাগিণীর প্রতি ভালোবাসা। গোপীবাগের পর ঢাকার যতগুলি বাসায় আমি ওকে দেখেছি প্রায় সব খানে ওর ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ আমাকে অবাক করতো। আর সে আগ্রহের কারনে জামিলের একমাত্র সন্তানের নাম , ‘বেহাগ’!

বেহাগ বেশিদিন পায়নি ওর বাবাকে। সেই দিক দিয়ে আমি বেহাগের চেয়ে ভাগ্যবান। কারণ আমি জামিলকে অনেক দিন পেয়েছি। আর সেকারণে জামিল আমার প্রফেশনাল বন্ধুদের অন্যতম।

মিলের অনেক গুণ ছিল। যা আমাদের অনেকের নেই। অন্তত আমার নেই। যা নিজের নেই তাইতো নেবো বন্ধুর কাছ থেকে। বন্ধু তো হবে তেমনি। একটা সময় ছিল রাত যত গভীর হোক না কেন কালকের কাজের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করে নিতাম। আমার ঘাটতিগুলো জেনে নিতাম বন্ধু জামিলের কাজ থেকে। আর কারণে অকারণে দিনে যে কত শতবার কথা হতো তা বলা মুশকিল। ওর সাথে ফটোজার্নালিজম করতে গিয়ে নিজের ভিতর এক ধরনের কনফিডেন্স তৈরি হতো। সেটা কোনো কিছু তুচ্ছ বিষয় নিয়েও। আমাদের মধ্যে ছিল দারুণ সমঝোতা। পারস্পরিক সম্মান বোধ থাকায় আমরা মূল্যায়ন করতে পারতাম নিজেদেরকে। ও যেমন আমাকে বুঝতো আমিও ঠিক তেমনি। জামিল বুঝত আমার কাজকেও।

জামিলের যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করতো সবচেয়ে বেশি তা ছিল ওর ব্যক্তিত্ব। সত্যি বলতে কি আমাদের দেশে হাতে গোনা যে কজন পারসোনালিটি সম্পন্ন ফটোজার্নালিস্ট ছিলেন জামিল তাঁদের একজন।

জামিলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা

আমরা একবার বন্যা কাভারেজে ঢাকার মিরপুর ব্রিজ থেকে নৌকা নিয়ে এগুলাম সাভারের দিকে। ভাকুরতা নামের একটি গ্রামের দিকে যখন আমরা তখন আমাদের নৌকা পড়লো দুর্ঘটনায়। আমাদের নৌকার দিকে তেড়ে আসে মৌমাছির ঝাঁক। আমাদের কারো কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা এমন পরিস্থিতির। ‘তারপর’ কি ঘটতে পারে। আমার আর জামিলের মুখে শরীরে যখন হলুদ ওই মৌমাছিগুলো হুল ফোটাতে শুরু করলো তখন আমরা জীবনের নিকৃষ্টতম একটা সময় পার করছিলাম। আমি একটা সাদা কাপড়ে মুখ ঢাকলেও জামিলের মুখ ছিলো সম্পূর্ণ খোলা। আমি মুখ ঢেকে রাখলেও দেখলাম জামিলের মুখ ভর্তি হুল ফুটেছে। আলোর বিপরীতে ওর মুখটায় হুলগুলো স্পষ্ট এক দুই তিন করে গোনা যাচ্ছিল। জামিল মৌমাছি তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলো এবং বেশ কটাকে সে মেরেও ফেলেছিল। আমাকে যে মৌমাছি ছেড়ে দিয়েছিল তা নয় কিন্তু ওর তুলনায় আমাকে কিছুটা হলেও খাতির করেছিলো। আমি এই আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছিলাম। জামিল তা করেনি। এমনকি জামিলের কানের ভিতর একটা জ্যান্ত মৌমাছি ঢুকে অনবরত হুল ফোটালেও। যখন মৌমাছির কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি ‘রংপুরিয়া বাহে’ সাঁতার না জেনেও পানিতে ঝাঁপ দিলাম তখন বরিশালের পাকা সাঁতার জানা জামিল নিজেকে নৌকাতেই রেখেছে। কারণ আমাকে হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে বলেই। পানিতে ডুবে যখন মৃত্যু আমার দোরগোঁড়ায়, যখন শেষ নিঃশ্বাসটাই আমার সম্বল তখনই আমি আল্লাহর রহমতে জামিলকে হাতের কাছে পেলাম এবং আমি বেঁচে গেলাম।

বন্ধু ভালো থাকুন , আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসীব করুন – আমীন।

নৌকায় মৌমাছির আক্রমণে আমরা। বামে জামিল ডানে আমি।

লেখক: ফটোজার্নালিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :