খালেদা জিয়া

বিকল্প বলয় ঠেকাতে ব্যর্থ নাকি অনিচ্ছুক

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৮:৫৫

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত একটি অপরিহার্য নাম। তিনি এখন কারাগারে। অর্থ আত্মসাতের মামলায় জেলে গেছেন। জেলে যাওয়ার পর একের পর এক তার বিরুদ্ধে আগে থেকে বিদ্যমান মামলাগুলো সজীব হতে থাকল। একটায় জামিন পান তো, আরেকটায় গ্রেফতার দেখানো হয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, খুব শিগগিরই যে তিনি মুক্তি পাবেনÑ এমনটি বোধকরি তার দলের লোকেরাও এখন আর বিশ্বাস করেন না।

সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে আগামী বছরগুলোতে কারা থাকবে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন কি না, বলা যাচ্ছে না। তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, সেটাও নিশ্চিত নয়। বিএনপি অবশ্য বলছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না, আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে জেল থেকে বের করে আনবে। কিন্তু এসব প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের কোনো নমুনা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার মধ্যে দৃশ্যমান বলেও মনে হয় না।

স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, সেই আশির দশকের শুরু থেকেই খালেদা জিয়া সক্রিয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এর আগে হয়তো কখনো ভাবেননি যে রাজনীতিতে আসতে হবে তাকে। এই যে চার দশক ধরে রাজনীতি করছেন, এ সময়ে অনেক চড়াই-উতরাই ছিল, উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এ কথা সহজেই বলা যায়, বর্তমানের মতো এতটা বেকায়দায় তিনি আগে কখনোই পড়েননি। এমনকি ১৯৮১ সালে যখন তার স্বামী নিহত হলেন, তখনো নয়। স্বামী নিহত হলেও নতুন সরকার তার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেয়নি। সামরিক শাসক এরশাদের আমলে সাবেক প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে বহাল তবিয়তেই ছিলেন তিনি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে তাদের আগের বাসভবনেই। এমনকি পরে যখন তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খুবই সক্রিয়, তখনো তাকে এ বাসভবন থেকে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেনি সেই সময়ের সামরিক সরকার। কিন্তু এই সরকারের আমলে এসে তাকে সেই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। আইনগত অধিকার না থাকা সত্ত্বেও তিনি অবশ্য ওই বাড়ি ছাড়তে চাননি, তখন তাকে অনেকটা জোর করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।

রাজনীতিতে এ দেশে আগে একটা প্রবণতা দেখা যেত, সরকার পরিবর্তন হলেও পূর্ববর্তী সরকারপ্রধান বা শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তেমন বড় ধরনের কিংবা অপমানজনক কোনো পদক্ষেপ সাধারণত নেওয়া হতো না। প্রথম এর ব্যত্যয় দেখা গেল এরশাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এরশাদের বিষয়টা মানুষ ততটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। কারণ আর কিছু নয়, তিনি ছিলেন সামরিক স্বৈরাচারী শাসক। একাধিক নির্বাচনে তিনি জয়ী হলেও কেউ তাকে গণতান্ত্রিক শাসক হিসেবে বিবেচনা করেনি। তার চেয়ে অনেক বেশি অগণতান্ত্রিক কর্মকা- পরের সরকারগুলোকে নিতে দেখা গেছে, তারপরও ‘স্বৈরাচারী’ বলতে এ দেশের মানুষ এখনো এরশাদকেই বোঝে। তাই এরশাদের সাজাকে ব্যতিক্রম ধরলে, এর বাইরে আর কখনোই এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে না। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কিন্তু জেলে পড়ে থাকার ঘটনা তেমন একটা দেখা যায়নি। একই কথা বলা যায় ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও। কিন্তু এ ধারাটি যেন আমূল পাল্টে গেল ২০০৮-এর পর। আওয়ামী লীগের আচরণে কেমন যেন একটা অসহিঞ্চুতা দেখা গেল। ২০১৪-এর পর সেটা বাড়ল আরও।

কেন এ অসহিঞ্চুতা? আমার বিবেচনায় এর কারণ আর কিছুই নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। বলা যায়, এই একটি ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে গেছে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মনোভাব। সেখানে অসহিঞ্চুতা ভর করেছে, আচরণে দেখা দিয়েছে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়ার মানসিকতা। এটা আর খুব শিগগরই পাল্টাবে বলে মনে হয় না। আমার মতে, খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বড় ভুল হচ্ছে এই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, খালেদা জিয়া কি এটি করিয়েছেন? না, তিনি হয়তো সরাসরি এ হামলা করাননি, কিন্তু হামলার পর তার ভূমিকাও তো প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি তখন সরকারপ্রধান। গ্রেনেড হামলা হলো বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভায়, নেত্রীকে লক্ষ্য করে ছোড়া হলো একের পর এক গ্রেনেড। নিহত হলেন ২২ জন, আহত হলেন শেখ হাসিনাসহ শত শত নেতাকর্মী। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটেছে কি না, সন্দেহ। অথচ এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর কী ছিল সরকারপ্রধান খালেদা জিয়ার ভূমিকা? একবার বলা হলো, তিনি শেখ হাসিনার বাসভবনে যাবেন, তাকে সমবেদনা জানাবেন। বাসভবনে গেলে বা সমবেদনা জানালেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, তা হয়তো নয়। কিন্তু সৌজন্যতাটুকু তো প্রকাশ পেত। তিনি তাও করেননি। এরপর এই হামলার মামলা নিয়েও শুরু হলো নানা নাটক। দিন যতই যেতে থাকল, পরিষ্কার হতে থাকল হাওয়া ভবনের রহস্যময় ভূমিকা। হাওয়া ভবন তখন তারেক জিয়ার অফিস। ওখানে বসেই, সরকারের কেউ না হওয়া সত্ত্বেও, তারেক জিয়া পরিচালনা করতেন সমান্তরাল সরকার। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর, সরকারের যতটুকু যা বদনাম হয়েছে, তার সিংহভাগই হয়েছে এই হাওয়া ভবনের কারণে। বেগম জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি এটাও একটা বড় ব্যর্থতাÑ পুত্র তারেক রহমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।

অনেকে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে তুলনা করতে যেয়ে তাদের সন্তানদের তুলনায় আনেন। আলোচনায় চলে আসে তখন সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমানের নাম। সন্তানদের তারা কিভাবে মানুষ করতে পেরেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হয়। সাধারণ মানুষের এমন আলোচনা অনেক সময়ই থাকে নিছক অনুমাননির্ভর, তারপরও একে একদম উপেক্ষা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকেন বেগম জিয়া। বলা হয়ে থাকে, পুত্রকে তিনি কিছুটা দ্রুতই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। এতে বরং বিষয়টা বুমেরাং হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সাবেক প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কিছু কথাকে স্মরণ করা যেতে পারে। সেটা সম্ভবত ২০০৯ সালের কথা। দেশ টিভিতে সাকা চৌধুরীর একটা সাক্ষাৎকারের মতো প্রচার হয়েছিল। তিনি সেখানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াÑ এই দুইজনের মধ্যে একটা তুলনা করেছিলেন। বলাবাহুল, তুলনাটি করেছিলেন তিনি তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। তিনি বলেছিলেন, “এই দুই মহিলার মধ্যে একটা বিষয়ে মিল রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রচ- দুর্বলতা তার বাবা স্মৃতির প্রতি। আমার নেত্রীর (খালেদা জিয়ার) প্রচ- দুর্বলতা তার দুই ছেলের প্রতি। দুজনেই যেভাবে মাতৃ-পিতৃস্নেহে আবদ্ধ, আমাদের রাজনীতি বোধহয় ওই স্নেহ থেকে এত সহজে মুক্তি পাচ্ছে না।” সাকা চৌধুরী এখন আর জীবিত নেই। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার ফাঁসি হয়েছে। তিনি যখন এই মন্তব্য করেন, তখন তারেক জিয়া লন্ডনে। পার্টির মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা হয়তো সাকা চৌধুরীর চেয়েও আরেক ধাপ অগ্রসর হতে চাইবেন। বলবেনÑ পুত্রস্নেহ এক জিনিস, পুত্রনির্ভরতা অন্য বিষয়। অন্ধ পুত্রস্নেহের সঙ্গে যদি প্রশ্নহীন নির্ভরতা যোগ হয়, তাহলে যে ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সেটাই যেন দেখা যাচ্ছে এখন। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটা ঠিক পুত্রের ওপর নির্ভরতাও নয়, বরং বলা যায়, উনি পুত্রকে থামাতে পারেননি। হাওয়া ভবন কি খালেদা জিয়া করেছিলেন? না, মনে হয়। কিন্তু ওটাকে ঘিরে যখন নানা স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ছিল, তিনি ওটাকে বন্ধ করতে পারেননি। অথবা তারেক যখন নমিনেশন কি মন্ত্রী নিয়োগের সময় নিজের লোকদের ঢুকাচ্ছিলেন, তিনি সেটাকেও থামাতে পারেননি। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, বিশেষ করে ২০০১ সালে যখন ক্ষমতায় এলো, তারেক জিয়া রীতিমতো একটা সমান্তরাল প্রশাসন চালু করেছিল। সেটা খালেদা জিয়া জানতেন, কিন্তু প্রতিহত করতে পারেননি। ফলে এক ধরনের দ্বৈত শাসন চলেছে। অনেক সময় খোদ প্রধানমন্ত্রীরও নিয়ন্ত্রণ থাকত না হাওয়া ভবনের ওপর। সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে, এমন দুর্বলতা প্রত্যাশিত নয়। এ থেকে ক্ষতি ছাড়া লাভের কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

ক্ষতি যে হয়, তার বড় প্রমাণ তো ২০০৮-এর নির্বাচন। তাতে বিএনপির যে ভরাডুবি হয়েছিল, তার পেছনে প্রধান কারণ কিন্তু ছিল এই হাওয়া ভবন। কিন্তু বিষয়টা কি খালেদা জিয়া উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন? পরাজয় নিয়ে কি দলের কোনো ফোরামে আলোচনা হয়েছে? খোঁজা হয়েছে কারণগুলো? নাকি কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর দায় চাপিয়েই নিজেদের সব দুর্বলতাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে? হয়তো তাই হবে। নয়তো দলের এত বড় পরাজয়ের পেছনে যে তারেক জিয়ার ঔদ্ধত্যকে চিহ্নিত করেছিল রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা, সেই তারেকই কেন বছর না ঘুরতেই রীতিমতো প্রমোশন দেয়া হবে। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে বিএনপির যে কাউন্সিল হয়, অনেকেই ভেবেছিলেন এখানে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, যাতে জনগণ বুঝতে পারে দলটির আত্মোপলব্ধি হয়েছে। কেউ কেউ এমনও ভেবেছিল, তারেক রহমানকে নিয়ে যে পরিমাণ কুৎসা রটেছে, তাকে বরং কিছুদিন আড়ালে রাখাটাই নিরাপদ হবে। তাছাড়া তিনি তো তখন বিদেশেই ছিলেন, তাকে কোনো পদ না দিলে দলের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাস্তবে সে পথে গেল না বিএনপি। বরং সমালোচনার বিপরীতে তারেককে দেয়া হলো প্রমোশন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থেকে তিনি হলেন পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। অর্থাৎ দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি। এহেন সিদ্ধান্তের পেছনে যে দলের চেয়ারপারসনের পুত্রস্নেহ বা পুত্রের প্রতি অতি নির্ভরতাই কাজ করেছে, তেমনটাই ধারণা করা হয়।

এটাই হয়তো বেগম জিয়ার রাজনীতি। দেশ, জাতি কিংবা দলের চেয়েও তিনি নিজের পুত্রের ভবিষ্যৎটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকবেন। মা হিসেবে এটি তিনি চাইতেই পারেন, কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তার কাছে সাধারণ মানুষের চাহিদা নিশ্চয়ই আরও বেশি কিছু থাকবে।

খালেদা জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। সেসব যে তার সমালোচকদের মধ্যেই বেশি আনন্দিত করে, তা বলাই বাহুল্য। স্কুল-কলেজের কোনো ক্লাস পর্যন্ত কে কতটা ভালোভাবে পড়তে পারলÑ আমার কাছে কিন্তু সেটা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন রাজনীতিবিদের জন্য সেসব অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। হলে দেশের সেরা ছাত্রটিই সে দেশের সেরা রাজনীতিবিদ হতেন। বাস্তবে তা হয় না। রাজনীতিবিদ তিনিই ভালো, যার মধ্যে পরিমিতিবোধ আছে। যিনি তার প্রতিটি কাজ বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভালোমন্দকে জড়িয়ে নিতে পারেন। একটা উদাহরণ দিই, গ্রেফতার হবেন জেনে যেদিন তিনি আদালতের দিকে যাচ্ছিলেন, পুলিশের সব নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমর্থক হয়েছিলেন তার সহযাত্রী। এই দৃশ্য যেকোনো নেতারই মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু খালেদা জিয়া মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন। কোনো হঠকারী আচরণ করেননি। এমনকি যখন তাকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো, তখনো তিনি শান্ত ছিলেন। কারাগারের ভেতরে থেকেও বারবার বলেছেন ‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’-এর কথা। এই পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। এ রকম আরও অনেক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, যা কিনা অনেক ‘উচ্চশিক্ষিত’ নেতাও নিতে পারেননি।

খালেদা জিয়ার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি স্বল্পভাষী। কথা কম বলেন। এটা তার গুণ, নাকি দোষ? কথা কম বলা একদিকে ভালো, ভুল হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। যারা বেশি কথা বলেন, তাদের সব বিষয়ে মন্তব্য করার একটা প্রবণতা থাকে। সব বিষয়ে কথা বলতে হলে, সবজান্তা হতে হয়। কিন্তু সবজান্তা তো হওয়া সম্ভব নয়, কারও পক্ষেই নয়। ফলে কোনো কোনো বিষয়ে ভুল কথা বলে ফেলতে পারেন। যেহেতু তিনি ক্ষমতাবান, তাই মোসাহেবের অভাব হয় না। তখন দেখা যায়, ওই ভুল মন্তব্যটিও চাটুকারদের কাছ থেকে হয়তো বাহবা পেতে থেকে। সেই বিচারে এই কম কথা বলার স্বভাবটা খালেদা জিয়ার গুণ। আবার এর নেতিবাচক দিকও আছে। যখন সত্যি সত্যি কথা বলা দরকার, তখনও হয়তো তিনি ওই কম কথার বৈশিষ্ট্যের কারণে চুপ করে থাকলেন। তখন কিন্তু আসলেই ক্ষতি হয়ে যায়। মানুষ ভুল বোঝে। আর তখন যদি তিনি সরকারপ্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন, তাহলে সেটা পুরো জাতির জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে।

কম কথা বলা ক্ষমতাবান মানুষের জন্য ভিন্ন ধরনের আরও একটা ঝামেলার আশঙ্কা থাকে। ধরা যাক, কোনো একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার, কিন্তু তিনি যেহেতু কম কথা বলেন, তাই সেই সুযোগে তার আশপাশের লোকজনই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। এতে অনেক সময় অনেক বড় ধরনের সমস্যা হয়। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এ রকম একটা ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়। ওনার ছোট ছেলে কোকো যখন মারা গেলেন, তার লাশ আনা হলো মালয়েশিয়া থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন গিয়েছিলেন শোক জানাতে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, প্রধানমন্ত্রীকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। গাড়ি থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, সদর দরজা খোলাই হয়নি, ভেতর থেকে তালা মেরে দেয়া হয়েছিল।

সেদিন সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে। আমার একটাই প্রশ্ন ছিলÑ এমন অভদ্র আচরণের সিদ্ধান্তটা খালেদা জিয়া দিলেন কী করে? তারা সবাই আমাকে বলেছেন, বেগম জিয়া তখন পুত্রশোকে কাতর, ছেলের কফিনের পাশে বসে আছেন। হিতাহিত জ্ঞানই তার ছিল কি না, সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রীকে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আসলে অন্য কারও, যারা খালেদা জিয়ার আশপাশে নিয়মিত থাকেন, তাদের। যদি তাও হয়ে থাকে, তবু এর দায় কিন্তু খালেদা জিয়া এড়াতে পারেন না। এ রকম বিপজ্জনক রকম অভদ্র লোককে তিনি আশপাশে রাখেন কেন? অথবা পরে যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখনই বা কেন দুঃখ প্রকাশ করলেন না? কেন ওই অভদ্রগুলোকে বিদায় করলেন না?

অথচ ওই ঘটনায় ক্ষতিটা কেমন হলো? দিন কয়েক আগে এক সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন প্রশ্ন করা হলোÑ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হবে কি না, তিনি কিন্তু ওই দরজা বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গটি তুললেন। বললেন, যেদিন তারা আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, সেদিন সব আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

খালেদা জিয়ার যে বৈশিষ্ট্যটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি রহস্যজনক বলে মনে হয়, সেটি হচ্ছে তার জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা। সন্দেহ নেই ভোটের নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার পেছনে জামায়াতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনী জোটের রাজনীতিতে এমনটা হতেই পারে। কিন্তু বেগম জিয়াকে যখন দেখা যায় তিনি জামায়াতের রাজনীতিরও দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন, তখন হতাশ হতে হয়। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যখন মামলা করল, তখন প্রকাশ্য জনসভায় নিজামী-মুজাহিদদের পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে বেগম জিয়াকে। উনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে নাকি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। তার মানে কী? তাহলে কি নিজামী বা মুজাহিদরা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেননি? না করে থাকলে তাদের আদালত তাদের সর্বোচ্চ সাজাই বা দিলেন কী করে?

বেগম জিয়ার এ বৈশিষ্ট্যটিকে আমি ‘রহস্যজনক’ বলেছি এ কারণে যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উনি তো প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সে সময় তিনি ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি ছিলেন। স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করছেন একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে, আর তিনি শত্রু বাহিনীর হাতে বন্দি জীবন যাপন করছেন। এটা মোটেই সুখকর কোনো পরিস্থিতি হওয়ার কথা নয়। এত কিছুর পরও, ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শনের মানসিকতা কিভাবে থাকতে পারে, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর।

বিস্ময় আরও একটি বিষয়ে রয়েছে। ওই যে সাকা চৌধুরী বলেছিলেনÑ একজনের পিতার স্মৃতির প্রতি, আরেকজনের সন্তানের প্রতি প্রবল দুর্বলতা, সেই প্রসঙ্গটি এখানে এসে যায়। এই দুর্বলতা অস্বাভাবিক নয়। এ রকম হতেই পারে। কিন্তু এখানে একটু যেন শূন্যতা রয়েছে। শেখ হাসিনার পিতার স্মৃতির প্রতি দুর্বলতার বিপরীতে খালেদা জিয়ার দুর্বলতা প্রতি প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির প্রতি হতোÑ তাহলে বোধকরি আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারত। এ কথাটা অনেকেই বলেন, তিনবার ক্ষমতায় এসেও খালেদা জিয়া তার স্বামী হত্যার বিচার দূরে থাক, বিচারের উদ্যোগ পর্যন্ত নেননি। জিয়া যখন নিহত হন, তখন তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি। সেই হত্যার যে ‘বিচার’ সামরিক আদালতে এরশাদ করেছিলেন, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এর সুষ্ঠু একটা বিচার হতে পারত। কেন এ উদ্যোগ বেগম জিয়া নিলেন না, তা আজও রহস্যজনক। নাকি এটাও খালেদা জিয়ার একটা রাজনীতি, সেটাও বলা যায় না।

এত কিছুর পরও খালেদা জিয়া এ দেশের একজন জনপ্রিয় রাজনীতিক। এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচনে, যতগুলো আসনে তিনি অংশ নিয়েছেন, জনগণ ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছে। তিনি কথা কম বলেন, দলের অনেক নেতাকে হয়তো ব্যক্তিগতভাবে চেনেনও না, তারপরও তার কথা শোনার জন্য সমাবেশগুলোতে মানুষ উপচে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন যারা চান, খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করেই চান। শেখ হাসিনার সরকারকে হটিয়ে নতুন যে সরকার গঠন করতে চান, তার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে তাদের চিন্তায় খালেদা জিয়াই থাকেন। এটাই বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আর এই রাজনীতিতে খালেদা জিয়া একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব, হয়তো আগামীদিনগুলোতেও তাই থাকবেন।

মাসুদ কামাল: লেখক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :