বিনা পয়সায় ইফতার

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৫ জুন ২০১৭, ০৮:২০
অ- অ+

ছয় তলায় বড় বড় কড়াইতে ভাজা হচ্ছে জিলাপি, পেঁয়াজু, ছোলা। তার পাশেই রান্না করা হচ্ছে নুডলস। এরপর এগুলো প্লাস্টিকের বড় বড় পাত্রে দ্বিতীয় তলায় ধরাধারি করে নিয়ে আসছেন কয়েকজন যুবক। সেখানে প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা আছে আপেল, খেজুর, আম, মুড়ি।

একটা একটা পদ নিয়ে ১০/১২ জন মিলে দ্রুত গতিতে প্যাকেটে ভরছেন। অন্যদিকে সাউন্ড বক্সে বাজছে কোরআনের আয়াত। প্যাকেট করার কাজ শেষ হয়ে গেলে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। রুমে রাখা ব্ল্যাক বোর্ডে লেখা আছে কোন জায়গায় যাবে কত প্যাকেট খাবার। এরই মধ্যে নিচে চলে এসেছে একটা কাভার্ড ভ্যান। প্যাকেটগুলো নিয়ে বেশ কয়েকজন তুলছে ভ্যানে। বেলা তিনটা বাজার সাথে সাথে ভ্যানগাড়ি রওনা হয় মিরপুর, আরামবাগ, কড়াইল বস্তির উদ্দেশে।

এভাবেই প্রতিদিন দেড় হাজার প্যাকেট ইফতার নিয়ে রাজধানীর সুবিধাবষ্ণিত মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে যায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। একেবারে বিনামূল্যে প্রতিদিন পথ শিশু, প্রতিবন্ধী, সুবিধা-বঞিতদের ইফতার করান তারা। প্রতিদিন সেহরিও করানো হয় ২০০ মানুষকে।

২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন কিশোর কুমার দাশ নামের একজন যুবক। তিনিই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। তিনি পেরু প্রবাসী। সেখানে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত আছেন কিশোর। প্রথমে নারায়ণগঞ্জে স্বল্প পরিসরে গড়ে তোলা হয় ফাউন্ডেশনটি। তখন সমাজের অভাবী মানুষকে মাত্র এক টাকায় দুপুরের খাবার দেওয়া হত। আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটির প্রসার বাড়তে থাকে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কক্সবাজারের রামু, রাজবাড়ী, রাজশাহী, রংপুরে শাখা গড়ে ওঠে। পরিসরও বাড়ে, দুপুরের খাবার থেকে ইফতার এবং সেহরি। প্রতিটি শাখাতেই এখন চালু আছে ইফতার ও সেহরির।

এরই মধ্যে দেশ জুড়ে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সাড়ে চারশ স্বেচ্ছাসেবী কাজ শুরু করেছে। শুধু ইফতার ও দুপুরের খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে গড়ে তুলেছেন পথশিশুদের জন্য শিক্ষা সেবা, চিকিৎসা ও আইন সেবা কেন্দ্র।

রাজধানীর মিরপুরের সাড়ে এগারোতে গড়ে ওঠা শাখার বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক আবু হাসানাত দিপু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিন মিরপুরের এই বাড়িতে ভোর থেকে ইফতার সামগ্রী তৈরির কাজ শুরু হয়। কয়েকজন বাবুর্চি আছেন যারা রান্না-বান্না ও ইফতার সামগ্রী তৈরির কাজ করেন। আর বেলা বাড়ার সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসেন। বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন এরা।’

দিপু বলেন, প্রতিদিন একটি ইফতারের প্যাকেটে দেওয়া হয় ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনী, জিলাপী, নুডলস, আপেল। আর মাঝে মাঝে কলা বা আম দেওয়া হয়। প্রতিদিন ১৫০০ প্যাকেট ইফতার তৈরি করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। অনেকে ভাজা পোড়ার ইফতার পছন্দ করে না। তাই তাদের জন্য ইফতারের সময় ভাত ও মাংসের ব্যবস্থা থাকে।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানালেন, স্রেফ ভালো লাগা থেকেই তারা এখানে বিনাপারিশ্রমিকে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিনহাজ, গ্রিন ইউনিভার্সিটির সৈকত ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মারুফের সাথে কথা হলো তাদের সেবা নিয়ে। জানালেন, তাদের মতন শিক্ষার্থী ছাড়াও চাকরিজীবী এবং সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ জড়িত আছেন এ সংগঠনের সাথে। সমাজের সুবিধা বষ্ণিতদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিবেদিতভাবে কাজ করে বলে তারা এখানে সেচ্ছাশ্রম দেন।

পুরো ব্যাপারটাই আনন্দ থেকে করা। তারা জানান, প্রতিদিন ইফতার নিয়ে বিকালের আগেই বেরিয়ে পড়তে হয়। বিশেষ করে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ, রিকশা-সিএনজি চালক ও অস্বচ্ছল মানুষকে খুঁজে খুঁজে ইফতার দেন তারা। সন্ধ্যার মধ্যে সব মানুষের হাতে ইফতার দিয়ে ফিরে আসতে হয়।

রাজধানীতে স্থায়ী ইফতার বুথ আছে আরামবাগ ও কড়াইল বস্তিতে। আর এই দুই বুথে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ প্যাকেট ইফতার দেওয়া হয়। এছাড়া শাহবাগ, শ্যামলী, এয়ারপোর্ট ছাড়াও সাভারের নদীপথে ভ্রাম্যমাণ ইফতার ভ্যান থেকে খাবার বিতরণ করা হয়।

বিনা পয়সার ইফতার নেবার সময় সিএনজি চালক গিয়াস বলে, ‘প্রায় প্রতিদিনই রোজা থাকি। ক্ষ্যাপ মাইরা মাঝে মধ্যে শ্যামলী এলাকার দিকে থাকলে ইনাদের ফ্রি ইফতার নিই। শাহবাগ বা মিরপুর এলাকায় থাকলেও মাঝে মধ্যে ইফতার নেয়া যায়। আমার মতো আরো অনেক সিএনজি চালকই প্রতিদিন ইফতার নেন ইনাদের কাছ থেকে।’

মিরপুর এলাকায় ইফতার নেওয়ার সময় সেলিম নামে একজন বৃদ্ধার সাথে কথা হয়। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রোজা রেখে আসলে সে রকম কিছু কিনে খাওয়া সম্ভব হয় না। জানি তাদের ইফতার বুথে আসলে ইফতার পাবো। তাই প্রতিদিন বিকালে বুথে আসি।’ তিনি জানান, ভাজা পোড়া ইফতার খেতে ইচ্ছে না হলে ইফতারের সময় এদেরই দেয়া ভাত তরকারি খেয়ে নেন।

মিরপুর এলাকার ইফতার বুথে সমিরন সেনা নামে এক নারী জানান, ‘এখান থেকে ইফতার পাবার পর সেটা বাড়িতে নিয়ে পরিবারের সাথে ভাগ করে খাই। কারণ বাহিরে ইফতারের দাম অনেক বেশি। তাই প্রতিদিন বাড়ি থেকে হেঁটে আসেন মিরপুরের এই ইফতার বুথে। সমিরনের অনেক প্রতিবেশীই এখান থেকে ইফতার গ্রহণ করে বলে তিনি জানান।

প্রতি বাক্স ইফতারে কী রকম খরচ পড়ে জানতে চাইলে আবু হাসানাত দিপু বলেন, ‘ইফতারে প্রতি প্যাকেটে খরচ পড়ে ৪০ টাকা। আর সেহরির খাবারের খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সবগুলো শাখা মিলিয়ে প্রতিদিন মোট তিন হাজার মানুষের ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়া সাড়ে ৪০০ মতো মানুষ সেহরি করেন প্রতিদিন। সেহরিতে ভাত, সবজি ছাড়াও গরু ও মুরগি বা মাছ দেওয়া হয়। আগে দুপুরের খাবারের জন্য এক টাকা নেওয়া হতো তবে এখন ইফতার ও সেহরি ফ্রি। এ জন্য টাকা নেওয়া হয় না।’

টাকার উৎস কি সেটা জানতে চাইলে দিপু বলেন, ‘শুরুর দিকে সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে চলত। পরে আমাদের কার্যক্রম দেখে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের কাছে টাকা পৌঁছে দেন। কেউ কেউ অন্যান্য সাহায্যও দেন। যেমন ইউনিলিভার আমাদেরকে প্যাকেট, নুডলস ও কাভার্ড ভ্যান দিয়ে ইফতার ও সেহরিতে সাহায্য করছে। এছাড়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে টাকা পাঠান।’

ঢাকাটাইমস/০৫জুন/সিসা/কেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলের কেউ অনৈতিক কাজ ও অপরাধ করলে কঠোর ব্যবস্থা: বিএনপির সতর্কতা
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৩, বিপুল সৌদি রিয়াল ও মোটসাইকেল জব্দ
ভাঙনের মুখে চালিতাবুনিয়া, টেকসই বাঁধসহ তিন দাবিতে ঢাকায় এলাকাবাসীর মানববন্ধন
যাত্রাবাড়ী ও মুগদায় ৩ জনের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা