জাতীয় প্রতীকের নকশাবিদ মোহাম্মদ ইদ্রিস

তায়েব মিল্লাত হোসেন
| আপডেট : ১০ মে ২০১৯, ১১:০৫ | প্রকাশিত : ১০ মে ২০১৯, ১০:৩৮

প্রগতির পথে বাঙালির নবযাত্রা বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে। পাকি শাসকরা বাংলার ভাষা, বাংলার সংস্কৃতিকে যতোই চেপে ধরতে চেয়েছে; বাংলার মানুষ ততোই আঁকড়ে ধরেছে আত্মপরিচয়কে, উপেক্ষা করেছে শাসকের রক্তচক্ষু। এ নিশ্চয়ই ছিলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। কিন্তু আন্দোলনের মাঠে আমরা পেয়েছি রাজনীতবিদ ছাড়াও ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পী- সবাইকে। এমনি একজন শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিস। সরাসরি জড়িত ছিলেন ভাষা আন্দোলনে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে আর ছায়ানট প্রতিষ্ঠায়। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের জাতীয় প্রতীকের অন্যতম নকশাবিদ তিনি। দেশের প্রথম ডাকবিভাগের খামের নকশাও করেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। এসব কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য একজন হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবেন এই শিল্পী।

মোহাম্মদ ইদ্রিসের জন্ম ১৯৩১ সালের ১০ মে, রংপুরে; মৃত্যু ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর, ঢাকায়। তাঁর বাবা বসিরউদ্দীন আহমেদ, মা আছিয়া বেগম। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। শৈশবেই তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালে ঢাকায় এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হন। শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র তিনি। এই কলেজ থেকে পাস করে কাজ করেন পাকিস্তান অবজারভার-এ। একই সময় তিনি যুক্ত ছিলেন ‘রূপায়ণ’ নামের একটি হস্তজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। সে সময় রূপায়ণের ছাপা শাড়ি বাজারে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৬০ সালে কামরুল হাসানের উদ্যোগেই মোহাম্মদ ইদ্রিস যোগ দেন ডিজাইন সেন্টারে। যা পরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থায় (বিসিক) অঙ্গীভূত হয়। ১৯৯১ সালে সেখান থেকে উপপ্রধান নকশাবিদ হিসেবে অবসর নেন মোহাম্মদ ইদ্রিস।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নবযাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন এই শিল্পী। চলছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার সংগ্রাম। পাকিস্তানের সব নিদর্শন চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। নতুন করে গড়তে হবে জাতীয় প্রতীক, চিঠির খাম, ডাকটিকিট, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম। শিল্পী হিসেবে এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম করার জন্য পটুয়া কামরুল হাসানকে দায়িত্ব দেন। তিনি শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ বেশ কয়েকজনকে এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন। ইদ্রিসের তৈরি ভাসমান শাপলা ও শামসুল আলমের করা দুই পাশে ধানের শীষ বেষ্টিত পাটপাতা ও চারটি তারকা- দুজনের এই নকশা মিলে আমাদের জাতীয় প্রতীক চূড়ান্ত রূপ পায়। সেই সময়ে সরকার ডাকবিভাগের খামের নকশা আহ্বান করে। শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিস তাতে সাড়া দেন। নকশা পাঠান। চিঠির খামের এ নকশা নির্বাচিত হয়। শাপলা ফুলের নকশার সেই খাম এখনো ব্যবহৃত হয়।

১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে তাকে ময়ূর অঙ্কিত জামদানি শাড়ি উপহার দেয়। এই শাড়ির নকশাবিদও ছিলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস।

কিশোরকাল থেকেই রংপুরে তিনি লেখালেখি ও বই পাঠ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকায় এসে তা আরও পূর্ণতা পায়। ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি ও ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানের সহযোগিতায় তাঁর সম্পাদনা ও অঙ্গসজ্জায় প্রকাশিত হয় ‘বই পড়া’নামে বই। এটি সুনির্বাচিত সঙ্কলন হিসেবে পাঠকমহলের সমাদর পায়। তিনি ‘ইদু বাউদিয়া’ ছদ্মনামে শিশুতোষ ছড়া লিখতেন। তাঁর সম্পাদিত শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ ‘এলের পাত বেলের পাত’- লোকজ ও আধুনিক ছড়ার এক দারুণ মিশেলে নবতর সৃজন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ‘হাসির দেশ’ তাঁর অন্য এক ছড়ার বই।

প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত ছিলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদ পল্লীকবি জসিমউদদীনের ‘বাংগালীর হাসির গল্প’, কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ‘পীত নদীর বাঁকে’, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ (দ্বিতীয় সংস্করণ) ও আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’।

অনেকটা অন্তরালে থেকেই শিল্পী মোহাম্মদ ইদ্রিস গ্রামবাংলার নানা রকম হস্তজাত শিল্পের উৎকর্ষসাধনে কাজ করে গেছেন। জামদানি, চামড়াজাত হস্তশিল্প ও লুপ্তপ্রায় শতরঞ্জিশিল্পের পুনরুজ্জীবনে ভূমিকা রেখেছেন। হালে জামদানির যে জনপ্রিয়তা, তার পেছনে ষাটের দশক থেকে কাজ করেছেন তিনি।

প্রয়াণের পর মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রথম জন্মদিন এলো। বেঁচে থাকলে ৮৮ বছরে পা রাখতেন এবার। তবে জাতীয় প্রতীকের অন্যতম রূপকার হিসেবে বাঙালি ও বাংলাদেশ যতোদিন থাকবে, ততোদিন সোনার হরফেই লেখা থাকবে মোহাম্মদ ইদ্রিসের নাম। অমর এই শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তায়েব মিল্লাত হোসেন: কবি, গবেষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :