পাণ্ডুলিপি থেকে বই

লেখক-প্রকাশকের ভূমিকা

কামরুল হাসান শায়ক
| আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:০২ | প্রকাশিত : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৪৬

ভূমিকা

প্রকাশনা জগতে লেখক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকারী। আর প্রকাশক এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের প্রকাশ ও পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে নান্দনিক উপস্থাপন, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণসহ প্রকাশনার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করেন। পাঠকের উপযোগিতার মাত্রা বিবেচনায় রেখে পা-ুলিপি রচনার ক্ষেত্রে লেখকের ভূমিকা যেমন অনন্য, তেমনি লেখকের রচিত পা-ুলিপিটি সম্পাদনা ও প্রুফ রিডিংয়ের মতো নানান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে প্রকাশকের ভূমিকা অপরিসীম।

পাণ্ডুলিপি হলো লেখকের রচিত মৌলিক রচনার খসড়া। এটা হাতে লেখাও হতে পারে, হতে পারে কম্পিউটারে টাইপকৃত।

প্রকাশনা জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হলো পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার সময় লেখককে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। একজন লেখকই জানেন বইটির কোন অংশ কোথায় উপস্থাপন করলে কিংবা বিষয়-বিন্যাস কেমন হলে সুন্দর ও সাবলীল হবে। পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করা, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক কপি প্রকাশকের কাছে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে লেখকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখকের ভূমিকা প্রকাশনায় পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকরণে প্রাথমিক পর্যায়ে লেখকের কিছু মৌলিক কাজ রয়েছে। শুধু মূল টেক্সট লিখলেই লেখকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে জমা দেওয়ার জন্য যেমন লেখকের প্রস্তুতি রয়েছে তেমনি পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার রয়েছে নিয়ম-পদ্ধতি।

লেখকের করণীয় ও পাণ্ডুলিপি জমাদানের প্রক্রিয়ার প্রথমেই আসে লেখক-প্রকাশকের আলোচনা। সাধারণত প্রাথমিকভাবে পাণ্ডুলিপি রচনার পর লেখক সেটি প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইটির বিষয়বস্তু ও উপযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব নীতিমালা ও প্রকাশশৈলী থাকে। পা-ুলিপির বিষয়বস্তু নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না প্রকাশক যাচাই করেন। সেই সঙ্গে বাজারে প্রকাশিতব্য বইটির উপযোগিতা কেমন হবে তা নিয়েও আলাপ করেন। এরপর প্রকাশক বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞের নিকট আরো মানোন্নয়নের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রেরণ করেন।

সম্পাদকও লেখকের মতো গুরুত্বসহকারে পাণ্ডুলিপিটি পড়ার পর এটিকে আরো সমৃদ্ধ, পাঠ ও সময়োপযোগী করার জন্য তথ্যের সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধনীর ব্যাপারে লেখকের সঙ্গে আলোচনা করেন। শুধু বিষয়বস্তু-সংশ্লিষ্ট আলোচনাই নয়, বরং প্রচ্ছদ, উপস্থাপনা এমনকি অলংকরণ নিয়েও পারস্পরিক মতবিনিময় করেন।

এছাড়াও বইটি যে বয়সের পাঠকের জন্য রচিত হয়েছে, তাদের উপযোগী তথ্য ও ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে কি না সে বিষয়েও আলোচনা হয়। এসব বিষয় নিয়ে বই প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত সম্পাদক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে লেখককে সহযোগিতা করেন। সম্পাদনা ও উৎপাদন পরিকল্পনা, বইয়ের কালার ও সাইজ ইত্যাদি নিয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

প্রকাশক ও সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করার মাধ্যমে কাজের সূচনা হয় এবং এর মাধ্যমে লেখকের করণীয় কাজসমূহ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকাশক ও সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনার পর লেখককে যেসব তথ্যসহ পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হয়, তা হলো: হাফ টাইটেল পেজ, টাইটেল পেজ, ইম্প্রিন্ট পেজ, মুখবন্ধ, লেখকের কথা, ভূমিকা, উৎসর্গ, স্বীকৃতি বা প্রাপ্তিস্বীকার, লেখকের ছবি, উদ্ধৃতি, সূচিপত্র, ইলাস্ট্রেশন বা ছবি বা চিত্রের তালিকা, মূলপাঠ শুরুর পূর্বে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি, মূলপাঠ: অধ্যায় শিরোনাম, সব পাঠ্যাংশ, পরিচিতি এবং পার্ট টাইটেল, ফাঁকা পৃষ্ঠায় চিত্র বা ইলাস্ট্রেশন, টীকা, পরিশিষ্ট, টীকাপুঞ্জ, টেবিল, গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট। এগুলো লেখককে প্রস্তুত করে চূড়ান্তভাবে প্রকাশকের কাছে জমা দিতে হয়। এরপর পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের জন্য অন্যান্য কর্মসূচি প্রকাশক শুরু করেন।

লেখক যেহেতু পাণ্ডুলিপি রচনার সঙ্গে সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে জড়িত, তার পক্ষে উল্লিখিত তথ্যসমূহ নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করা সহজ। তবে এগুলো প্রস্তুত করার সময় সম্পাদক ও প্রকাশকের সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য উপস্থাপনের সঠিক শৈলী জেনে নেন। ফলে এগুলো খুব বেশি সম্পাদনার প্রয়োজন পড়ে না।

লেখককে পাণ্ডুলিপি প্রিন্টকৃত কপি জমা দেওয়ার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ফাইলও জমা দিতে হয়। কাজের স্বার্থে প্রকাশকদের পাণ্ডুলিপির ইলেকট্রনিক কপির সর্বশেষ সংস্করণটির প্রয়োজন পড়ে। লেখকদের প্রতি প্রকাশকের অনুরোধ থাকে যাতে তারা অবশ্যই তাদের সব ইলেকট্রনিক ফাইলের ব্যাক-আপ সুরক্ষিত রেখে লেখা জমা দেন। বই প্রকাশের কাজে বিশেষ করে প্রকাশকরা ইলেকট্রনিক ফাইলের পাশাপাশি একটি হার্ড কপিও জমা নেন। কোনো কোনো প্রকাশক লেখার ডক ফাইলের সঙ্গে তার পিডিএফ ফরম্যাটও চেয়ে থাকেন। ইলেকট্রনিক ফাইলটি অন্য কম্পিউটারে নিলে অনেক সময় ফন্ট ভেঙে যায়, এমন সমস্যা রোধে পিডিএফ ফাইল বেশ কার্যকর। লেখকদের প্রতি প্রকাশকের আরো অনুরোধ থাকে যাতে তারা লেখার সঙ্গে তাদের নাম, লেখার শিরোনাম, ইলেকট্রনিক ফাইলের নাম এবং লেখায় যে সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়েছে, সেসবের বিস্তারিত উল্লেখসহ জমা দেওয়া ডকুমেন্টের বর্ণনা সংবলিত একটি চিঠি বা কভার লেটার জমা দেন। লেখার যেসব উপাদান ইলেকট্রনিক ফর্মে বা আকারে থাকে না, সেসব বিশদভাবে উল্লেখ করে দিতে হবে। একইভাবে ভিডিও বা অ্যানিমেশনের মতো কিছু যার প্রিন্ট নেওয়া সম্ভব না, সেগুলোয় ব্যবহৃত প্রতিটি সফটওয়্যারের নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্যও উল্লেখ করতে হয়।

লেখকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশকের কাছে জমা দেওয়ার পর সেটিতে আর কোনো পরিবর্তন না আনা। যদি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আনতেই হয়, তাহলে তা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশককে জানিয়ে দিতে হয়। আর প্রতিবার সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে পূর্বের কপি প্রকাশক সংরক্ষণ করেন। প্রকাশকের নিকট পাণ্ডুলিপির কপিটি প্রয়োজনীয় তথ্যসহ জমা দেওয়ার পরই আক্ষরিক অর্থে লেখকের কাজ শেষ হয়। তবে কোনো তথ্য বা বিন্যাসে অসংগতি পেলে কিংবা কোনো পরামর্শ ও নির্দেশনা থাকলে প্রকাশক লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করে থাকেন।

সহজ কথায়, শুধু রচনা করলেই লেখকের ভূমিকা শেষ হয়ে যায় না, বরং এটাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে প্রকাশককে নানান তথ্য ও ডকুমেন্ট দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করতে হয়। প্রকাশকের কাছে প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার পর প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট কাজ শুরু হয়, শুরু হয় প্রকাশকের কাজ।

প্রকাশকের ভূমিকা লেখকের পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার প্রাথমিক কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশকের কাজ শুরু হয়। তিনি পাণ্ডুলিপিকে বই হিসেবে প্রকাশের জন্য উপযোগী করে তোলেন।

বইয়ের পৃষ্ঠাবিন্যাস বা ফরম্যাটিং, টেবিল ও চিত্রকর্ম বিন্যাস, ক্রস চেকিং, ইলেকট্রনিক ফাইলের নামকরণ ও সংরক্ষণ ইত্যাদি প্রকাশকের কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও প্রিন্ট, বাঁধাই ও গুদামজাতকরণসহ পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সব কর্মকা-ই প্রকাশকের। পা-ুলিপি বইয়ের আকার পেতে প্রকাশকের মুখ্য ভূমিকাসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাবিন্যাস করা প্রকাশকের অন্যতম প্রধান কাজ। লেখকের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শেষে এবং লেখকের প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টসহ পা-ুলিপি জমা দেওয়া সম্পন্ন হলে পৃষ্ঠাবিন্যাস বা ফরম্যাটিংয়ের কাজ শুরু হয়। প্রকাশকদের অনেকেরই ফরম্যাট, সফটওয়্যার ও মুদ্রাক্ষর, ইলাস্ট্রেশন, টেবিল প্রভৃতি পছন্দের ক্ষেত্রে নিজেদের কিছু নির্দিষ্ট চাহিদা বা অভিরুচি থাকে। লেখকদের সে অনুযায়ী পাণ্ডুলিপি সাজাতে হয়। লেখা সংগতিপূর্ণ ও সরল হওয়া একান্ত জরুরি। লেখকদের একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে- তাদের বই, জার্নাল প্রভৃতি প্রকাশিত হওয়ার আগে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের চাহিদা বা পছন্দ অনুযায়ী অন্য কোনো সফটওয়্যারে কনভার্ট বা রূপান্তর করা হয়ে থাকে। তাই প্রতিটি শব্দ সংগতিপূর্ণ ও সরল হওয়াটা এক্ষেত্রে উপস্থাপনার স্টাইল বা ধরনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশদভাবে বিন্যাস করা পাণ্ডুলিপি সাদামাটাভাবে উপস্থাপিত হলেও প্রকাশকরা সেটাকেই সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

পৃষ্ঠাবিন্যাস সম্পন্ন হলে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার প্রয়োজন পড়ে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার সব কাজ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা অনুযায়ী সম্পাদক সম্পন্ন করে থাকেন। উল্লেখ্য, সম্পাদকও প্রকাশকের সঙ্গে একাত্ম হয়েই কাজ করেন এবং তাদের লক্ষ্য অভিন্ন। লাইনের মাঝে ব্যবধান, শব্দের মাঝে ব্যবধান, যথাযথ বিন্যাস ও প্রান্ত, অনুচ্ছেদের মাঝখানে স্পেস, ট্যাব ও হার্ড রিটার্ন, হাইফেনের ব্যবহার, ড্যাশ, ইটালিক, আন্ডারলাইন ও বোল্ডফেস ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের শিরোনাম বিন্যাস, উদ্ধৃতি, টেবিল ও চিত্রকর্ম বিন্যাসের মতো সব কাজে প্রকাশকের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং ক্রস চেকিংসহ ইলেকট্রনিক ফাইল সংরক্ষণের ব্যাপারেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এছাড়াও চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি প্রেসে যায়, সেখান থেকে প্রিন্ট হয়ে বাঁধাইকারীর কাছে পৌঁছাতে হয়। বাঁধাইকারী প্রকাশিত শিটগুলো ভাঁজ করে সেলাই ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে। এখানেই মলাটবদ্ধ করা হয় বইটিকে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে জ্যাকেট দিয়ে আবৃত করে নান্দনিকতা বৃদ্ধি করা হয়। তারপর বই গোডাউন বা গুদামঘরে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের জন্য পাঠাতে হয়। এ সব কাজও প্রকাশককেই করতে হয়।

উপসংহার সারকথা হলো, লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদকে কাগজে ছাপার অক্ষরে সাজিয়ে পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর সব কাজই হলো প্রকাশকের, আর এ কাজের একদম মূলে রয়েছে লেখকের ভূমিকা। লেখক তার জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতাকে শব্দে শব্দে সাজিয়ে তোলেন, আর সেটাই হয়ে ওঠে পাণ্ডুলিপি। মনে রাখতে হবে, একটি পাণ্ডুলিপি বইয়ের আকার পেতে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আর এর পুরোটাই সম্পন্ন করতে হয় প্রকাশককে। অর্থাৎ লেখক ও প্রকাশকের যৌথ প্রয়াসে একটি পা-ুলিপি বইয়ের আকার ধারণ করতে পারে এবং তা হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে নান্দনিক ও পাঠযোগ্য।

লেখক: প্রকাশনা বিশেষজ্ঞ, প্রকাশনাবিষয়ক সিরিজ প্রণেতা এবং চেয়ারম্যান, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :