মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজি শেখানো মানসিক দীনতা: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক
  প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:৩০
অ- অ+

যারা নিজের মায়ের ভাষা, এলাকার ভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজি একসেন্টে কথা বলার চেষ্টা করেন তাদের জন্য তার করুণা হয় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বর্তমান বিশ্বগ্রামে অন্য ভাষা শেখার দরকার আছে, তবে মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। মাতৃভাষা বাদ দিয়ে যারা সন্তানকে ইংরেজি শেখান, তারা মানসিক দীনতায় ভোগেন।

আজ শুক্রবার একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এক সভায় তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমাদের অনেকের মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে। অনেকেই এখন নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মিডিয়ামে না পড়ালে ভালো চাকরি পাবে না, সমাজে চলতে পারবে না- এ ধরনের মানসিক দৈন্যতায় ভোগেন। সাথে সাথে আরেকটা খারাপ জিনিস হলো অনেক ছেলেমেয়ে ঠিক বাংলা ভাষায় কথা বলা বা নিজেদের এলাকার ভাষার কথা ভুলে গিয়ে কেমন যেন একটা ইংরেজি একসেন্টে বাংলা বলার চেষ্টা করেন। মানে হলো বাংলা বলতে ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে। এরা তো এই দেশেই লেখাপড়া শিখছে!’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মতো যাদের দুভার্গ্য, ৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পরে বাবা-মা, ভাইকে হারিয়ে রিফিউজি হিসাবে বিদেশে ছিলাম, আমাদের এই সৌভাগ্য হয়নি যে শুরু থেকে সন্তানদের বাংলা মিডিয়ামে পড়ানোর। তাদের পড়াতে হয়েছে বিদেশি স্কুলে। সেখানেও আমরা চেষ্টা করেছিলাম তাদের বাংলা ভাষা শিখাতে। আমরা ঘরে সব সময়ই বাংলা ভাষা বলতাম। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। তাদের উচ্চারণে যদি কোনো সমস্যা হয় তাতে দোষ দেয়ার কিছুই নাই। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে থেকে বাংলা ভাষার মতো বলতে পারে না, ইংরেজি উচ্চারণে বলতে হয়, তাদের প্রতি করুণা ছাড়া কিছুই নাই।’ নিজের দেশের, নিজের এলাকার, নিজের গ্রামের কথা বলতে তার বেশি পছন্দ বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

‘সভা-সমাবেশে একটু ভালোভাবে বাংলা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু ঘরে যখন বলি তখন আমরা গোপালগঞ্জের ও ঢাকার ভাষা মিলিয়েই বলি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারণ কেন বলি, ছোটবেলায় চলে এসেছি ঢাকা শহরে। সেখানে সেই ভাষার একটা প্রভাব। আর টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে জš§ নিয়েছি, সেই ভাষার একটা প্রভাব। সব মিলিয়ে আমরা বলি, তাতে আমাদের কোনো লজ্জা নাই। জাতির পিতার ভাষণে আপনারা দেখেছেন তিনি গোপালগঞ্জের শব্দগুলো বলে গেছেন অকাতরে, যা মানুষের ভেতরে একটা আবেদন সৃষ্টি করেছে। তিনি খুব দ্রুত মানুষের হৃদয়ে ও কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভাষা মানুষের মনের ভাব, চাহিদাসহ সবকিছু ব্যক্ত করারই একটা মাধ্যম। ভাষাটা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের মূল শক্তি। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ তা ভাষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। কাজেই ভাষার গুরুত্ব হয়েছে। বিশেষ করে মাতৃভাষা জšে§র পর মায়ের কাছ থেকে আমরা শিখি। পাশাপাশি একটি দেশে সাংস্কৃতি, কৃষ্টি এই ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই সেই ভাষার জন্য আমাদের দেশে, আমাদের ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও তা গড়ে ওঠায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত একটি শিক্ষা সম্মেলনের মাধ্যমে। সেখানে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠার দিক থেকের এখানকার (বাংলার) লোকই ছিল বেশি। ৫৬ ভাগ আমরা, কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অধিকার কেড়ে বিজাতীয় উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন থেকেই আমাদের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ এফএইচ হলে একটি সভা হয় ছাত্রদের, সেই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিশ আরও কয়েকটি ছাত্রসংগঠন নিয়ে বৈঠক হয়। তারই প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হয়, ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসাবে পালন হবে। সেই দিন থেকেই আমাদের আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারপর তাকে (বঙ্গবন্ধু) বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হয়। যখনই তিনি মুক্তি পেয়েছেন ভাষা আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন স্থানে সফর করেছেন। মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। এরপর ১৯৪৯ সালে তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হলো, আর মুক্তি দেয়া হয়নি। ১৯৫২ সালে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু বন্দি অবস্থায়ও তিনি যখন চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হতো, সেখানে তিনি আমাদের ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতেন। আবার এ কারণে তাকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হতো। এভাবে এই আন্দোলনটা গড়ে ওঠে। রক্তের অক্ষর দিয়ে মাতৃভাষার দাবির কথা জানিয়ে গেল আমাদের (একুশের) শহীদরা।’ ২১ ফেব্রুয়ারির সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।

একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানান ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার জন্য জাতিসংঘে দাবি জানানোর উদ্যোক্তাদের প্রতি। তিনি বলেণ, ‘আমাদেরই কিছু বঙ্গসন্তান, যারা কানাডায় বাস করত, সেখানে মাতৃভাষা প্রেমী কয়েকটি সংগঠন গড়ে ওঠে আরও কিছু ভাষাভাষীদের নিয়ে। ওরা উদ্যেগ নেন। তবে একটি সদস্যরাষ্ট্র এই প্রস্তাব দিলে জাতিসংঘ গ্রহণ করবে এটা আমাদের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সাদিক সাহেবের মাধ্যমে আমাকে জানানোর পরে আমি বলি, আপনি এক্ষুনি প্রস্তুতি নেন। যত রাতই হোক আমি বসে থাকব। আমরা সেটা পাঠিয়ে দিব। আমরা সেই স্বীকৃতিটা পেয়েছি।’

জাতির পিতা ভাষা সম্পর্কে সচেতন এবং আন্তরিক ছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলতেন, মাতৃভাষার অপমান সহ্য করা যায় না। আমাদের দুর্ভাগ্য ছিলো আমাদের ওপর বারবার আঘাত এসেছিলো। আমাদের দেশের মানুষ যখন ভাষার জন্য আন্দোলন করছে, এই আন্দোলন করা অবস্থায় প্রস্তাব আসলো বাংলা ভাষাকে আরবি অক্ষরে লেখা হবে। এর বিরুদ্ধে আবার প্রতিবাদ জানাল আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ সকল মানুষ। পরবর্তীতে আরেকটি প্রস্তাব আসলো ল্যাটিন শব্দে বাংলা লিখতে হবে। মানে বাংলাকে কীভাবে বাদ দেয়া যায় সেই চেষ্টা। তার বিরুদ্ধেও আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। বারবার আমাদের ওপর আঘাত এসেছিলো। এটা শুধু আমাদের ভাষার ওপর না, আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সবকিছুর ওপরই আঘাত। এটা মূলত আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত এসেছিলো। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে অগ্রযাত্রা সেখান থেকেই কিন্তু আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এটাই বাস্তব।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন যখন ভাষার ওপর আঘাত এলো তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন, আর পাকিস্তানিদের সঙ্গে না, আমাদের আলাদা থাকতে হবে, আলাদা রাষ্ট্র করতে হবে। সেই কথাটা মনে রেখে কখনো তিনি মুখে প্রকাশ করে বলেননি। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এবং তিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।’

বাংলা ভাষা নিয়ে জাতির পিতার প্রীতির বিষয়টি বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ পাওয়ার কথা জানান বঙ্গবন্ধু-কন্যা। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে তার একটা বই বেরিয়েছে, যেটা ১৯৫৪ সালে লেখা। তিনি ১৯৫২ সালে যখন কারাগার থেকে মুক্তি পান, পিকিংযে একটি শান্তি সম্মেলনে পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি হিসাবে চীনে যান। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন আবার কারাগারে যান তখন তিনি চীনের ওপর ‘নয়াচীন’ বইটা তিনি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, পিকিং যখন তাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়েছিল তখন তিনি বাংলা ভাষায় দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সাল থেকেই শুরু করেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনিই প্রথম বাংলায় বক্তব্য রাখেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পরে আমি যতবার জাতিসংঘে গিয়েছি ততবারই আমি জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছি।’

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আমরা পেলাম তখন আমরা এই ইনস্টিটিউট গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। যেটা আমাদের তৎকালীন সরকারের একেবারে শেষ সময়ে। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে আমরা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। নির্মাণকাজও শুরু করেছিলাম। কিন্তু পরে যারা ক্ষমতায় এসেছিলো তারা আর কোনো কাজই করেনি। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরে আমরা এর নির্মাণকাজ আবার চালু করি। ’

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাসিনা চ্যাপ্টার ক্লোজড, আ.লীগ উইল নেভার কাম ব্যাক: হাসনাত
সরকারি দপ্তরে গাড়ি কেনা ও বিদেশ সফর বন্ধ
কুমিল্লা বোর্ডে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত  
হাসপাতালের গার্ডকে চড় মেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হারান মুরাদ হাসান! কোথায় এখন!
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা