যুক্তরাষ্ট্রফেরত নারীর হোম কোয়ারেন্টাইনের গল্প

মৌসুমী জামান। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্র্যান্ড হলেও বেশি সময় থাকেন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে। মাঝে মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কয়দিন থেকে চলে আসেন বাংলাদেশে। গত ২০ মার্চ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মরণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় দেশে ফিরেছেন তিনি। তবে এবারের ফেরাটা তার জন্য খুব একটা সুখবর ছিল না। কারণ তিনি যখন দেশে ফিরেন তখন এখানেও করোনার থাবা পড়েছে। বিদেশ থেকে ফিরলে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা চালু হয়েছে ততক্ষণে।
করোনার কারণে বিমানবন্দরের অতিরিক্ত কড়াকড়ি, বাড়তি কাগজপত্র পূরণ করে জমা দেয়া, হাতে অমোচনীয় সিল দেয়া এবং হোম কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় শুরুতে কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করে পরিবারের সহযোগিতায় পুরোপুরি হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করেন মৌসুমী জামান।
পরিবারের সঙ্গে থাকলেও এক ধরনের একাকিত্ব সময় কাটাতে হয়েছে ১৩ দিন। এই সময়ে ভালো-মন্দ সব ধরনের অভিজ্ঞতার সঞ্চার হলেও নিজের এবং পরিবারের সবার মাঝে স্বস্তি এনে দিতে পেরেছেন তিনি।
তার মতো প্রবাস থেকে দেশে ফেরা অন্যদের উদ্দেশে মৌসুমী জামানের আহ্বান- নিজের এবং পরিবার তথা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই কোয়ারেন্টাইনে থাকুন। অন্যথায় সামান্য অসচেতনতা সবার জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বুধবার ঢাকা টাইমসকের সঙ্গে যখন মৌসুমী জামানের কথা হয় তখন তার হোম কোয়ারেন্টানের ১৩ দিন চলছে। দেশে ফেরার পর থেকে রাজাবাজারের বাসার একটি রুমেই তার বসবাস। খাওয়া-দাওয়া, গোসল, নামাজ সবই এই রুমে। একবারের জন্যও রুম থেকে বের হননি তিনি। মাঝে মাঝে বারান্দায় হাঁটাচলা আর গাছের পরিচর্যা করে সময় কাটছে তার। পুরো সময়ে তাকে সহযোগিতা করেছেন তার মেয়ে।
মৌসুমী জামানের বাড়ি গোপালগঞ্জে। আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, অনুচক্রিকা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তিনি। নিজের সাধ্যমত সমাজের অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে নিজে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন মৌসুমী।
মৌসুমী বলেন, আমার দেশে ফেরার কথা ছিল ২৪ মার্চ। কিন্তু করোনার কারণে তড়িঘড়ি করে ২০ তারিখ এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ঢাকায় ফিরে আসি। কিন্তু করোনার কথা শুনলেও এ নিয়ে তেমন কোনো জানাশোনা না থাকায় ঢাকার বিমানবন্দরে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়ি।
বিদেশফেরতদের জন্য সেখানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম খুব একটা ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা ভালো হয়নি। অনেকেই ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন। তেমন কোনো কাউন্সিলিং করা হয়নি। কারণ অনেকেই দীর্ঘ সময় জার্নি করে এসেছেন। স্বাভাবিক কারণেই সবাই ক্লান্ত ছিলেন। সবাইকে ফর্ম পূরণের পর একটি কাগজ হাতে দেয়া হলেও আমাকে কিছুই দেয়নি। এ নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছি। তবে সবশেষ হাতে সিল দেয়ার বিয়ষটিও আমাকে অবাক করেছে। কারণ আমি কিছুই জানতাম না।
হজক্যাম্পে না থেকে মানুষের বিক্ষোভ করার কারণ কী ছিল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে মানুষকে সেভাবে বোঝানোই হয়নি। সেখানকার পরিবেশও তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু যদি নিজের এবং পরিবারের সেফটির জন্য থাকতেই হবে এসব ভালো করে বোঝাতে পারলে নিশ্চয়ই তারা সেখানে থাকতেন।
নিজের কোয়ারেন্টাইন জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশে আসার খবরের আগেই আমার মেয়ে বাসার একটি রুম পুরো গুছিয়ে রাখে আমার জন্য। সেখানেই আমার দিনগুলো কাটছে।’
কোয়ারেন্টাইনে থাকাবস্থায় ভালো মন্দ দুই ধরনের অভিজ্ঞতার হয়েছে বলেও মনে জানান মৌসুমী। তিনি বলেন, আমার এলাকাতে একটা পরিচিতি আছে। সবাই আমাকে চিনে। কিন্তু আমি যখন বাসার এখানে আসি একজনকে সালাম দেয়ার পর তার চেহারা দেখে মনে হয়েছে আমি বিদেশ থেকে এসে অপরাধ করেছি। বাসায় যাওয়ার পর দেখি আশপাশের লোকজন, কাজের বুয়ারা কেউ কেউ বলছে, আন্টি কেমন আছে? সুস্থ আছে তো? তার কী অবস্থা? এসব শুনে মনে হয় আমি অসুস্থ একজন মানুষ। এক বুয়া বলছে, ওই বাসায় আন্টি বিদেশ থেকে এসেছে সেখানে আর কাজ করা যাবে না। এমন আচরণ অনেকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না।’
ভালো অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সময়ে এমনও হয়েছে আশপাশের লোকজন এসে সাহস জুগিয়েছেন। এতে একাকিত্বটা অনেকটা কেটে গেছে।
কীভাবে সময় পার করতেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সব কাজ ছিল রুমের মধ্যে। মেয়ে আমাকে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিতো। আমি রুম পরিষ্কার, নিজের কাপড়চোপড় ধোয়া সব নিজ হাত করতাম। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতাম। গাছের পরিচর্যা করতাম। আমার কাছে মনে হতো এটাই আমার পরিবার। এভাবেই কেটে গেছে ১৩ দিন। আশা করি আর একটা দিনও ভালোভাবে কেটে যাবে।
প্রবাস থেকে আসা যারা কোয়ারেন্টাইন মানছেন না তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এটা এমন কোনো কষ্টের কাজ নয়। আপনি নিজের এবং পরিবারকে অজানা বিপদের হাত রক্ষার জন্য কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করলেন। শুধু বাইরে ঘোরাফেরা করতে পারলেন না এর চেয়ে তো কোনো সমস্যা আমার মনে হয়নি। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার এই ত্যাগের কারণে পুরো পরিবার এমনকি আপনার পাশের মানুষগুলো নিরাপদ থাকবে। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।’
(ঢাকাটাইমস/০১এপ্রিল/জেবি)

মন্তব্য করুন