নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া অনূদিত জাপানি কবিতা
১। কবি প্রিন্স ইকুসা: দীর্ঘ বসন্ত দিনে
বসন্তের এই দীর্ঘ-ব্যাপ্ত দিনান্তে
কুয়াশা-কুহেলি দিগন্তে মেলে ডানা,
নিজ পরিচয় ঢেকে সে-সবার অজান্তে
গো-ধূলিতে আঁকে বিদায়ের আল্পনা।
বুকের পাঁজরে লালিত পুঞ্জ আশা
আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়,
এতো কাঁদি তবু পাইনা-যে ভালবাসা
যাতনাই যেন জীবনের সঞ্চয়।
ভালোবাসা বুঝি আসবে না আর ফিরে
অশ্রু নদীতে বিলাপে হারাই কূল,
মিলনে ব্যাকুল কাতর কামনা ঘিরে
বিরহের গান গায় যেন বুলবুল।
আশার লতায় তারপরও কুঁড়ি ফোটে
শৈল-শিখরে শন্ শন্ বায়ু বয়,
প্রেমের বার্তা লয়ে সে পবন ছোটে
দিব্য-আশিসে কানে কানে কথা কয়।
গিরিশৃঙ্গের স্বর্ণশিখরে যেথা
একান্তে আছেন নৃপতি অধীশ্বর,
তাঁর সুধামাখা বহু-কাঙিক্ষত কথা
ভেসে ভেসে আসে মর্মে অনুস্বর।
দিবস-রজনী যে বাণীর আশায় আশায়
কান পেতে আছি নিত্য-নিরন্তর,
সে বাণী এমন স্বপ্নিল ভালোবাসায়
অমৃতের মতো এলো-যে অনন্তর।
‘ফেরা’ শব্দটা এতো মাধুর্যময়
আগে কি কখনো জানতে পেরেছে কেউ?
একটি শব্দ হতাশাকে করে জয়
হৃদয়ে জাগায় প্রসন্নতার ঢেউ।
নিষ্প্রাণ দেহে প্রাণ যে-ই এলো ফিরে
প্রাণময় হলো আমার অস্থি-মজ্জা,
আমার যাত্রা সবুজের মাঠ ঘিরে
সবুজেরই মাঝে পেতেছি আমার শয্যা।
ভাবনার পাখি ডানা মেলে বার বার
ফিরে যেতে চায় ফেলে আসা সেই দিনে,
অবুঝ পাখিকে বারন মানানো ভার
উড়ে উড়ে যায় অতীতের পথ চিনে।
ভাবনারা যেন সেই আগুনের মতো
‘অ্যামি সাগর’-এর জেলেনিরা যে আগুনে
সেঁকে সেঁকে খায় উল্লাসে অবিরত
তাজা তাজা মাছ কৌতুকে মেখে নুনে।
তোমার স্মৃতি চিত্তচিতায় পুড়ে পুড়ে
অঙ্গার হয় হৃদয় গহন গুহায়,
এমন সময় যেন ‘দূত’আসে উড়ে
অপেক্ষার এই আপ্লুত আঙ্গিনায়।
পাহাড়ের চূড়া ঘেঁষে, অবিরাম ভেসে ভেসে
স্বপ্নের ডানা মেলে, প্রতিরাতে সুধা ঢেলে
আমার প্রিতম এসে যায় যেন ভালোবেসে।
বলে যায়; ‘আর পথ চাওয়া নয়,
মহামিলনের এইতো সময়।
এই দ্যাখো আমি আবার এসেছি ফিরে,
তোমার প্রেমের নিবিড় নিভৃত নীড়ে।’
জাপানি কবিতা: কবি প্রিন্স ইকুসা (অষ্টম শতাব্দি)। ইংরেজি অনুবাদ; স্যাটো হিরোয়াকি এবং বার্টন ওয়াটসন। কবিতা সংকলন ‘ফ্রম দি কার্ন্ট্রি অফ এইট আইল্যান্ডস, সিয়াটল: ইউনিভার্সিটি অফ সিয়াটল প্রেস, ১৯৮১ থেকে সংগৃহীত।
২। কবি লেডি ইজুমি শিকিবু ( ৯৭৬—১০৩০)
কবিতা ত্রয়ী
এক.
এমন নিঝুম নিশুতি রাতে
বাঁশবাগানের পাতায় পাতায় অবিরাম শিলাপাতে।
নির্জনতায় কান পেতে শুনি,
শুকনো পাতার মর্মর-ধ্বনি
ঘুম নামে না-যে
নিদ নামে না-যে
বিনিদ্র আঁখিপাতে--
এমন নিঝুম নিশুতি, নিঝুম নিশুতি, নিঝুম নিশুতি রাতে।
-
দুই.
তোমাকেই ভালোবেসে,
এ হৃদয় ভেঙে হলে খান খান
যাতনার চৌকাঠে;
হাজার খণ্ড হলে সে হৃদয় ভেঙে
হারাবেনা তার এক টুকরোও
যত্নে রাখবো হৃদে।
তিন.
অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকারে
নিঃসীম আঁধার রাতে
এ পথিক পথহারা;
পাহাড়ের ঐ সুদূর সীমানা থেকে
দীপ্তি ঢালছে চাঁদের জোছনা ধারা।
-
৩। কবি মায়ও (১১৭৩—১২৩২)
কুয়াশা যখন গিলেছে আমার বাগিচা
গিলেছে আমার সবুজ ঘাসের গালিচা
গিলেছে আমার ঠিকানা কুটির
গিলেছে আমার ঘর;
তখন আমিও গলে গলে গলে
মিশে যেতে চাই আকাশের নীলে
নিত্য-নিরন্তর।
-
৪। কবি ভিক্ষু সোগি (১৪২১—১৫০২)
এদ্দিন পর একথা বুঝেছি আমি-
মানবজীবন স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নের অনুগামী।
জীবনের খেলাঘর; পরিত্যক্ত পোড়ো জমি,
ঊষর, পতিত, নিস্ফলা মরুভূমি।
অনাদরে বেড়ে ওঠা এ বনাঞ্চল,
সাজানো বাগান নয়; ঝোপ-জঙ্গল।
এখানে বসত করে সুখে প্রজাপতি,
এখানে নিবাস গড়ে এদেরই সারথি।
-
৫। ইয়ামামুরা বোচো (১৮৮৪—১৯২৪)
রিমঝিম বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা জলে,
দুর্ভাগা মানুষের গল্পই বলে।
কষ্টে ক্লিষ্ট সব মানুষের দিন,
যাতনার যাঁতাকলে হয় যে বিলীন।
অনটন অনাহারে দিন কাটে যার,
তার গল্পই প্রিয়; বৃষ্টি ফোঁটার;
ফোঁটায় ফোঁটায় সেই গল্পও ভাসে,
শীত শেষে নিশ্চিত বসন্ত আসে।
শীতের শৈত্য যাবে বহু বহু দূর,
কোকিল গাইবে কুহু, কুহু-কুহু সুর।
-
৬। কবি আইকোকু কোশিন কাইওকো (দেশাত্মবোধক কুচকাওয়াজ, ১৯৩৭)
আমার ভাইয়ের লাশ ভাসছে সাগরে
গিরি-পর্বতজুড়ে লাশের মিছিল
লাশে লাশে ছেয়ে গেছে সবুজের মাঠ
আমরাও তাজা প্রাণ দেব-যে বিলিয়ে
তোমার সেনানি হয়ে, হে সম্রাট।
আর নয় পিছু হটা নির্ভীক, নির্ভয়,
রক্ত আখরে লিখে আনবো বিজয়।
-
৭। হাহা নো ইউটা (মা সঙ্গীত)- শিক্ষা মন্ত্রণালয়,১৯৪৩.
মায়েরাই হলো মাতৃভূমির শক্তি
জননীরা হলো জন্মভূমির প্রাণ,
যে মায়ের বুকে অমিত সাহস ও ভক্তি
সে সাহসি মা-ই বীরত্বে মহীয়ান।
জন্মভূমি রক্ষায় যে-মা, ছেলেকে পাঠায় রণাঙ্গণে,
তার চেয়ে বলো আর কোন্ বীর শ্রেয় এই ত্রিভুবনে?
-
৮। জাপানি দেশাত্মবোধ উদ্বুদ্ধকরন সঙ্গীত: (‘নিপ্পন’-‘জাপান’-১৯৪১),(শিক্ষা মন্ত্রণালয়):
পৃথিবীর বুকে একদেশ আছে সবার সেরা সে দেশ,
সেই দেশে ঘটে অরুণ রবির উদ্ভাস-উন্মেষ।
সম্পদ জ্ঞান সম্ভাবনায় ঋদ্ধ সে-দেশবাসি,
বিধাতার আশিসে, সেই দেশ হাসে সাফল্য ভরা হাসি।
কল্যাণময় সেই দেশে নেই হানাহানি বিদ্বেষ,
সাম্য-মৈত্রীর এতো মনোরম, এতো মায়ামাখা দেশ।
কর্মে নিষ্ঠ সুশীল সে-জাতি বিশ্বের বিস্ময়,
গর্বিত সেই দেশের পতাকা, ‘নতুন সূর্যোদয়।’
অর্থ-বিত্ত, চিত্তবৃত্তি, শক্তিতে মহীয়ান,
সে দেশের কাছে পৃথিবীর সব দীপ্তিই যেন ম্লান।
কীর্তি-মহিমা ধন্য সে দেশ দিব্য-দীপ্যমান,
জাপানবাসির ‘নিপ্পন’, ‘নিহন’—বিশ্ববাসির ‘জাপান’।
..................
জাপানি কবিতা: দ্য অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক, চিলড্রেন’স মিউজিক্যাল কালচারস, সম্পাদনা পেট্রিসিয়া শেহান ক্যাম্পবেল এবং ট্রিভর উইগিন্স, অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৩ থেকে সংকলিত।